Home ওপিনিয়ন চীন ও ভারত কেন বাংলাদেশের একই বন্দরে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে

চীন ও ভারত কেন বাংলাদেশের একই বন্দরে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও রয়েছে। আঞ্চলিক দুই প্রতিযোগী শক্তি এদেশের একই বন্দরে বিনিয়োগ করতে চাইছে, যা অনেককেই বিস্মিত করছে। খবর নিক্কেই এশিয়ার

উভয় শক্তিই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর মোংলায় বিনিয়োগ করতে চায়। দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের এই বন্দরের দিকে দৃষ্টি রয়েছে ভারত ও চীনের। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে তারা কয়েকশ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, শেষপর্যন্ত তার বাস্তবায়ন করেনি।

কিন্তু, এই দৃশ্যপট বদলায় গত বছরের ডিসেম্বরে; এসময় খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারত ও চীন জানায়, তারা বিনিয়োগ নিয়ে এগোবে। তবে মোংলা বন্দরের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, উভয় দেশের প্রকল্প আলাদা; আর বাংলাদেশের এই শিপিং হাবটি ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে ভূরাজনৈতিক রশি টানাটানির ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে– এটাও তারা অস্বীকার করেন।

তবে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ প্রভাব বিস্তারের এই প্রতিযোগিতা অনিবার্য বলেই মনে করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্ট এশিয়া সেন্টারের পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারত ও চীন পরস্পরের বৈরী প্রতিযোগী, তারপরও একই বন্দরে উভয়ের অর্থায়ন ‘খুবই বিস্ময়কর’।

বাংলাদেশের শিপিং ও বন্দর শিল্পে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে চীনের। অন্যদিকে, ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের দুটি বন্দর – চট্টগ্রাম ও মোংলায় – ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাচ্ছে।

২০১৫ সালে নয়াদিল্লির এক লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় মোংলা বন্দর উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। কিন্তু, পরের চার বছরে প্রায় ৬০ কোটি ডলার মূল্যের উদ্যোগ এগিয়ে নিতে কোনো ঠিকাদার নির্বাচন করেনি ভারত। এনিয়ে বাংলাদেশের তরফ থেকে বারবার অনুরোধের প্রেক্ষিতে শেষপর্যন্ত ‘এজিস ইন্ডিয়া কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স নামক একটি কোম্পানিকে নির্বাচন করে দিল্লি। গত ডিসেম্বরের শেষদিকে কোম্পানিটির সাথে চুক্তি সই করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।

-সংগৃহিত ছবি।

অন্যদিকে, ২০১৬ সালে ঢাকা সফরকালে বহুখাতে বিনিয়োগের একটি সামষ্টিক চুক্তি (আমব্রেলা ডিল) করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর আওতায় এদেশের ২৭ প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন; যার মধ্যে মোংলা বন্দরের সম্প্রসারণ ও পরিষেবা উন্নয়নের একটি প্রকল্পও ছিল। সম্ভাব্যতা অধ্যয়নে প্রকল্পটিকে বাংলাদেশের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, প্রস্তাবিত ৪০ কোটি ডলার অর্থায়নে বিলম্ব করতে থাকে বেইজিং।

ভারত এজিসকে ঠিকাদার নির্বাচন করেছে এই সংবাদ প্রকাশের পর, গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর বেইজিং বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ প্রকল্পে অর্থায়নে তাদের সম্মতির বিষয়টি নিশ্চিত করে।

মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে চীন সরকার বলেছে, ‘আপনাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানাচ্ছি, চীনা পক্ষ আলোচিত প্রকল্পের পর্যালোচনার কাজ শেষ করেছে এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, এটা চীন সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং চীনা জিসিএল (গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন) সমর্থন নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ’।

এতে আরো বলা হয়, ‘প্রকল্পটিকে জিসিএল প্রজেক্ট রিজার্ভে যুক্ত করতে চীনা পক্ষ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে’।

জাপান-ভিত্তিক গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়াকে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘মোংলা বন্দর দিয়ে এখন আরো বেশি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হচ্ছে, সে তুলনায়, ভবিষ্যৎ সব চাহিদা পূরণে দরকারি সক্ষমতা না থাকায় – উভয় (দেশের) বিনিয়োগই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বন্দরের আরো সম্প্রসারণ করতে হবে, আমাদের আরো অবকাঠামো নির্মাণের দরকার হবে’।

গত বছরে উদ্বোধন হওয়া পদ্মা বহুমুখী সেতুর কল্যাণে এ বন্দরের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। এই সেতুর কল্যাণে, সড়কপথে মোংলার সাথে ঢাকার যোগাযোগের দূরত্ব এখন ১৭০ কিলোমিটার, যা আগে ছিল ২৮০ কিলোমিটার। অন্যদিকে, রাজধানীর সাথে সড়কপথে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার।

নিজ নিজ বাণিজ্যের জন্য ভারত, নেপাল ও ভূটানও ব্যবহার করতে চায় মোংলাকে। এছাড়া, প্রস্তাবিত বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডরের জন্যও এ বন্দরের ব্যবহার আবশ্যক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জানান, চীনা বিনিয়োগের আওতায় দুটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ করা হবে। অন্যদিকে, ভারতীয় অর্থায়নের মাধ্যমে জেটি, সড়ক, পার্কিং লট, অফিস এবং একটি আবাসিক কমপ্লেক্সও গড়ে তোলা হবে।

মুসা আরো ব্যাংখ্যা করে জানান, দুটি প্রকল্প হবে বন্দরের ভিন্ন দুটি স্থানে। ‘উভয় প্রকল্পের প্রসঙ্গ এক নয়; তাদের অর্থায়ন ব্যবস্থা ভিন্ন, কাজও আলাদা হবে। ফলে একে-অপরের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না’।

আরও পড়তে পারেন-

পদ্মা সেতুর কল্যাণে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সাথে ঢাকাসহ দেশের বাকি অঞ্চলের যোগাযোগের সুবিধা বেড়েছে।

বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেই ভূরাজনৈতিক অঙ্গনের বৈরী দুই দেশ বন্দর নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এমন ধারণাকে নাকচ করে দেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মুসা। তিনি বলেন, ‘আমাদের চাহিদা অনুযায়ী তারা অর্থায়ন করছে। শর্ত নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ সরকার, ভারত বা চীন নয়। তাই তারা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না’।

তবে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তিনি ভারত ও চীনের মধ্যে বৈরীতার কথা স্বীকার করেন, তবে সরকার উভয় দেশের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে কোনো একটি দেশ (ভারত বা চীন) কতোটা প্রভাব বিস্তার ও বিনিয়োগ করছে, তা নিয়ে অপর দেশ সব সময়েই একটা উৎকণ্ঠায় থাকে’ বলেন তিনি।

নিকট অতীতে এসব উদ্বেগ গোপন থাকেনি, বিভিন্ন সময় এগুলো প্রকাশ্যে এসেছে। যেমন চীনের অর্থায়নে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বিরোধিতা করেছে ভারত। তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ চুক্তি প্রায় সই করতেই যাচ্ছিল, কিন্তু নয়াদিল্লির চাপে সে অবস্থান থেকে সরে আসে, এতে অসন্তুষ্ট হয় বেইজিং।

‘এখন বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই একই বন্দরে বিনিয়োগ করতে চায়, এটা কীভাবে কাজ করবে– আমার বোধগম্য হয় না। তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে এনিয়ে প্রতিযোগিতা কাজ করছে, দুই দেশই বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে’।

আবার বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ নয় – যেখানে বন্দর নিয়ে একে-অপরের বিরোধিতায় নেমেছে ভারত ও চীন। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরে গত বছর যখন চীনের একটি অত্যাধুনিক সার্ভে জাহাজ ভেড়ার অনুমতি চায়, তক্ষণাৎ কলম্বোর কাছে এবিষয়ে তাদের আপত্তি জানায় ভারত। ফলে জাহাজটির সফরের সময়সূচি বদলানোর অনুরোধ করে কলম্বো। অবশ্য শেষপর্যন্ত জাহাজটিকে আসার অনুমতি দেয় দ্বীপ রাষ্ট্রটি।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তৌহিদ হোসেন উল্লেখ করেন যে, মোংলা বন্দর নিয়ে ভারতের সাথে চুক্তি হলেও, এখনও চীনের সাথে করা বাকি। ‘মোংলা বন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে এখন আমরা যেন চীনের সাথেও চুক্তি না করি– ভারত সেবিষয়টি প্রভাবিত করে কিনা- সেটা আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাছাড়া দিল্লির সাথে চুক্তি থাকায়, তাদের প্রতিক্রিয়াটা প্রভাব ফেলবেই’।

বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ এখন কীভাবে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করতে চাইছে তার একটা বৃহত্তর চিত্র তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত হতে চায়। এজন্য এদেশে তারা নিজেদের প্রতিযোগীদের কার্যক্রম মনিটর করে, এবং নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য প্রতিপক্ষের প্রচেষ্টাগুলোকে নস্যাৎ করতে চায়’।

বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে সংকটে আছে বাংলাদেশ, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দক্ষিন এশিয়া জুড়েও বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় বৃহৎ শক্তিগুলোর সমর্থন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, পর্যবেক্ষকরা উল্লেখ করেন যে, এই সমর্থন পেতে গিয়ে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কেও অসচেতন থাকা যাবে না।

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘একই বন্দরের জন্য চীন ও ভারতের অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। তবে একইসঙ্গে তিনি তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘এই বিষয়টিকে সরকারের যথেষ্ট সতর্কভাবে সামলানো উচিত’।

তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত হিসেবেই’ প্রকল্প কাজে ভারতের এজিস সংস্থাকে নির্বাচন করা মাত্রই চীন ইতিবাচকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ‘প্রতিযোগিতায় কোনো ক্ষতি নেই, যদি আমরা সেটা সতর্কভাবে সামলাতে পারি। (তাহলে) এটা দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য শুভ ইঙ্গিত হবে’।

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।