Home লাইফ স্টাইল সামাজিক অনুশাসন: ভাঙা-গড়ার টুকরো কথা

সামাজিক অনুশাসন: ভাঙা-গড়ার টুকরো কথা

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটা ঘটনার রাশ ধরেই শুরু করা যাক। গত কয়েকদিন আগে সম্ভবত ফ্রান্সের প্যারিসে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার নিউজ ছিল সেটা। ঘটনাটা অনেকটা এমন- মা থাকে অন্য কোথাও। পাঁচ বছরের সন্তানকে নিয়ে বাবা থাকে বাড়িতে। সেদিন সন্তানকে বাসায় রেখে বাবা শপিংয়ে যায়। এদিকে বাচ্চাটি খেলতে খেলতে হঠাৎ বহুতল ভবনের ছাদ থেকে পড়ে যায়। ভাগ্যক্রমে কীভাবে যেন পঞ্চম বা দ্বিতীয় তলার বেলকনীর ছাদ আকড়ে ধরে সে আটকে থাকে। তা দেখে বহিরাগত এক ব্যক্তি আশ্চর্যজনকভাবে ভবন বেয়ে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে।

এটি একটি সরস ঘটনা। অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা। কিন্তু ঘটনার পরবর্তি অংশটুকুই আমার মূল আলোচ্য বিষয়ের সংশ্লিষ্ট। যা শুনে হৃদয়ে ঘৃণার সৃষ্টি হয়। ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করে এই ভ্রষ্ট সমাজব্যবস্থাকে। পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বাসায় কেউ না থাকায় বিরক্ত বাচ্চাটি খেলতে খেলতে ছাদ থেকে যখন পড়ে যায়, কাণ্ডজ্ঞানহীন বাবা তখন শপিংমলে গেম খেলায় ব্যস্ত ছিল।

কী আজব! বাসায় পাঁচবছরেরর বাচ্চাকে একা রেখে গেম খেলায় মগ্ন! এই বাচ্চা যখন বড় হয়ে জানবে যে, তার বাবার অবহেলারর কারণে শিশুকালেই সে মরতে বসেছিল, বাবার প্রতি তার কী মনোভাব সৃষ্টি হবে?

সামাজিক বিজ্ঞানে কিশোর অপরাধ বিষয়ে একটি আর্টিক্যাল পড়েছিলাম। সেখানে কিশোর অপরাধের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে সমাজে বিদ্যমান হতাশা, নৈরাজ্য আর দরিদ্রতার কথা। শহরের দুষিত পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ, তাদের অবহেলা, শিশুশ্রম, অসৎ সঙ্গ, পারিবারিক অসম্প্রীতি, মা চাকুরীজীবী হওয়ায় পর্যাপ্ত যত্নের অভাব, বাবা-মায়ের পারস্পরিক বিরোধী মানসিকতা, অতিশাসন, অতিআদর, ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদির আলোচনাও করা হয়েছে কিছুটা।

কিন্তু আমার মনে হয়, বাবা-মায়ের অবহেলাই সন্তান বখে যাওয়ার প্রধানতম কারণ। বাবা-মা সন্তানের ব্যাপারে যত্নশীল হলে অন্যান্য সব সমস্যা কেটে ওঠা সম্ভব। অন্যথায় সবই বরবাদ। উল্লেখিত ঘটনা হল আলোচ্য বিষয়ের শুধু একটিমাত্র দিক। বাবা-মায়ের অবহেলায় সন্তান যদি নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সন্তান তাদের উপরে আস্থাহীন হয়ে পড়ে। আর এতেই সূচিত হয় সন্তান বখে যাওয়ার ঘৃণ্যচক্র।

পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে যেমন তার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে, তেমনি তার শিক্ষা-দীক্ষা, তার আবেগ-অনুভূতি, তার সঙ্গ-সাহচর্য এবং তার অভ্যাস-চরিত্র সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ে। বর্তমান আধুনিকতার যুগে হুমকিটা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে।

দেশের সচেতন মানুষরা সামাজিক অনুশাসনের বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত। বিশেষ করে তরুণ-যুবকদের নিয়ে এ বিষয়ের ভাবনাগুলো অন্তহীন। কেননা এখনকার তরুণরা কারো ধার ধারে না। যে যত বড়ই হোক তরুণদের কাছে তারা কিছুই না। যার বাস্তব প্রমাণ হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষত ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউব। এখানে বড়-ছোটর কোন ভেদাভেদ নেই। তরুণরা নিজের উচ্চতা না মেপেই বড়দের কলার ছুঁতে যায়। প্রবীণদের কোন কথার কানাকড়িও যেন মূল্য নেই। আর তাই দেখা যায়, অনেক প্রবীণ, অনেক সিনিয়র পার্সন এ জগত থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। কারণ এখানে বড়দের শাসন-অনুশাসন মান্য করা তো নেইই। এমন কী বড়দের সম্মানটুকুও তরুণদের কাছে নিগৃহীত, নিষ্পেষিত।

এর সূচনা কিন্তু বাবা-মায়ের কাছ থেকেই। কারণ বাবা-তার সন্তানের শাসন-অনুশাসনে সচেতন নন। তাদের খামখেয়ালীর কারণে সন্তান প্রথমে তাদের অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে। এরপর সমাজের সাথে মিশতে জানলে, সামাজিক অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে। সমাজের শাশ্বত নিয়ম ভেঙে তারা অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

সমাজের মদ ও মাদকতা, ত্রাস ও সন্ত্রাস এবং অন্যায়-অপকর্মে জড়িতদের জরিপ করলে দেখা যাবে, পরিবারের অবাধ্য সন্তানরাই পরবর্তিতে এসব অসামাজিক কাজে জড়িত। পারিবারিকভাবে অবহেলিত তরুণরাই হতাশার সাগরে ভাসতে ভাসতে অন্যায়ের দীপপুঞ্জ গড়ে তোলে।

সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট পরিবারকে সমাজের জন্মকোষ (germinal cell) হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ পরিবারই সমাজের মৌলিক উপাদান। এখানে মানবসন্তান যেভাবে গড়ে উঠবে সমাজ সেভাবেই পরিচালিত হবে।

বার্টসন বলেন, ‘সমাজের সদস্যরা সমাজ স্বীকৃত পন্থায় কাঙ্ক্ষিত আচরণ করবে, এমন নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াই হচ্ছে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ।’ আর এই ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়ার দায়িত্ব সর্বপ্রথম পরিবারেরই হয়ে থাকে। পরিবার নিয়ন্ত্রকারী পিতা-মাতা এক্ষেত্রে গাফলতি করলে পুরো সামাজিক নিয়ন্ত্রণই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। পক্ষান্তরে তাদের নিবিড় পরিচর্যা এবং ভালবাসাময় শাসনে সন্তানের মনোন বিকশিত হয়। মানবিক গুণাবলির উৎকৃষ্টতা তাকে উন্নত করে তোলে। যার ফলাফল হিসেবে সমাজ সুশৃঙ্খলভাবে চলতে থাকে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সন্তানরাই পরিবার-পরিবেশ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতির ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হয়। অন্যদেরকেও এতে উৎসাহ প্রদান করে।

সামাজিক অনুশাসন বিনষ্টের আরো একটি যুক্তিসংগত গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। বলতে গেলে শুধু সামাজিক অনুশাসন নয়, পৃথিবীর যাবতীয় শান্তি বিনষ্টের মূলেই রয়েছে সেই কারণটা। ধর্মের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্যশীল না হওয়া। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। আজ শুধু সারকথাটুকুই বলছি।

ধর্ম সামগ্রিকভাবে মানুষের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনে পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন পদ্ধতি। এ ছাড়া আর যতকিছু পরবর্তিতে এসেছে, তা মানুষের সামগ্রিক উৎকর্ষ সাধন করতে পারেনি।

মানুষকে সুশৃঙ্খল করতে পারেনি। আমরা কমবেশি সকলেই জানি, ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক যুগের কথা। তৎকালীন আরবরা ছিল পৃথিবীর অন্যতম নিকৃষ্ট জাতি। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এরা ছিল চরম বিপর্যস্ত। কিন্তু এক ইসলাম এসে তাদের পুরো চিত্রটাই পাল্টে দিয়েছে। যাদের মধ্যে একে-অপরকে সমীহ করে চলার বিন্দুমাত্র লেশ ছিল না, তারাই পরবর্তিতে সামাজিক নীতিমালার সামনে মাথা নত করে দিয়েছিল। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের দু’টি ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উমর (রাযি.) একবার তরবারী নিয়ে স্বীয় বোনকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে ইসলামের মর্মবাণী পবিত্র কুরআনের কথা শুনে তাঁর মাঝে আমূল পরিবর্তন চলে আসে। তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তরবারী জমা দেন, ধর্মের ছায়াতলে চলে আসেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য মেনে নেন।

প্রথম খলিফা হযরত আবু রাযি. ইস্তিকালের সময় তাঁকেই পরবর্তি খলিফা নিযুক্ত করার কথা ঘোষণা করেন। এতে কেউ কেউ এর বিরোধীতা করেন। হযরত উমর রাযি. এরও ইচ্ছে ছিল না খলিফা হবার। কিন্তু মুরুব্বির কথা তিনি ফেলতে পারেন না। সম্মত হয়ে যান। তাঁর খলিফা হওয়া নিয়ে অনেক কটু মন্তব্য করতে থাকে। তার রাগের সমালোচনা শুরু করে দেয়। কিন্তু তাঁর ধর্মীয় চেতনা তাকে বিগড়ে যেতে বাঁধা প্রদান করেরে। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে নত করে রাখেন। অথচ তাঁর ইসলামপূর্ব ইতিহাস কত ভয়ংকর ছিল তা সচেতন পাঠক সকলেরই জানা আছে।

এই যে তাঁর সমাজ মেনে চলা, সামাজিক প্রক্রিয়ায় শ্রদ্ধাশীল হওয়া, এটা ধর্মের অবদান। একজন মানুষ পিতা-মাতা, পরিবার ও সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে নৈতিক ও সামাজিকগুণাবলি থেকে বঞ্চিত হলেও, ধর্ম তাকে দিতে পারে উৎকৃষ্ট জীবনাচার। আবার ধর্মকে অবজ্ঞা করে কেউ যদি অধর্মে আশ্রিত হয় তাহলেও সে নিমজ্জিত হবে অনিয়ন্ত্রিত-অস্বাভাবিক জীবনে। কারণ আগেই বলেছি, ধর্মই কেবল সামগ্রিক আদর্শ বহন করে। অন্য সবকিছুতে রয়েছে স্থানে স্থানে, পদে পদে শূণ্যতা ও অপূর্ণতা।

তাই এ কথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, বর্তমানের সামাজিক অনুশাসন বিনষ্টের পেছনে ধর্মহীনতা, ধর্মীয় শিক্ষাহীনতা এবং ধর্মের প্রতি অবজ্ঞাও একটি বড় কারণ। যখনই আমাদের সন্তানরা বাবা-মায়ের উপযুক্ত তত্ত্বাবধান পাবে এবং সাথে সাথে সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত তখনি আমাদের সমাজ হবে আলোকিত এবং আলোচিত। আমাদের ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল এবং উন্নত।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী মাদরাসা, চট্টগ্রাম।