Home গল্প-উপন্যাস খলীফার আর মধু খাওয়া হলো না

খলীফার আর মধু খাওয়া হলো না

।। সাজ্জাদ হোসাইন খান ।।

এটা এক ভিন্ন রকমের রাজপ্রাসাদ। সেখানে থাকেন এক রাজা। তবে এই রাজপ্রাসাদের তেমন কোনো জৌলুস নেই। নেই কোনো সশস্ত্র পাহারাদার। লাল-নীল ঝাড়ে জ্বলে না হাজার রঙের বাতি। মউ মউ করে না আতর-গোলাপের গন্ধ। নেই মুক্তো-মানিক খচিত সিংহাসন অথবা উজির-নাজির-সভাসদ-মোসাহেবে গমগম করা রাজদরবার। নহবতখানায় বাজে না নহবত। দুয়োরাণী-সুয়োরাণীর দাসী-বাঁদীদের কলকণ্ঠ নেই। দাঁড়ে বাঁধা শুকসারি নেই। হাতীশাল নেই। ঘোড়াশাল নেই। কিছু নেই।

রাজপ্রাসাদের যখন এই ছিরি, তবে রাজার অবস্থা কেমন?

রাজারও ঠিক একই চেহারা।

জরির পোশাক নেই। মোতি বসানো ইয়া বড় আলখেল্লা নেই। নেই স্বর্ণের তৈরি মুকুট, যা থেকে ঠিকরে পড়ে শত শত সূর্যরশ্মি। গলায় হীরের মালা নেই। পায়ে নেই সোনালী নাগরা। আগে-পিছে থাকে না শত শত দাস-দাসী, সশস্ত্র-সেপাই।

এ আবার কেমন রাজা? কিসের রাজা? কোন দেশের রাজা? এমন রাজাও আবার কোথাও আছে নাকি? সব মিথ্যা। সব গাঁজাখুরি কথা। এ ধরনের প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়া স্বাভাবিক। রাজপ্রাসাদ নেই। বড়ো গোঁফওয়ালা প্রহরী নেই। লোক-লশকর নেই। সিংহ-দরজায় কামান নেই। ঝলমলানো রাজদরবার নেই। সিংহাসন নেই। দাস-দাসী নেই। হাতী নেই। ঘোড়া নেই। এমনকি একটি মুকুটও নেই। এমন একজন গরিব লোক কি করে রাজা হবেন! এমন লোক কি কখনো দেশের রাজা হয়!

হ্যাঁ। এমন একজন গরিব রাজা ছিলেন। আর তার রাজ্যের সীমা ছিল আধা পৃথিবী। তার নাম শুনেই আশপাশের বড় বড় রাজারা থরথর করে কাঁপতো। তার রাজ্যে ছিল না অভাব। উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ছিল না। সব মানুষ ছিল সমান। সেখানে সুখ ছিল অফূরন্ত। হাসি-খুশিতে ভরে থাকতো তার রাজ্য। সব মানুষ ছিল ভাই ভাই। হিংসা- দ্বেষ তাদের স্পর্শ করতো না কখনো।

সেই রাজার কথা। রাজ্যের কথা। রাজপ্রাসাদের কথা।

সেই রাজার ছিল একখানা কুঁড়ে ঘর। তাতে খেজুর পাতার ছাউনি। এটাই মহাপ্রতাপশালী রাজার রাজপ্রাসাদ। এসব শুনে মুখ টিপে টিপে হাসা যায় ঠিকই। কথাটা কিন্তু সত্যি। দিনে সেই রাজপ্রাসাদের উঠানে খেলা করতো ঝলসানো হলদে রোদ। আর রাতে খেজুর পাতার ফাঁকে ফাঁকে জোসনারা খেলতো লুকোচুরি। ফুরফুরে বাতাস তার হিমেল পরশে বাজাতো নহবত। সিংহাসন? খেজুর পাতার চাটাইয়ের একখানা ‘সিংহাসন’। এতে বসেই তিনি চালাতেন তার রাজ্য। ঝলমলানো ঝাড়বাতির পরিবর্তে জয়তুন তেলের একটি ছোট্ট কুপি।

ঘরে আসবাবপত্র বলতে ছিল এই। গায়ে দেয়ার মতো ছিল একটিমাত্র জামা। তা-ও আবার কয়েক জায়গায় ছেঁড়া, যা ধুয়ে দিলে বা কোনো কারণে ভিজে গেলে শুকানোর আগ পর্যন্ত তাকে উদোম গায়েই থাকতে হতো। কারণ-অতিরিক্ত আর একখানা পোশাক কেনার মতো পয়সার অভাব। অনেকদিনই না খেয়ে কাটাতেন। তবু তিনি রাজা। মহাশক্তিধর রাজা। দেশের সমস্ত জনগণ তার সেপাই। আর আল্লাহ্ স্বয়ং থাকতেন এই গরিব রাজার জীবনের পাহারাদার।

কথায় কথায় আমরা অনেকটা পথই এগিয়ে এলাম। কিন্তু রাজার পরিচয় অথবা তার নাম, কিছুই তো জানা হলো না। এখন আসল কথায় আসা যাক। কে এই মহাশক্তিমান রাজা? তার নাম হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাযি.)। রাজ্য-আরব, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ইরান। রাজধানী-মদীনা।

আরো একটু খোলাশা করে বলা যাক। তিনি হযরত উমর (রাযি.)। তার শাসন ব্যবস্থা আজো অনুকরণীয়। তিনি ছিলেন সম্রাট। তিনি ছিলেন ইসলামী খিলাফতের দ্বিতীয় খলীফা। তবু তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতোই জীবন কাটিয়েছেন।

তাঁর জীবনের একটি ঘটনা। তখন তিনি খলীফার দায়িত্বে। একদিন তার বেগম সাহেবা বললেন- বহুদিন থেকে জয়তুন তেল দিয়ে শুকনো রুটি খেয়ে কেমন অরুচি ধরে গেছে। একটু মধুর যদি ব্যবস্থা করতে পারতেন……।

খলীফা বুঝলেন বেগমের মনের ব্যথা, কারণ তার নিজের মনের অবস্থাও প্রায় তাই। কিন্তু কি করবেন! কোনো উপায় তো নেই। বায়তুলমাল থেকে যে ভাতা আসে, তা থেকে একটি দিরহামও বাঁচে না। একটি সাধারণ গৃহস্থ যা পায়, তিনিও তাই পান। কাজেই মধু দিয়ে রুটি খাবার সুযোগ কোথায়!

খলীফাকে চিন্তান্বিত দেখে বেগম একটি উপায় বের করলেন। বললেন, বায়তুলমাল থেকে কয়েকটা দিরহাম ধার নিলেই তো সমস্যা মিটে যায়। খলীফা ভাবলেন, ঠিকই। ব্যাপারটি সহজ হয়ে গেল। তিনি বায়তুলমালের পরিচালকের নিকট যাওয়ার জন্যে তৈরি হলেন।

কিন্তু খলীফার পুত্র বললেন- আব্বাজান! আপনি কি আগামীকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন বলে আশা করেন?

আগামীকাল কেন, এই মুহূর্তের পরমুহূর্তেই আমার জীবনের দশা কি হবে আমি জানি না।

তাহলে আপনি কী করে ঋণ করতে পারেন?

অর্ধেক জাহানের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী খলীফা উমর (রাযি.) থর থর করে কেঁপে উঠলেন। ভাবলেন, সত্যি তো! আমি উমর এর জীবন আল্লাহর হাতে, আমার জীবনের কোনো এক মুহূর্তের মালিকই তো আমি নই। তাহলে আমি কেমন করে ঋণ করে তা পরিশোধ করার দায়িত্ব নিতে পারি!

খলীফার আর মধু খাওয়া হলো না। খলীফা-গৃহিণীর মধু দিয়ে রুটি খাওয়ার সাধও কুঁড়ি মেলার আগেই ঝরে গেল।