Home ইসলাম ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা

ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা

।। মাওলানা তাজুল ইসলাম আশরাফী ।।

মহান আল্লাহ পাক মানুষকে কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে যত পন্থা আছে, সবগুলো থেকে নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখতে আদেশ করেছেন ।

ব্যভিচার, পুংমৈথুন, দুই নারীর পারস্পরিক ঘর্ষণ যাতে কামভাব পূর্ণ হয়, হস্তমৈথুন ইত্যাদি সবগুলো অবৈধ ও হারাম কর্মের অন্তর্ভুক্ত। একজন পুরুষ একজন নারীর সাথে কামপ্রবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়ার প্রথম ও প্রারম্ভিক কারণ হচ্ছে দৃষ্টিপাত করা ও দেখা যার সর্বশেষ পরিণতি হয় ব্যভিচার।

তাবারানী রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণনা নকল করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন- النظر سهم من سهام إبليس مسموم من تركها مخافاي ابدلته إيمانا يجد حلاوته في قلبه

অর্থাৎ- দৃষ্টিপাত শয়তানের একটি বিষাক্ত শর । যে ব্যক্তি মনের চাহিদা সত্ত্বেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, আমি তার পরিবর্তে তাকে সুদৃঢ় ঈমান দান করব, যার মিষ্টতা সে অন্তরে অনুভব করবে।

যিনা ও ধর্ষণের পরিচয়

যিনা বা ব্যভিচার বলতে বুঝায় ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক বিবাহ বন্ধন ছাড়া অবৈধ পন্থায় যৌন তৃপ্তি লাভ করাকে। তাই বিবাহবহির্ভূত যে কোনো যৌনচার, সঙ্গম বা অপরাধকে “যিনা” বা ব্যভিচার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ধর্ষণ এটাও এক ধরনের যৌন আক্রমণ। সাধারণত একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনো ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়।ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে।

যিনা বা ধর্ষণের হুকুম

যিনা-ব্যভিচার বা ধর্ষণ সুস্পষ্ট হারাম ও নিন্দনীয় অপরাধ। তাছাড়াও, পুংমৈথুন, দুই নারীর পারস্পরিক ঘর্ষণ যাতে কামভাব পূর্ণ হয়, হস্তমৈথুন ইত্যাদি সবগুলো অবৈধ ও হারাম কর্মের অন্তর্ভুক্ত।মহান আল্লাহ্ পাক বলেন, “আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ”। (বণী ইসরাইল- ৩২)।

যিনা বা ধর্ষণের কারণ

যিনা ও ধর্ষন এমন একটি বৃহৎ অপরাধ; তদুপরি সে নিজের সাথে আরো শতশত অপরাধ নিয়ে আসে এবং সমগ্র মানবতার ধ্বংসের আকারে এর ফলাফল প্রকাশ পায়।

পৃথিবীতে যত হত্যা ও লুণ্ঠনের ঘটনাবলি সংঘটিত হয় অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ ঘটনার কারণ কোনো নারী ও তার সাথে অবৈধ সম্পর্ক। এমনকি নারী নির্যাতনের জঘন্যতম মাধ্যম হচ্ছে দেহ ব্যবসা।বর্তমান আবাসিক হোটেল, স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্রাবাস বা ক্যাম্পাসে চলছে ছেলে মেয়েদের যৌন চাহিদা পূরণের রমরমা দেহ ব্যবসা । লাঞ্ছিত ও সতীত্ব নষ্ট করা হচ্ছে পিতা-মাতার স্নেহের কন্যা সন্তানদের।

চরিত্রের উপর ব্যভিচারের অভিযোগ নিয়ে সোনার ছেলেরা তাদের পিতা মাতার কাছে ফিরতেছন । অথচ এব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হল “তোমাদের অধীনস্তদের তোমরা অবৈধ বৃত্তিতে (দেহব্যবসায়) বাধ্য কর না… ”। (সূরা নূর- ৩৩)।

কোন ব্যক্তির কন্যা, ভাগিনী ও স্ত্রীর উপর হাত রাখা তাকে ধ্বংস করার নামান্তর । সম্ভ্রান্ত মানুষের কাছে ধন-সম্পদ, সহায়-সম্পত্তি ও নিজের সর্বস্ব কুরবানি করা ততটুকু কঠিন নয় যতটুকু কঠিন তার অন্দর মহলের উপর হাত রাখা ।

এ কারণেই দুনিয়াতে প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয় যে, যাদের অন্দরমহলের উপর হাত রাখা হয়, তারা জীবনপণ করে ব্যভিচারীর প্রাণ সংহার করতে উদ্যত হয় এবং এই প্রতিশোধস্পৃহা বংশের পর বংশকে বরবাদ করে দেয়।

যে সম্প্রদায়ে ব্যভিচার ব্যাপক আকার ধারণ করে, সেখানে কারো বংশই সংরক্ষিত থাকে না । চিন্তা করলে দেখা যায় যে, জগতের যেখানেই অশান্তি ও অনর্থ দেখা দেয়, তার অধিকাংশ কারণই নারী এবং অর্থ সম্পদ । তবে অর্থ সম্পদের চেয়ে নারীর কারণে সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি থাকে।তাছাড়াও অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা নারী নির্যাতনের অনুঘটক। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মতো নব্বই শতাংশ মুসলিম অধিবাসীর দেশ বাংলাদেশে আজ নারীর ইজ্জত সম্ভ্রম নিরাপদ নেই।

আরও পড়তে পারেন-

প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীরা বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছেন । নারীর সতীত্বের উপর মানুষরূপী পশুদের আক্রমণ হচ্ছে। অনেক নারীরা বখাটের দ্বারা তাদের সতীত্বের আঘাতকে মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন । এসবের মূল হচ্ছে পর্দার বিধান যথাযথ নিয়ম ও ব্যবস্থাপনায় মেনে না চলা।অথচ ইসলামে ‘পর্দা’ একটি সার্বক্ষণিক বিধান। যা পালন করা আবশ্যক । পর্দা পালনের প্রতি অধিকাংশ মুসলিম নারীরা একেবারেই অনাগ্রহী । অথচ পর্দার মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকে নারীর ইজ্জত আর সম্মান ।

নারীরা পর্দাহীন হয়ে নিজের দৈহিক সৌন্দর্য প্রকাশ করতে যখন আধুনিকা হতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চায়, তখন তো বখাটেদের কুদৃষ্টি তাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হবে ।

এক পলকে পর্দাহীন নারীকে একটু দেখায় অনেকটুকু অশ্লীলতা ও নিন্দনীয় অপরাধের জন্ম হয়। এজন্যই ‘চোখের হেফাজত’ বা দৃষ্টির সংযম খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহর নির্দেশ “হে রাসুল (সা.) মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে… নারীগণ যেন নিজেদের দৃষ্টিকে নত রাখে ও নিজের গুপ্তাঙ্গ হেফাজত করে এবং নিজেদের সাজসজ্জা অন্যদের প্রদর্শন না করে”। (সূরা নূর- ৩০, ৩১)।

শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহর কঠোর হুঁশিয়ারি, “যারা ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার বিস্তারে উৎসাহী তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি”। (সূরা নূর- ১৯)।

তবে প্রয়োজনের তাগিদে যদি নারীকে ঘর থেকে বের হতে হয় তাহলে সে কীভাবে বের হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন, যা মানলে নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হবে না।

অর্থ: হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে এবং মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে এবং তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। (সূরা আহযাব- ৫৯)।

যিনা বা ধর্ষণের শাস্তি

ইসলাম ধর্মে মানবিক অপরাধসমূহের যেসব শাস্তি কুরআনে নির্ধারিত রয়েছে, তন্মধ্যে ব্যভিচার ও ধর্ষণের শাস্তি সবচেয়ে কঠোর ও অধিক।

যিনাকারী মহিলা পুরুষ যদি বিবাহিত হয় এবং তাদের এ কু-কাজের চারজন সাক্ষী থাকে এবং দেশে ইসলামী হুকুমত চালু থাকে, তাহলে শরয়ী বিধান হল তাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে একশত বেত্রাঘাত করা । (ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়া- ৬/২৭৫, রাহমানিয়া- ২/২৮৪)।

মহান আল্লাহ্ বলেন, “ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে”। (সূরা নূর- ২ আয়াত)।

উল্লেখ্য যে; এ বিধান কার্যকর অধিকার রয়েছে একমাত্র রাষ্ট্রের । ব্যক্তিগত বা সামাজিক উদ্যোগে এ শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না ।

ধর্ষিতার করণীয়

কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে তার সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সম্ভব হলে তা প্রতিরোধ করা। এমনকি যদিও তা ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে।উল্লেখ্য যে, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে ধর্ষণের কারণে অভিযুক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তার কোনো পাপ নেই। কেননা ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বল প্রয়োগ করা হয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বল প্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস- ২০৪৫)

যিনা ও ধর্ষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে করণীয়

এ অভিশপ্ত অপরাধ নির্মূলের জন্য ইসলাম অনেক ব্যাবস্থা পত্র দিয়েছে। নিম্নে তার কিয়দাংশ উল্লেখ করা হলো-

(১)তাকওয় অর্জনের মাধ্যমে সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখার প্রচেষ্টা। (২)পর্দা রক্ষা করে চলার নির্দেশ দিয়ে। (৩)লজ্জাবোধের নির্দেশ দিয়ে। (৪)দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়ে। (৫)জাহেলী যুগের ন্যায় উগ্র পোশাকে চলাফেরা না করার নির্দেশ দিয়ে। (৬)দেহাবয়বের সৌন্দর্য প্রকাশ না করার নির্দেশ দিয়ে। (৭)নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বর্জনের নির্দেশ দিয়ে। (৮)সহশিক্ষার পদ্ধতি পরিহার করার বিধান আরোপ করে। (৯)কোন পুরুষের সাথে একান্ত সাক্ষাতের ব্যাপারে নিষাধাগ্ঞা আরোপ করে। যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করে এমন বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়ে। (১০) শাস্তিদানে কঠোরতার মাধ্যমে।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে এসব গর্হিত কাজ থেকে সুরক্ষা করত: যিনা ব্যভিচার মুক্ত শান্তির সমাজ দান করুন । আমীন।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।