Home ইসলাম মসজিদ পরিচালনায় ইসলামের ৮ নির্দেশনা

মসজিদ পরিচালনায় ইসলামের ৮ নির্দেশনা

প্রতিকী ছবি।
ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

মসজিদ পরিচালনা মূলত দ্বিনের এক বৃহৎ খেদমত আঞ্জাম দেওয়া, যা শুধু আল্লাহ তাআলার তৌফিকেই সম্ভব হয়। যাঁরা মসজিদ পরিচালনার সুযোগ পান, তাঁদের অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করা উচিত। আমাদের দেশে সাধারণত মসজিদগুলো সামাজিকভাবে পরিচালিত হয়। মসজিদ পরিচালনার জন্য কমিটি তৈরি হয়। মসজিদ কমিটি মসজিদের আয়-ব্যয় দেখভালসহ খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম নিয়োগ দান, তাঁদের সম্মানীর ব্যবস্থা ও মুসল্লিদের সুযোগ-সুবিধার জন্য মসজিদের উন্নয়নকাজ সম্পাদন করে থাকে। মসজিদ পরিচালনার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় স্মরণ রাখা দরকার।

ঈমানি দায়িত্ব মনে করা : পৃথিবীর সর্বপ্রথম নির্মিত গৃহ হলো মসজিদ, যা মক্কায় স্থাপিত কাবাগৃহ হিসেবে পরিচিত। সেটিই মুসলমানদের কিবলা। মসজিদকে কেন্দ্র করেই মুসলিম উম্মাহর জীবন আবর্তিত হয়। কাজেই মসজিদ পরিচালনা মানে—আল্লাহর ঘর এবং মুসলিম উম্মাহর মূূল কেন্দ্র পরিচালনা করা। মসজিদ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে পরিগণিত। আল্লাহ বলেন, ‘তারাই তো আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও আখিরাতে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১৮)

নিজেরাও নিয়মিত মসজিদে আসা : মসজিদ পরিচালনায় সম্পৃক্তরাও নিয়মিত মসজিদে এসে নামাজ-বন্দেগি আদায় করা। অন্যের নামাজ-বন্দেগির ব্যবস্থা করে নিজেরা নিয়মিত মসজিদে না আসা অতিশয় গর্হিত কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা যা করো না তা তোমরা কেন বলো? তোমরা যা করো না তোমাদের তা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসন্তোষজনক।’ (সুরা : সাফফ, আয়াত : ২-৩)

তাকওয়ার ভিত্তিতে মসজিদ পরিচালনা : মসজিদের ভিত্তি হতে হবে কেবলই তাকওয়া। অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর অধ্যাত্মিক প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে মসজিদ পরিচালিত করতে হবে। সমাজে বিভেদ সৃষ্টি, নিজেদের আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের কোন্দল অথবা ব্যক্তিস্বার্থ যেন মসজিদে স্থান না পায়। আল্লাহ বলেন, ‘যারা মসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরি ও মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতিপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, আমরা সদুদ্দেশ্যেই তা করেছি; আল্লাহ সাক্ষী তারা তো মিথ্যাবাদী। তুমি সেখানে কখনো দাঁড়াবে না; যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই স্থাপিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর, তা-ই তোমার সালাতের জন্য বেশি যোগ্য।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৭-১০৮)

আমানতদারির সঙ্গে মসজিদ পরিচালনা : মসজিদের আয়-ব্যয় অত্যন্ত আমানতদারির সঙ্গে পরিচালনা করা। কারণ মসজিদের সম্পদ একক কোনো ব্যক্তির নয়, বরং তা সবার। এ সম্পদের নয়ছয় করা পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কেউ অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করলে, যা সে অন্যায়ভাবে গোপন করবে কিয়ামতের দিন সে তা নিয়ে আসবে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬১)

তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন—আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে।’ (সুরা : নিসা : আয়াত : ৫৮)

আরও পড়তে পারেন-

নীতিমালা অনুসরণ করা : মসজিদ নির্মাণ ও পরিচালনা করতে যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করা চাই। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া খাসজমিতে অথবা মসজিদের জন্য বরাদ্দ করা ছাড়া কোনো স্থানে মসজিদ নির্মাণ করা কোনোভাবেই যথার্থ বলে বিবেচিত হবে না। রাসুল (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন। এরপর স্থান নির্বাচন করলেন। এবার সেই স্থানের মালিক সম্পর্কে লোকদের কাছে জানতে চাইলেন। লোকেরা বলল, এ স্থান বনু নাজ্জারের দুই এতিম বালকের। তাদের নাম সাহল ও সুহাইল। তারা আসআদ ইবনে যুরারার প্রতিপালনে রয়েছে। নবী (সা.) তাদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তাদের কাছে জমিটি ক্রয়ের প্রস্তাব দিলেন। তারা দান করতে চাইলেও নবী (সা.) তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন। তাদের অভিভাবকের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয়ের কথাবার্তা পাকাপোক্ত করে উপযুক্ত মূল্যে তা ক্রয় করলেন। সেখানে কিছু খেজুরগাছ ছিল, নবী (সা.) সেগুলো কাটালেন। কাঁচা ইট বানানোর নির্দেশ দিলেন। এরপর সবার সহায়তায় মসজিদ নির্মাণ করলেন। (সিরাতুল মুস্তাফা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪২৫)

নবী (সা.) পরিকল্পিতভাবে এবং জমি ক্রয় ও গৃহনির্মাণের তৎকালীন স্বাভাবিক নীতিমালা অনুসরণ করে মসজিদ নির্মাণ করেন। যথাযথ প্রক্রিয়ায় মসজিদ নির্মাণ ও মসজিদ পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন করে সে অনুযায়ী মসজিদ পরিচালনা করলে মসজিদ সুচারুরূপে পরিচালিত হবে।

যোগ্য ইমাম নিয়োগ দেওয়া : দ্বিনদার, মুত্তাকি, শিক্ষিত ও যোগ্য খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম নিয়োগ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে কোনো দল বা মতের অনুসরণ, আত্মীয়তা বা সুপারিশের আশ্রয় না নেওয়া। মসজিদে কর্মরতদের যথাসাধ্য সম্মানজনক সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা এবং যথাযথ সম্মান-মর্যাদা প্রদান করা। কারণ তারা উম্মতের ধর্মীয় বিষয়ের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। নবী (সা.) নিজে  ইমাম ছিলেন। নিজেদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারা মসজিদকে প্রভাবিত না করে ইমাম ও খতিবকে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সঠিক আলোচনা উপস্থাপনের মাধ্যমে মুসল্লিদের সেবা করার সুযোগ নিশ্চিত করা।

ইবাদতের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা : মসজিদে মুসল্লিদের ইবাদতের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধময় রাখতে হবে। যেন মুসল্লিরা স্বাচ্ছন্দ্যে ইবাদত-বন্দেগি পালন করতে পারে। নিজের কফ-থুথু, নাকের ময়লাসহ হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও যেন কোনো প্রকার ময়লা মসজিদে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘এবং ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫)

রাসুল (সা.) মসজিদকে পাক-পবিত্র ও সুগন্ধময় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৫৯৪; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৫৫)

নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে কোনো ময়লা বের করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে গৃহ নির্মাণ করেন।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৭৫৭)

মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : মুসল্লিরা যেন নিরাপদে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে সেটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। মুসল্লিদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা, বিপজ্জনক বিদ্যুৎ সংযোগ, ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক পাখা-বাতি ইত্যাদি অপসারণ করতে হবে। সম্ভাব্য ঝুঁকির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। নিজেদের কৃতকর্মের মাধ্যমে যেন নিরাপত্তায় কোনো প্রকার বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। এই নিরাপত্তা তো আল্লাহই দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায় (মক্কার আরেক নাম), তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি। এতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন—মাকামে ইবরাহিম। আর যে কেউ সেখানে প্রবেশ করে সে নিরাপদ।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬-৯৭)

পরিশেষে বলা যায়, মসজিদের সঙ্গে মুমিনের সম্পর্ক অতি নিবিড়। মসজিদ ছাড়া ঈমানি জীবন কল্পনা করা যায় না। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজিদে যেতে হয়। ইসলামী সমাজ মসজিদকেন্দ্রিক পরিচালিত হয়। কাজেই মসজিদ যথাযথভাবে পরিচালিত হলে মুসলমানদের ঈমানি জীবনও সহজ হবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।