Home ওপিনিয়ন পাকিস্তানের রাজনীতি কী পথ হারাচ্ছে

পাকিস্তানের রাজনীতি কী পথ হারাচ্ছে

- উম্মাহ গ্রাফিক্স।

।। ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ।।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেফতারকে বেআইনি ঘোষণা করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। সেই সঙ্গে অবিলম্বে তাকে মুক্তির নির্দেশ দেয়া হয়। গত শুক্রবার ইসলামাবাদ হাইকোর্ট তাকে দুই সপ্তাহের জামিন দিয়েছেন।

১১ মে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে ইমরান খানের গ্রেফতারের বৈধতা নিয়ে আবেদনের শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ শুনানির একপর্যায়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ইমরান খানকে হাজির করার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী ইমরানকে হাজির করা হয়। পরে সুপ্রিম কোর্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের গ্রেফতারকে বেআইনি ঘোষণা করে অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন। আদালত চত্বর থেকে কীভাবে একজনকে গ্রেফতার করা যায়, প্রশ্ন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ইমরান খানের গ্রেফতারের পর গোটা পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে। করাচি, লাহোর, কোয়েটা, মুলতান, গুজরানওয়ালা, পেশাওয়ার ও খায়বার পাখতুনখোয়ার রাস্তায় জনগণ নেমে আসে। লাহোর ও ইসলামাবাদের সেনানিবাসে বিক্ষুব্ধ মানুষ হামলা চালিয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা লাহোরে এক সেনা অধিনায়কের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনাকে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের ক্ষুব্ধতার প্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। পেশাওয়ারে রেডিও পাকিস্তানের ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সরকার বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। স্কুল, মুঠোফোন ও ইন্টারনেটসেবা বন্ধ করে দেয়। মিডিয়া অফিসগুলোতে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দাদের তৎপরতা। সংঘর্ষের ঘটনায় ৯ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন আহত হয়েছে কয়েক হাজার। আটক করা হয়েছে প্রায় দুই হাজার বিক্ষোভকারীকে।

ওয়াশিংটন ডিসি ও লন্ডনে ইমরানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। পাকিস্তানের প্রাদেশিক শহরগুলোতে সেনা সদস্য নামানো হয়েছে। জনগণ ও সেনাবাহিনী এখন মুখোমুখি। এক কথায় পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রাজনীতি অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়াচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার অজুহাত খুঁজে পাবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সঙ্কট দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান। সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিকভাবে আরো কোণঠাসা হবে পাকিস্তান।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের নামে মামলা-হামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, নির্বাসন, গুপ্তহত্যা এমনকি ফাঁসি দেয়ার ঘটনা আছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হয় তা নজিরবিহীন। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, আদালত চত্বর থেকে কাউকে আটক করার সুযোগ নেই।

ভিডিওফুটেজে দেখা যায়, তাকে ঠেলাঠেলি ও টানাহেঁচড়া করে আধা সামরিক বাহিনী রেঞ্জারের গাড়িতে তোলা হয়। তার আইনজীবী সংবাদকর্মীদের বলেন, ইমরান খানের পায়ে ও কপালে তিনি আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। এ মুহূর্তে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক ইমরান খান। লাহোর হাইকোর্টে হাজিরা দেয়ার আগ মুহূর্তে এক ভিডিওবার্তায় তিনি গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। আমি যা করেছি জনকল্যাণে করেছি। দেশের আইনি কাঠামো মেনে আমার সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট থাকলে আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করে আমি আদালতে হাজি হবো এবং প্রয়োজনে জেলে যাবো।’ তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত।

আরও পড়তে পারেন-

ন্যাশনাল একাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর দায়ের করা মামলায় তাকে আটদিনের রিমান্ডে আনা হয়েছিল। পুলিশের হেফাজতে যে স্থানে তাকে রাখা হয় সেখানে অস্থায়ী আদালত বসিয়ে তার বিচার করা হচ্ছিল। বিদেশী মিডিয়ায় খবর এসেছে যে, ইমরান খান আদালতকে বলেছেন, পুলিশ হেফাজতে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করছেন এবং ইঞ্জেকশন পুশ করে তাকে মেরা ফেলা হবে। ‘ওরা হয়তো আমাকে মকসুদ চাপরাশির মতো খুন করবে। সেই ভয়টাই পাচ্ছি।’

বর্তমান পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক তছরুপ মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন মকসুদ চাপরাশি। আচমকাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। এর পরই শাহবাজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে চাপরাশিকে হত্যার অভিযোগ তোলেন ইমরান। ২০২২ সালে আস্থাভোটে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে একশ’টি মামলা দায়ের করা হয়। একটা মামলায়ও যদি তার সাজা হয় তাহলে তিনি জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হবেন। এভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল।

ইমরান খানের গ্রেফতার এবং জামিনে মুক্তির ঘটনা এমন একসময়ে ঘটল যখন পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়। ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে মুদ্রার মূল্যমানের রেকর্ডপতন, জ্বালানি তেলের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি ও নিত্যপণ্যের অস্থিরবাজারে মানুষ দিশেহারা। বিপুল মানুষ এখনো গত বছরের বিধ্বংসী বন্যার ক্ষতির কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আইএমএফের সংস্কার শর্তে সম্মত না হওয়ায় এক বিলিয়ন ডলারের ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করা যায়নি। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, পেট্রোলিয়াম ও বিদ্যুতের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু এ শর্ত মেনে নেয়া পাকিস্তানের জন্য কঠিন।

বিশ্নেষকরা বলছেন, আইএমএফের দাবিগুলো সরকার পূরণ করলে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের জন্য তা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যা। এ সরকার ক্রমে অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে তাদের প্রতিদ্ব›দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

দেশটির বার্ষিক রফতানি আয় এখনো ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে অথচ আমদানি ব্যয় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতি বছর। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতি বছর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বর অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৪৭ নম্বরে। সেই সঙ্গে রিজার্ভ কমতে কমতে ৪.৩ বিলিয়নে ঠেকেছে; যা বিগত নয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এ রিজার্ভ দিয়ে তিন সপ্তাহের মতো আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বৈদেশিক লেনদেনে বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে। রফতানি এবং বিভিন্ন খাত থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে ব্যয় সঙ্কুলান সম্ভব হচ্ছে না। এতে জ্বালানি তেল কেনা পাকিস্তানের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ সঙ্কটে মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমানোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার।

দেশটির জিও টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বেতন ১৫ শতাংশ কমানো এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১০ শতাংশ কমানো এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্য সংখ্যা ৩০ জনে নামিয়ে আনা হতে পারে। বর্তমানে দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য সংখ্যা ৭৮। ইমরানের আটক-মুক্তির ঘটনায় পাকিস্তানে হু হু করে পড়তে থাকে রুপির দাম। এই পর্যন্ত পাকিস্তানি রুপির দাম পড়েছে ১.৩ শতাংশ। এক মার্কিন ডলারের দাম ২৮৮ পাক টাকা ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া পাক বন্ডের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে ০.৪ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মঈনুল ইসলাম মনে করেন, পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন ও সৌদি আরবও এখন আর দেশটির দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। চীনা অর্থে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কিস্তির টাকা বহুদিন ধরে পরিশোধ না করায় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চীন। যার কারণে গোটা পাকিস্তানে ভয়াবহ লোডশেডিংসহ প্রায়ই বিদ্যুৎ বিপর্যয় হচ্ছে। নাটকীয়ভাবে দাম বেড়ে ১ ডলার এখন ২৭৭ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে এখন এক কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি এবং এক কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। সাড়ে পাঁচ লাখের সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্রবাহিনীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। কিন্তু জন্মশত্রু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এতবড় সেনাবাহিনী পুষতে হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে নানা সময়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতলগত হয়ে গিয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭১-২০২৩ পর্বেও পাকিস্তানের শাসকের ভূমিকা থেকে সামরিক বাহিনীকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি না। কিছু দিন পরপর সামরিক একনায়করা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করছে। কখনো সিভিলিয়ান শাসকদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিয়ন্ত্রণে রেখে দিচ্ছে তারা। বর্তমান পর্বে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা থেকে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কলকাঠিই দেখা যাচ্ছে। ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান সরকারের বাজেটের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিরক্ষা খাত, যেখান থেকে গত ৭৫ বছরেও ওই খাতকে সরানো যায়নি। এ অসহনীয় বোঝা যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সে সত্য চূড়ান্তভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যা এখন সাড়ে ২২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এত বড় সশস্ত্রবাহিনীর খায়েশ মেটানোর পর এত বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দেয়া কোনোমতে পাকিস্তানের কোনো শাসক দল বা জোটের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না (প্রথম আলো, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)।

রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিশ্লেষক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রের ডিস্টিংগুইশড ফেলো সুজা নওয়াজ Pakistan on the brink of economic collapse শীর্ষক নিবন্ধে অভিমত ব্যক্ত করেন, ২০২৩ সালের মার্চে গরিবদের জন্য জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার। কিন্তু দেশটিতে রাজস্ব ও জ্বালানির যে ঘাটতি, তাতে করে সেটা বাস্তবায়ন অনেকটা জটিল। ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল, আর মার্চ মাসে তা আরো বেড়ে ৩৫ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়। ১৯৭৪ সালের পর এ মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ। খাদ্য কিনতে মোট আয়ের অর্ধেকটা যাদের ব্যয় করতে হয়, তাদের জন্য মূল্যস্ফীতি মানে হলো কর নেওয়া। আবার রফতানি পণ্যের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হলে আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি ভিত্তি হারিয়েছে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে ডলার পাচার উৎসাহিত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বর্তমান ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের পেছনে আশ্রয় খুঁজছেন। ইমরান খান তাকে পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করেছিলেন। পুনরায় নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শরিফ চান ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে নিতে। কিন্তু রাজপথে যে আন্দোলন চলমান আর মূল্যস্ফীতির কারণে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, তাতে করে শাহবাজ শরিফ তার নড়বড়ে জোট সরকার তত দিন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। মার্চ মাসের মতো এপ্রিল ও মে মাসে সেনাবাহিনীকে সরকার পাশে রাখতে পারলেও- এ দু’টি মাস পাকিস্তানের জন্য নিষ্ঠুরতম মাস হতে চলেছে। সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতা দখল করতে পারে কিংবা ইমরান খানকে দিয়ে আরেকটি ভঙ্গুর সরকার গঠনের দিকে এগোতে পারে। অর্থনৈতিক বিপদে পড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও জনগণের সামনে ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই (এশিয়া টাইমস, ৬ এপ্রিল, ২০২৩)।

২০১৮ সালে ভোটে জিতে ইমরান খান যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল মধুর। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, সেনাবাহিনী সাহায্য নিয়ে তিনি সেবার বিজয়ী হন। কিন্তু চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে একটা পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয়। যখন বুঝতে পারেন, তিনি সেনাবাহিনীর ক্রীড়নকে পরিণত হতে যাচ্ছেন তখন ইউটার্ন নিতে বাধ্য হন। পাকিস্তানে সেনাশাসন আসুক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা কামনা করে না। এ দিকে পাকিস্তানের অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। তারা সংযম প্রদর্শন এবং আইনের শাসন বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছে। স্বতন্ত্র মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রীতিকে অবমাননা করার জন্য বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করেছে।

বিবিসি, ডয়চে ভেলে, দি ডন এর আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ চলমান আদালতের লড়াই বিচার বিভাগকে বিভক্ত করেছে। কয়েকজন বিচারকের বিরুদ্ধে সরকার ইমরান খানের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে। বিচার বিভাগে এ বিভাজন এবং তীব্র মতবিরোধ সাংবিধানিক সঙ্কটের শঙ্কা তৈরি করছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধ আরো বাড়বে। বিচার ব্যবস্থা, রাজনীতি ও সাংবিধানিক সঙ্কট আরো জোরালো হবে অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতার কারণে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো মাদিহা আফজাল সতর্ক করে বলছেন, আমি দেখছি এই সঙ্কট গভীর হচ্ছে। এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুব কঠিন হবে। সেনাবাহিনী, আইনসভা ও বেসামরিক সরকার ও বিচারব্যবস্থা-সবাই কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী ও বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকরণ ও মেরুকরণ হয়ে পড়েছে। জনগণের আস্থা নেই তাদের প্রতি। তারা পাকিস্তানকে এই সঙ্কট থেকে টেনে তুলতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সাংবিধানিক ভূমিকার মধ্যে কাজ করতে হবে এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে।

রাজনীতিকরা একসঙ্গে বসে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা না করলে অতীতের মতো বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এবার মেরুকরণ চূড়ান্ত খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। সামরিক-বিচারিক সংযোগের ফলে যে ভুলগুলো হয়েছে তার প্রতিকারের প্রয়োজন এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজন। সম্পূর্ণ নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে যেতে না চাইলে নির্বাচন আয়োজনে বিলম্ব করা উচিত হবে না।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক। ইমেইল- drkhalid09@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।