Home ওপিনিয়ন ভারতের উপাসনা স্থান আইন কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

ভারতের উপাসনা স্থান আইন কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

।। মাসুম মুরাদাবাদী ।।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উপাসনা স্থান আইনের ব্যাপারে বলেছেন, ‘কোনো আইনই আদালতের যাচাই-বাছাইয়ের বাইরে নয়।’ তার এ বক্তব্য এ হিসেবে গুরুত্বের দাবিদার যে, কেন্দ্র এ বিষয়ে জবাব দাখিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে যে সময় চেয়েছিল, তা ১২ ডিসেম্বর শেষ হবে। অমিত শাহের বক্তব্যে কেন্দ্রের অবস্থানের ঝলক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উপাসনা স্থান আইন সম্পর্কিত আইনের সাংবিধানিক মর্যাদা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যে অসঙ্গত প্রশ্ন দাঁড় করানো হয়েছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট অবস্থান অবলম্বন করা থেকে দূরে রয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, যেসব লোক সুপ্রিম কোর্টে এই আইনের সাংবিধানিক মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তাদের সরাসরি সম্পর্ক শাসক দলের সাথে।

নভেম্বরের শেষ দিকে এ মামলার শুনানির সময় সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড়ের বেঞ্চের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ মামলাকে মুলতবি ঘোষণার আবেদন করে বলেছিলেন, আমার বিস্তারিত জবাব দাখিলের জন্য সরকারের সাথে উচ্চপর্যায়ের পরামর্শের সময় দরকার। বেঞ্চ তাকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়ে এর ওপর আগামী বছর জানুয়ারিতে শুনানির দিন ধার্য করে দিয়েছেন। প্রকাশ থাকে যে, এ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট গত বছরের মার্চ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের জবাবের অপেক্ষা করছেন।

সবাই জানেন, অযোধ্যা বিবাদ চরম আকার ধারণ করলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক বিবাদ থেকে বাঁচার জন্য ১৯৯১ সালে তখনকার নরসিমা রাও সরকার পার্লামেন্টে একটি বিশেষ আইন পাস করিয়েছিল। ওই আইনের আলোকে দেশের স্বাধীনতার সময় যে উপাসনা স্থান যে অবস্থায় ছিল, সেটিকে হুবহু ওই অবস্থাতেই রেখে দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। বাবরি মসজিদ মামলাকে ওই আইন থেকে এ জন্য আলাদা রাখা হয়েছিল যে, মামলাটি ওই সময় আদালতে শুনানিধীন ছিল। ওই আইন পাস হওয়ার পর মানুষ এতটুকু নিশ্চিত হয়েছিল, যদি বাবরি মসজিদের ওপর কোনো আঘাত আসেও, তারপরও এই আইনের আলোকে দেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক মসজিদ নিরাপদ হয়ে যাবে। ওই সময় কিছু বুদ্ধিজীবীরও এমনই ধারণা ছিল- যদি বাবরি মসজিদ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার আকৃতিতে অন্যান্য উপাসনা স্থানের নিরাপত্তা অর্জন হয়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দূরদর্শী মানুষদের ওই সময়ও এ অভিমতই ছিল- বাবরি মসজিদ ইস্যু এ দেশে সেক্যুলারিজমের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

কেননা, ওই সময়ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হাতে এমন তিন হাজার মসজিদের তালিকা ছিল, যা তাদের ধারণামতে, মন্দির ভেঙে বানানো হয়েছিল এবং যেগুলো ‘উদ্ধারের’ জন্য তারা আন্দোলন করে যাচ্ছে। কিন্তু বাবরি মসজিদের ভ‚মি রামমন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দু পক্ষকে সোপর্দ করার পর তো এমন মনে হলো, রাস্তা যেন খুলে গেল। দিন দিন কোনো না কোনো মসজিদকে মন্দির হওয়ার কথা বলে স্থানীয় আদালতে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে। বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, আদালতগুলো উপাসনা স্থান সংরক্ষণ আইনের আলোকে প্রত্যাখ্যানের পরিবর্তে মামলাগুলোকে শুনানির জন্য মঞ্জুর করে যাচ্ছে। এ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশের সব ঐতিহাসিক মসজিদের নিচে একটি করে মন্দির খুঁজে মুসলমানদের ওই উপাসনা (ইবাদতের) স্থান থেকে বঞ্চিত করে দেয়া হবে।

আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ যখন বাবরি মসজিদের ভ‚মি বিরোধী পক্ষের কাছে সোপর্দ করার রায় দিলেন, তখন তাতে অন্য বিষয়ের পাশাপাশি এ কথাও মেনে নেয়া হয়েছিল, ‘বাবরি মসজিদ কোনো মন্দির ভেঙে বানানো হয়েছিল’ আদালত এ কথার কোনো প্রমাণ পাননি। কিন্তু বাবরি মসজিদের রায় হয়ে যাওয়ার পর যারা এটি ভেবেছিলেন যে, এখন এ বিবাদ সব সময়ের জন্য শেষ হয়ে গেল এবং মুসলমানরা আরামের ঘুম ঘুমাতে পারবে; তারা সে সময় নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন, যখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আন্দোলিত হয়ে উগ্রপন্থীরা অপর মসজিদগুলোর বিরুদ্ধেও প্রশ্ন দাঁড় করাতে শুরু করে।

আরও পড়তে পারেন-

এ ধারাবাহিকতার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদের বিরুদ্ধে। স্থানীয় আদালতের সহযোগিতায় এ মামলাকে এতটাই আইনি জটিলতায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তার ক্ষেত্রেও বাবরি মসজিদের মতো পরিণতি হতে দেখা যাচ্ছে। আল্লাহ না করুন এমনটি কখনো হোক, কিন্তু এ জটিলতাতে যে পরিমাণে গিট্টু লাগানো হয়েছে, তার তুলনা সে নিজেই। বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদই শুধু নয়, মথুরার শাহী ঈদগাহ, বাদায়ুনের শামসি জামে মসজিদের পর অতি সম্প্রতি মাঙ্গালুরোর (কর্নাটক) মালালি মসজিদের বিরুদ্ধে আইনি তদন্তের দাবি করা হয়েছে। অ্যাডিশনাল সিভিল জজ মালালি মসজিদের মুসল্লিদের ওই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন, যেখানে হিন্দু সংগঠনগুলোর মামলার আরজিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। প্রকাশ থাকে যে, হিন্দু সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে মসজিদটির সার্ভে করানোর দাবি করা হয়। আদালত মসজিদের মুসল্লিদের এই মামলার শুনানি ওয়াক্ফ আইন অনুযায়ী ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে করানোর প্রমাণ খারিজ করে দিয়েছেন। এই আদালতি রায় বারানসীর জ্ঞানবাপী মসজিদের মামলায় কৃত নকশার ওপর দেয়া হয়েছে। কেননা, মালালি মসজিদের নিচেও একটি মন্দির থাকার দাবি করা হয়েছে।

আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, বিগত দিনগুলোতে যে সময় জ্ঞানবাপী মসজিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বাজার গরম ছিল, তখন মুসলিম সমাজ ও সেক্যুলার গোষ্ঠী জোর দিয়ে বলেছিল, ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থান আইনের আওতায় সব উপাসনা (ইবাদত) স্থান সংরক্ষিত। এগুলোর অবস্থা পরিবর্তন করা যাবে না।” কিন্তু বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট জজ বলেছেন, উল্লিখিত আইন আদালতি সার্ভের কাজের অন্তরায় নয়। এরপর ওই আইনের বিরোধিতার বিষয়টি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আর এখন তার সাংবিধানিক মর্যাদাকেই সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে নিযুক্ত সিনিয়র উকিল রাকেশ দুবেদি সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চকে বলেছেন, ১৯৯১ সালের ধর্মীয় স্থান সম্পর্কিত আইনের বিধানকে পার্লামেন্টে অপর্যাপ্ত আলোচনার পর পাস করা হয়েছিল। এ জন্য এই আইনকে নামসর্বস্ব ঘোষণা করা হোক। কেননা, এর সাথে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। এরপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের টাটকা বক্তব্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার নামান্তর।

সুপ্রিম কোর্টে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের পক্ষ থেকে উপাসনা (ইবাদত) স্থানগুলোর সংরক্ষণ সম্পর্কিত আইনকে চ্যালেঞ্জকারী আবেদনগুলোর বিরোধিতা করে বলা হয়েছে, এমন এক আইনকে বিলুপ্ত করার আবেদন করা হচ্ছে, যাকে স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট মেনে নিয়ে বলেছেন, এটি ভারতের সেই উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ, যেখানে বলা আছে- ‘দেশে সব ধর্ম সমান’। প্রকাশ থাকে, বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট তার বিশ্লেষণে বলেছিলেন, ‘এ আইন মূলত এ কথার স্বীকারোক্তি যে, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সব ধর্মকে সমভাবে সম্মান ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। আর এটি ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যও।’

এ ব্যাপারে মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে দাখিলকৃত আবেদনে বলেছে, এই আইনের মৌলিক মর্যাদা ও এর ওপর উচ্চ আদালতের বিশ্লেষণ থাকা সত্ত্বেও যদি চ্যালেঞ্জকারীদের দাবিগুলো মেনে নেয়া হয়, তাহলে এতে নতুন সমস্যা ও বিবাদ-বিতর্ক সৃষ্টি হবে। বোর্ড এ কথাও বলেছে, এই গণস্বার্থের দাবিদার আবেদনগুলোর আড়ালে চ্যালেঞ্জকারীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে। এ ধরনের বিতর্ক মূলত সমাজের শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে এবং সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে দেয় বাবরি মসজিদের শাহাদতের পর গণহত্যা ও লুটতরাজ আকারে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। বোর্ডের আবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালের আইনের মৌলিক উদ্দেশ্যই এটি ছিল যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের দাবিগুলোর পথ যেন বন্ধ করা যায়। কেননা, ধর্মীয় উপাসনা (ইবাদত) স্থানের সাথে সম্পর্কিত বিতর্ক-বিবাদ বেশ স্পর্শকাতর হয়, যা আইনের ক্ষমতাকেই শুধু চ্যালেঞ্জ করে না; বরং সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তাকেও তছনছ করে দেয়।

[মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ২৭ নভেম্বর, ২০২২ থেকে অনুবাদ করেছেন- ইমতিয়াজ বিন মাহতাব; ইমেইল- ahmadimtiajdr@gmail.com]

মাসুম মুরাদাবাদী, ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকবেন।