Home ওপিনিয়ন কর্ণাটকে কংগ্রেসের বিজয় বিজেপির জন্য যে বার্তা দিচ্ছে

কর্ণাটকে কংগ্রেসের বিজয় বিজেপির জন্য যে বার্তা দিচ্ছে

।। মনোয়ারুল হক ।।

দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস। ২০১৮ নির্বাচনে দক্ষিণ ভারতের এই রাজ্যে দাঁত বসিয়েছিল বিজেপি। কর্ণাটকের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ক্ষমতা থেকে দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্যেই বিদায় ঘটল বিজেপির।

২০১৪ সালে বিজেপির ক্ষমতায়নের পরে নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যেই ভারত থেকে কংগ্রেসকে বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর বেশ কিছু সাফল্যও অর্জন হয়েছিল এক্ষেত্রে। নানান কৌশলে বেশ কিছু রাজ্য থেকে কংগ্রেসকে বিলুপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। তার মধ্যে হলো অন্যতম পশ্চিমবাংলা। পশ্চিমবাংলার তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম কংগ্রেসের গর্ভ থেকেই, কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করেছে। নানানভাবে বিজেপিকে পশ্চিমবাংলায় প্রতিষ্ঠিত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।

বিজেপি যখন পশ্চিমবাংলায় তার অবস্থান তৈরি করতে পারছিল না, তখন তৃণমূল কংগ্রেসই প্রথম তাদেরকে উপনির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না দিয়ে বিজয়ী করেছিল বিজেপির দুই প্রার্থীকে।

কর্ণাটকে বিজেপির বিশাল পরাজয়ে প্রার্থী হাতানোর রাজনীতি যে কাজ করে, তা প্রমাণিত হলো। দুই দলেই প্রায় ৪০ জন প্রার্থী দল পরিবর্তন করেছে। তবে দল পরিবর্তনকারীদের মধ্যে কংগ্রেসে ফিরে আসা প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি।

কর্ণাটকের ফলাফলের ম্যাজিক ফিগার ১১৩-র অনেক উপরে কংগ্রেসের অবস্থান। কংগ্রেস দল জয়লাভ করেছে ১৩৬ আসনে, আর শরিক দল একটিতে; এই মিলিয়ে ১৩৭ । ভোটের শতাংশের হারে কংগ্রেস ভোট পেয়েছে ৪৯ শতাংশেরও বেশি। বিজেপির ভোট ৩৬ শতাংশে নেমেছে।

নির্বাচনের এই ফলাফল সর্বভারতীয় আঙ্গিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নেবেন আঞ্চলিক দলগুলো, সেই ধারণাই করা যাচ্ছে। এক সময়ের কংগ্রেস নেতা বর্তমানে মহারাষ্ট্রের এনসিপির সভাপতি শারদ পাওয়ারের টুইটে তাই লক্ষ্য করা যায়। বিহারের তেজস্বী যাদব একইভাবে টুইট করেছেন। শুধুমাত্র পশ্চিমবাংলার মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল নেতৃত্ব চুপ। অথচ নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং কংগ্রেসের বিজয়কে টুইট করে স্বাগত জানিয়েছেন।

এই নির্বাচনকে সামনে রেখে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একটানা বহু হাজার কিলোমিটার পথ পদ প্রদক্ষিণ করেছেন। কর্ণাটকে তিনি প্রায় ২২ দিন সময় কাটিয়েছেন ওই সময়।

বিজেপি কর্ণাটকের ফলাফল ধারণা করতে পেরেছিল নির্বাচনের আগেই। সেই লক্ষ্যেই তারা গুজরাটের এক বিচারকের উপর প্রভাব বিস্তার করে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা দিয়ে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করে রাহুল গান্ধীকে পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কার করায় বলা যায়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক রায় অনুসারে, দুই বছর অথবা তার থেকে বেশি সময় কেউ সাজা প্রাপ্ত হলে সে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হয়।

এদিকে, গুজরাটের যে বিচারপতি মানহানির মামলায় সর্বোচ্চ সাজা দুই বছর রাহুল গান্ধীকে প্রদান করেছিলেন, সেই বিচারককে পদোন্নতি দিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট নতুন কর্মস্থলে প্রেরণ করতে চাইলে এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। রাহুল গান্ধীকে সর্বোচ্চ সাজা প্রদানকারী বিচারকের পদোন্নতি এবং তার নতুন কর্মস্থল সংক্রান্ত ফাইল তলব করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নানান সময়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির কর্তৃত্ববাদীতার বিরুদ্ধে বেশকিছু শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টও এমন কিছু স্বাধীন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। তারই ফলশ্রুতিতে ইমরান খানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তানের বর্তমান সেনা সমর্থিত সরকার।

ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চ আদালত বেশ কিছু ক্ষেত্রেই সরকারের কর্তৃত্ববাদী সিদ্ধান্তের বিপক্ষে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা হ্রাস সংক্রান্ত একটি আইন পাস করেছে। ইতোমধ্যে সেই আইনের বিরুদ্ধে একটি রিট পিটিশন বৃহত্তর বেঞ্চে আলাদা শুনানির জন্য অপেক্ষায়।

ভারতের ক্ষেত্রেও এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা ঘটছে। পাকিস্তানের সংবিধান পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও প্রধান বিচারপতির পদ সুনিশ্চিত করেছে সংবিধানে প্রণীত নির্দেশ অনুসারে, আইনের মাধ্যমে। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির পদ সুস্পষ্টভাবে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত।

ভারতও দীর্ঘকাল যাবত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ তাদের দীর্ঘদিনের জোষ্ঠতা দ্বারা পরিচালিত। দেশ দুইটিতে এই মুহূর্তে বিচার বিভাগের শক্তিশালী অবস্থান অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাহী বিভাগের একক কর্তৃত্ববাদিতার হ্রাস টেনে ধরছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে কখনো মনে হচ্ছে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের উপর বেশি কর্তৃত্ববাদীতা করছে।

এবারের কর্ণাটক নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতাসীন বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর পরাজয় ঘটল। তার মধ্যে আইনমন্ত্রী আছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আছেন, আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও।

ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার উপর মানুষের একটি আস্থার জায়গার সৃষ্টি হয়েছে। কর্ণাটকের নির্বাচন পুরোপুরি ইভিএম ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু সেই ইভিএম এর উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ইভিএম মেশিন যখন ব্যবহার করা হবে ভোট প্রদানকারী ব্যক্তি একটি কাগজে তার প্রদত্ত মার্কা দেখতে পাবেন যা সংরক্ষিত থাকবে। পুনঃগণনার প্রয়োজনে সেই কাগজ থেকে মার্কাগুলোকে শনাক্ত করা যাবে। মিলিয়ে দেখা যাবে ইভিএম-এর ফলাফলের সাথে। এমনি একটি ইভিএম ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে সর্বভারতীয় আঙ্গিকে ইভিএম-এর বিতর্ক বিলুপ্ত হয়েছে ভারতে।

আরও পড়তে পারেন-

ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করে গেছেন সেশন নামক একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তার প্রদত্ত রিফর্ম কর্মসূচির মাধ্যমেই ভারত বর্তমানে বিতর্কহীন নির্বাচন পরিচালনা করতে পারছে। ওই নির্বাচন কমিশনারের সময়ই ভারতে ভোটার আইডি কার্ড চালু করা হয়েছিল। ওই সময়ই ভারতের নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত আইন সংস্কার করে নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন করা হয়েছিল। ফলে নির্বাচন কমিশন যদি কোনো কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা লক্ষ্য করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যা তাদের একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার পথকে সুনিশ্চিত করেছে।

ভারতের প্রায় সারা বছর ধরেই নানান স্তরের নির্বাচন চলছে সে নির্বাচনগুলো নিয়ে কোন ধরনের বিতর্ক খুব একটা দেখা যায় না। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের সময়ও সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নটি সামনে আসে না। নরেন্দ্র মোদি ও তার দলই ক্ষমতায় থাকবে যখন জাতীয় নির্বাচন হবে। জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থার ফলে সে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

বছরের শেষে ভারতের আরো কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন হবে। তার মধ্যে আছে রাজস্থান। যেখানে কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে প্রচণ্ড গোলযোগ আছে। কর্ণাটকের নেতৃত্বের মধ্যেও বিভেদ ছিল, রাহুল গান্ধীর পদযাত্রার সময় সেই গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের অনেকটাই অবসান ঘটে। রাজস্থানসহ অন্য রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের যে বিভাজন, তা কর্ণাটকের এই বিজয়ের পরে কোনদিকে যায় তাও গুরুত্ব সহকারে খেয়াল করার বিষয়।

কর্ণাটকের এই বিজয় কি রাহুল গান্ধীর পদযাত্রা না-কি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রদেশের নেতৃত্বের উপর আস্তার ফল! না-কি প্রদেশ নেতৃত্বের উপর হস্তক্ষেপ কমিয়ে আনার ফল।

বিজেপি পুরোপুরি মোদির নির্ভরশীলতায় চলছে। বেশ কিছু সময় ধরেই যে সমস্ত রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছিল সেই রাজ্যগুলোর নেতৃত্ব তেমন গুরুত্ব পাচ্ছিল না। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা মূলত প্রচারের সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দলীয় সভাপতি তারাই মোটামুটি প্রচার কার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কর্ণাটকের এই বিজয়ে কংগ্রেসের নতুন মাত্রা যোগ হলো। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কর্তৃত্ববোধিতার বাইরে প্রদেশ কংগ্রেস কর্ণাটক নির্বাচনের যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। আগামীতে হয়তো বিজেপিও এ পথে হাঁটবে, নরেন্দ্র মোদির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার উপলব্ধি হবে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।