।। আরিফুল ইসলাম শিকদার ।।
পর্ব তিনঃ আধুনিকতা সকল অন্যায়কে বৈধতা দেওয়ার বড় হাতিয়ার। আধুনিকতার সাথে ইসলামের সম্পর্কের প্রাথমিক একটা ধারণা প্রথম পর্বে দিয়েই লেখাটা শুরু করেছিলাম। এখানে আরেকটু বিস্তারিত বলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব।
আলাপের প্রথমেই বলেছি, ইসলাম শ্বাসত, আর আধুনিকতা তথা মর্ডানিজমের দাবি প্রত্যেক যুগে ইসলামে অবিশ্বাসীদের মধ্য থেকেই উচ্চারিত হয়েছে। এখন শ্বাসত নাকি আধুনিক এই বিতর্ক কি শুধুই শব্দগত? নাকি এর মৌলিক কোন ভিত্তি আছে ?
সম্মানিতক পাঠক, আপনার একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন যে, এই সংঘাত শুধু শব্দগত নয়, বরং এটার মৌলিক ভিত্তি আছে। আধুনিকতার আলাপ প্রত্যেক যুগে অবিশ্বাসীরাই কেন তুলল? এর প্রধান কারণ হল নফসের অনুসরণ। যেটা কিতাবী সমস্ত ধর্মেই বারবার নিন্দনীয় সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামও প্রবৃত্তির অনুসরণকে নিন্দনীয় সাব্যস্ত করছে।
যেমন- হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- “বোকা ঐ ব্যক্তি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে আর প্রত্যাশা করে জান্নাতে যাবার”। পবিত্র কুরআনেও অবিশ্বাসীদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে যে, তারা কেবল নফসের অনুসরণ করে।
এবার দেখুন আধুনিকতা ধারণটি মূলতঃ কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত। জ্বী, ব্যক্তি স্বাধীনতা তথা নফসের অনুসরণ।
আধুনিকতা তথা মর্ডানিজম তত্বের ব্যাখ্যা প্রভাবশালী জার্মান দার্শনিক ইউগেন হেবারমাস কীভাবে করছে, দেখুন। তিনি বলছেন-
আধুনিক ইউরোপের শুরুর দিকে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, গণশিক্ষা ও এনলাইটেনমেন্ট মিলে আধুনিকতাকে তৈরি করলেও এগুলো স্বয়ং আধুনিকতার মৌলিক কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে মানুষ যা ধারণা করে হেগেলের মতে তা হলো- ‘সাবজেক্টিভিটি’। হেগেলের অনুমানকে হেবারমাস এভাবে তুলে ধরেন-
“সাবজেক্টিভিটির মূলত চারটি রূপ রয়েছে-
(ক) ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা- আধুনিক বিশ্বে লাগামহীন ব্যক্তি স্বাধীনতা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা দাবি করে বসতে পারে ।
(খ) সমালোচনা করার অধিকার- আধুনিক বিশ্বের মূলনীতি দাবি করে যে, কেউ যদি কোনো কিছুর স্বীকৃতি দেয়, তাহলে এটি তার নিজের কাছে অবশ্যই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বলে গণ্য হবে।
(গ) কর্মের স্বাধীনতা- আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, আমরা যা করি সে ব্যাপারে আমরা দায়বদ্ধ থাকবো।
(ঘ) ভাববাদী দর্শন- হেগেল মনে করতেন, আত্মচেতনার ধারণা দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়াটা আধুনিকতার অবদান।”
হেবারমাস হেগেলের এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছেন, আধুনিকতার মূল কথা হলো ব্যক্তির আত্মসচেতনতা। এটি প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বীয় কল্যাণ সাধনকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়ার কথা বলে। এর বিপরীতে জন্মগতভাবে বা ঐতিহ্য হিসেবে ব্যক্তি যা কিছু পেয়েছে শুধুমাত্র সেসব বিষয়কে অনুসরণ করবে।”
এবার আসুন মনোবিকার তত্বের গুরু সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ধ্যান- ধারনা জেনে নেই; যিনি আধুনিকতা বিকাশের অন্যতম একজনও।
তার মতে- “মানসিক জীবনে অবচেতন সত্ত্বার প্রাধান্যের ধারণা, যাতে সমস্ত ব্যক্তিক বাস্তবতা মৌলিক তাড়না এবং প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যার মাধ্যমে মানুষ বাইরের বিশ্বকে অনুভব করে”।
ক্লাসে পদ্মা নদীর মাঝি পড়া অবস্থায় ফ্রয়েডের মনোবিকার তত্ব সম্পর্কে প্রথম পরিচয় হয়। ফ্রয়েডের মতটা খেয়াল করুন, তিনি বলছেন- বাইরের বিশ্বকে অনুভব করে মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নার দ্বারা। এর মানে যা দাঁড়ায় তা হলো, আমাদের প্রতিটি সম্পর্কের মূল হল প্রবৃত্তির তাড়না। ক্লাসে শিক্ষকই ব্যাখ্যা করেছিলেন- “মা তার ছেলেকে এবং বাবা তার মেয়েকে বেশী ভালোবাসার কারণ হল সেক্স, তথা প্রবৃত্তির তাড়না, বিপরীত লিংগের প্রতি আকর্ষন”।
এই অদ্ভুত দর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোন এক সময় করব। আজকে শুধু বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটুকু বলতে চাই যে, আধুনিকতার মৌলিক দাবি হল- প্রবৃত্তি তথা ব্যক্তি স্বাধীনতা। আর এই কারণেই পশ্চিমা সমাজ আত্মহত্যাকে পাপ মনে করে না, বরং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার মনে করছে।
এবং এই একই চিন্তার পাটাতনে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে, উভয় জনের সম্মতিক্রমে যৌন সম্পর্ক হলে তাকে অপরাধ হিসাবে গন্য করা যাবে না, এমনকি সমকামিতাকেও এই একই কারণে বৈধতা দেয়া হচ্ছে।
এমনকি চুরি – ডাকাতি ধর্ষণ সব কিছুকে এক ধরনের রোগ যা জ্বীনগত কারণে হয় প্রমাণ করে অপরাধীর অপরাধকে জাস্টিফাইড করা হচ্ছে। লঘু করা হচ্ছে।
এভাবে প্রতিটি অপরাধকে মূলতঃ বৈধতা দেওয়ার একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলছে। আর এই সব চিন্তার মূলে রয়েছে আধুনিকতা।
আধুনিকতা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মূল লক্ষ্য ধরে সমাজ গঠন করে। অপরদিকে ইসলাম সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে সমাজ গঠন করে। যার ফলে ইসলামের দৃষ্টিতে চরম অন্যায় ও ক্ষতিকারক বিষয়ই আধুনিক সমাজে হয়ে ওঠে ন্যায় ও অধিকারের পাঠ রূপে। [চলবে]
(প্রথম কিস্তি এই বিভাগে গত ৬ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে)
লেখকঃ আহবায়ক মুভমেন্ট ফর ইনসাফ।