Home ফিকহ ও মাসায়েল ইসলামে কনে দেখার গুরুত্ব ও নিয়ম

ইসলামে কনে দেখার গুরুত্ব ও নিয়ম

।। মুফতি পিয়ার মাহমুদ ।।

বিয়ে-শাদীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো পাত্র-পাত্রী নির্বাচন। দাম্পত্য জীবনের পরিধি যেমন অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত এর সমস্যাও তেমন খুব বিস্তৃত জটিল ও স্পর্শকাতর। এজন্য বিয়ের পূর্বেই পাত্র-পাত্রী দেখে সকল দিক গভীর ভাবে তলিয়ে দেখা জরুরী। যেন পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত কোনো সমস্য দাম্পত্য জীবনকে দুর্বিষহ করে না তুলে। এজন্য ইসলাম এর প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে।

সাহাবী আবু হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল, আমি একজন আনসারী রমনীকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। একথা শুনে মহানবী সা. বললেন মেয়েটিকে দেখে নাও। কেননা আনসারীদের চোখে আবার সমস্যা থাকে।দ (মুসলিমঃ হাদীস:১৪২৪)।

অন্য এক হাদীসে সাহাবী হযরত জাবির রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- তোমাদের কেউ যদি কোন নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তার জন্য যদি বিয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী অঙ্গগুলো দেখার সুযোগ হয়, তাহলে সে যেন সে অঙ্গগুলো দেখে নেয়।(আবু দাউদ:১/২৮৪, হাদীস ২০৮২)।

অন্য বর্ণনায় আছে –হযরত মুগিরা বিন শোবা রা. বলেন, “আমি জনৈক নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, তুমি কি তাকে দেখেছ? আমি বললাম না, দেখিনি। তখন তিনি নির্দেশ দিলেন যে, তুমি তাকে দেখে নাও। তোমার এই দর্শন তোমাদের মাঝে দাম্পত্য জীবনে প্রণয়-ভালবাসা গভীর হবার বড় সহায়ক হবে।” (তিরমিযী:১/২০৭, হাদীস:১০৮৭ )।

উপরোক্ত হাদীসগুলোর ভাষ্য এক ও অভিন্ন । সেটি হচ্ছে, বিয়ের পূর্বে বরের কনেকে দেখা নেওয়া। তো মেয়ে দেখার শরীআত সম্মত নিয়ম হলো, দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দিয়ে আনুষাঙ্গিক সকল বিষয় প্রথমে দেখে নিবে। মন:পুত হলে বিয়ের ইরাদা নিয়ে যথা সম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করে মেয়ের মুখ ও উভয় হাত দেখে নিবে। বর ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের জন্য কনে দেখা শরীআতে নিষিদ্ধ। চাই সে বরের পিতা বা অন্য ঘনিষ্ট আত্মীয় হোক না কেন। তাদের কেউ বরের পক্ষ হয়ে কনে দেখলে কবীরা গুনাহ হবে।

সুতরাং আমাদের দেশে বাবা, ভাই, বন্ধু-বান্ধব মিলে ঘটা করে মেয়ে দেখার যে প্রচলন চালু আছে তা শরীআতের দৃষ্টিতে নাজায়িয ও হারাম। পুরুষ সদস্য বাদ দিয়ে শুধু নারী সদস্য নিয়েও ঘটা করে মেয়ে দেখা শরীআত সম্মত নয়। কেননা এভাবে ঘটা করে কনে দেখার পর যদি কোন কারণবশত: বিয়ে না হয় তাহলে এটা ঐ মেয়ে পক্ষের জন্য রীতিমত বিপদ হয়ে দাড়ায়। পরবর্তী সময়ে অন্যরা মেয়ের ব্যাপারে নানা রকম সন্দেহের মধ্যে পড়ে। ফলে এই মেয়ের বিয়ে দেওয়া কঠিন কাজ হয়ে দাড়ায়। আর কোন মানুষকে এভাবে বিপদে ফেলা ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছে। (বুখারী:২/৭৬৮; মুসলিম:১/৪৫৬; আবু দাউদ; ১/২৮৪; তিরমিযী;১/২০৭; ফাতওয়া-মাহমুদিয়া:৩/২১২)।

কনে দেখার ক্ষেত্রে কেবল মাত্র কনের হাত ও মুখই দেখা যেতে পারে। অবশ্য কাপড়ের উপর দিয়ে যদি শরীরের সামগ্রিক অবয়ব দেখে নেওয়া হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। কেবল মাত্র বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কনে দেখতে পারবে। এছাড়া নয়। বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কনে দেখার সময় যদি কামউত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তাতেও কোনো আপত্তি নেই। কেননা এটা তো শরীআত অনুমোদিত একটি প্রয়োজন। (হিদায়া:৪/৪৪৩; আলমুগনী:৭/৭৪)।

আর যদি মেয়েরা কনে দেখে তাহলে প্রয়োজনে শরীআতের সাধারণ রীতি অনুযায়ী নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত স্থানটুকু বাদ দিয়ে অবশিষ্ট পূর্ণ শরীর দেখতে পারবে।( টিকা: আবু দাউদ:২/২৮৪)।

এজন্যই কোনো অঙ্গ সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিলে নির্ভরযোগ্য কোনো নারীর মাধ্যমে তা যাচাই করে নিতে পারবে। পাত্রী দেখার জন্য পাত্রীর অভিভাবকগণের পূর্ব অনুমতি জরুরী নয়। কোনরূপ ঘোষনা ছাড়া কনে কিংবা কনের অভিভাবকদের অলক্ষ্যে যদি দেখে নেয় তাতেও অসুবিধা নেই। বরং বিভিন্ন রেওয়াত ও নীতিমালার আলোকে মনে হয় অঘোষিত ও গোপনীয়তভাবে দেখাটাই অধিক সঙ্গত। যেমন সাহাবী জাবের রা. এর বর্ণনায় এসেছে, “ আমি একটি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পর তাকে লুকিয়ে দেখে নেই।” (আবু দাউদ:১/২৮৪, হাদীস ২০৮২)।

এটা হলো কনে দেখার ইসলামের সোনালী দর্শন। যা অত্যান্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এতে না আছে বাড়াবাড়ি, না আছে ছাড়াছাড়ি । এই দর্শন ও নীতিমালা মেনে কনে দেখলে মেয়ে পক্ষও আপদমুক্ত থাকল আবার ছেলে পক্ষরও কনে দেখার ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলোনা। পক্ষান্তরে পশ্চিমা সভ্যতা এক্ষেত্রে করেছে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। তুলেছে এক নষ্ট স্লোগান।

আরও পড়তে পারেন-

এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হলো, বিয়ের পূর্বেই ছেলে-মেয়ে এক ছাদের নীচে এক সাথে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে। একে অপরের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ ও ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এভাবে সহ অবস্থান ও ঘনিষ্টতার ভিতর দিয়ে একে অপরকে জানবে-বুঝবে। এরপর নিবে বিয়ের সিদ্ধান্ত। এতে ফল যা হবার তাই হয়েছে। এক ছাদের নীচে পার করল দীর্ঘদিন। মধু বিতরণকারী নারী মধু বিতরণ করল আর চুষে চুষে খেল মধুলোভী পুরুষ।

এভাবে চলল বেশ কিছুদিন । এরপর কোনো একজন বলে উঠলো তোমাকে আমার ভাল লাগে নি। ব্যস ! সব ল্যাঠা চুকে গেল। তখন পাড়ী জমালো আরেক পুরুষের বাহুতলে। এভাবে একদিন তার যৌবনের মধুর হাড়ি খালী হয়ে গেল। মধু সন্ধানীরাও তার থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখল। এখন কি করবে এই নারী ? এই জীবনে তো আশ্রয়দানের মত এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই। কে তাকে আশ্রয় দিবে? আদর-সোহাগের হাত আলতু করে বুলিয়ে দিবে তার গায়ে ? পাঠক ! একবার ভেবে দেখুন, অবস্থার ভয়াবহতার গভীরে গিয়ে।

আর চিন্তা করুন নিজেকে দিয়ে যদি আপনার এই করুণ দশা হয়, তাহলে কেমন হবে? এজন্যই ইসলাম পশ্চিমা নষ্ট সভ্যতার এই নির্লজ্জ ও জঘন্য চিন্তাকে নিষিদ্ধ করেছে কঠোর ভাবে এবং বলেছে এটি জঘন্যতম অপরাধ। (সূরা নূর:২; বুখারী:২/১০০৬-১০০৯; মুসলিম:২/৬৫; তিরমিযী: ১/২৬৪-২৬৫)।

পক্ষান্তরে উপমহাদেশীয় কালচার অনেকটা এমন, কনে দেখবে ছেলের অভিভাবকরা। ছেলে কনেকে দেখলে দোষের মনে করা হয়। এই চিন্তাও ভুল। কারণ কনে দেখা সংক্রান্ত হাদীসগুলোতে বরকেই কনে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখানে অভিভাবকদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তাছাড়া বর কনেকে না দেখে শুধুমাত্র অভিভাবগণ দেখে বিয়ে সম্পাদন করলে বরের কনেকে পছন্দ নাও হতে পারে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে দাম্পত্য জীবনে সৃষ্টি হয় অশান্তি। যার নযীর আমাদের সমাজে নেহায়ত কমও নয়। তাই বর কনেকে দেখা নেওয়াটাই অধিক সঙ্গত ও নিরাপদ।

লেখক: ইমাম ও খতীব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনারপাড়, মোমেনশাহী।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।