Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ডেনিশ মিডিয়ায় ইসলামোফোবিয়া ও একজন জোরাম ভ্যান

ডেনিশ মিডিয়ায় ইসলামোফোবিয়া ও একজন জোরাম ভ্যান

।। মুসা আল হাফিজ ।।

আইনজীবী ও রাজনীতিক রাসমুস পালুদানের জন্ম ১৯৮২ সালে। ডেনমার্কের উত্তর জিল্যান্ডের হর্নবেকে জন্ম তার। তারুণ্যের প্রথম প্রহরে ইসলামী মৌলবাদ, মুসলিম সন্ত্রাস ইত্যাদি আতঙ্কের সাথে পরিচয় হয় তার। বাস্তব জীবনে নয়, মিডিয়ায়। মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং ইউরোপের সমাজ-সংস্কৃতির জন্য মুসলিমরা একটা হুমকি, এই অনুভব তার সবল হতে থাকে। নাইন-ইলেভেন এবং ওয়্যার অন টেররের তীব্র মোচড় পালুদানকে করে তোলে এমন এক রাজনীতিক, যিনি জাতিগত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনতুষ্টিকে গ্রহণ করেন হাতিয়ার হিসেবে।

পালুদানের মতো আরো বহু নেতা একই প্রেক্ষাপটে উঠে আসেন। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জয়জয়কার এখন ডেনমার্কে। ১৯৯৫ সালে গঠিত হয় ডেনিশ পিপলস পার্টি। দলটির মূল্যবোধ গঠন করেছে অভিবাসন-বিরোধিতা এবং ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিদ্বেষ। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট, জার্মানিতে এএফডি, হাঙ্গেরিতে ফিডেস, সুইডেনে এসডি, স্পেনে ভক্স পার্টি, অস্ট্রিয়ায় ফ্রিডম পার্টি, ইতালিতে লিগ এবং ব্রাদার্স অব ইতালি একই ধারায় রাজনীতি করে জনগণকে উদ্বেলিত করতে পেরেছে। ইউরোপের উদারবাদী রাজনীতি উগ্র জাতিয়তাবাদের কাছে জমি হারাচ্ছে, এটি সবার কাছে পরিষ্কার। কিন্তু এখানে পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় মিডিয়া, এটি গোটা প্রবণতার প্রতি চোখ বুলালেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

দেখা যায়, দলগুলোর যে ন্যারেটিভ, তা আগে থেকে মিডিয়ায় উচ্চারিত হয়ে আসছিল। এসব দলের গণভিত্তি ও বিস্তারের আগের কাজটি করেছে মিডিয়া। অব্যাহতভাবে ইসলাম-হুমকির প্রচার ও ভীতি তৈরির মধ্য দিয়ে।

৪২ হাজার ৯২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশ ডেনমার্কের মোট জনসংখ্যা ৫৮ লাখ ৪০ হাজারের মতো। জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশই খ্রিষ্টান। ইসলাম দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। ২০১৭ সালের পিউ রিসার্চ সেন্টার তথ্যমতে ডেনমার্কে তিন লাখ ১৩ হাজার ৭১৩ জন মুসলমান বসবাস করেন, যা ডেনমার্কের মোট জনসংখ্যার ৫.৪ শতাংশ। এই মুসলিমদের বেশির ভাগই অভিবাসী। যাদের প্রধান অংশটি এসেছে তুর্কিয়ে বা তুরস্ক থেকে। ডেনমার্কে ধর্মান্তরিত স্থানীয় মুসলিমের সংখ্যাও কম নয়। ২০১৭ সালে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ ডেনিশ নাগরিক মুসলিম হন। খ্যাতিমান ডেনিশ নাগরিকদের ইসলাম গ্রহণের ধারা অনেক পুরোনো।

হল্যান্ডের বিখ্যাত জলদস্যু জান জানসুন ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামে দীক্ষিত হন এবং হয়ে ওঠেন বিখ্যাত প্রশাসক জান মুরাত রেইস জানশুন (১৫৭০-১৬৪১)। তার পুত্র এন্থনি জ্যান্সজুন ভ্যান সালি (১৬০৭-১৬৭৬) ছিলেন নিউ নেদারল্যান্ডের একজন মূল বসতি স্থাপনকারী এবং বিশিষ্ট জমিদার। তাকে বলা হতো এন্থনি দ্য তুর্ক। তার মা ছিলেন স্পেনিশ মরিস্কো মুসলিম। এন্থনির প্রথম স্ত্রী গ্রিয়েটসে মারা যান ১৬৬৯ সালে। তারপর তিনি বিয়ে করেন মেটজে গ্রেভেনরায়েটকে, যিনি ছিলেন জাতিগত ডেনিশ মহিলা। ডেনমার্কে এন্থনির বংশধরদের অনেকেই মুসলিম বসতির বিস্তার করেন। কিন্তু ১৮৮০ সালে পরিচালিত প্রশ্নবোধক আদমশুমারিতে ডেনমার্কে মাত্র আটজন মুসলিমের নাম নথিভুক্ত হয়েছিল। পরে অবশ্য মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দেখানো হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি আদমশুমারিতে মুসলিমদের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে এবং প্রতিবারই আগের চেয়ে সংখ্যা বেড়েছে।

কিন্তু ডেনমার্কে ইসলামকে শত্রু হিসেবে দেখার লোকের অভাব ছিল না কোনো কালেই। ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেছিল অগণিত ডেনিশ। তুরস্কের বিরুদ্ধে নৌযুদ্ধগুলোতে তাদের ভূমিকা ছিল বরাবরই। স্পেন থেকে নির্বাসিত মরিস্কো মুসলিমদের ওপর ডেনিশ জলদস্যুদের অত্যাচার ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। মুসলিমদের ইতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখার ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও ডেনমার্কে মুসলিমদের অভিবাসনের দরজা উন্মোচিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সেখানকার শিল্পায়নের ফলে শ্রমিক চাহিদা বাড়ে। ফলে যুগোস্লাভিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম ডেনমার্কে আসে। ১৯৫০-এর দশকে এই আগমনের একটি ঢেউ লক্ষ করা যায়। কিন্তু ডেনিশ সমাজে সম্প্রসারণশীল ধর্ম হিসেবে ইসলাম বিকশিত হচ্ছিল আরো আগে থেকেই। ১৯২৯ সালে বিখ্যাত ডেনিশ লেখক ও সাংবাদিক নুড হলম্বো প্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।

১৯৭৩ সালে অভিবাসী আইনে পরিবর্তন এনে মুসলিম অভিবাসন একেবারে বন্ধ করে দেয় ডেনিশ সরকার। এরপর ১৯৮০-র দশকে আবারো মুসলিম অভিবাসন শুরু হয়। যাকে দ্বিতীয় ঢেউ বলে উল্লেখ করা হয়। মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে ডেনমার্কে আসে বহু মুসলিম। এরপর মুসলিমের সংখ্যা ও উপস্থিতি ডেনমার্কে ক্রমেই বেড়েছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরে সেই উপস্থিতিকে সভ্যতার সঙ্ঘাতের চোখ দিয়ে দেখা হয়। যে অভিবাসী ডেনিশ মুসলিমদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম ডেনমার্কের নাগরিক হিসেবে বড় হয়েছে, তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখার মনোবৃত্তি ছড়াতে থাকে প্রধানত মিডিয়ার মাধ্যমে।

ডেনিশ মিডিয়ার ল্যান্ডস্কেপে ইসলামোফোবিক বিষয়বস্তু ক্রমবর্ধমান হারে হাজির হতে থাকে। তারা অসংখ্য প্রতিবেদনের মাধ্যমে ঘৃণাপূর্ণ একটি অন্ধকারের আধিপত্য তৈরি করে। ২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের Islam and the West: Annual Report on the State of Dialogue. Geneva : World Economic Forum শীর্ষক রিপোর্ট স্পষ্ট করে, ডেনিশ মিডিয়া মুসলিম এবং ইসলামের সবচেয়ে বেশি সমালোচক হতে চেয়েছে। জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈরী সুর উচ্চারণ করেছে ভুল অনুমান ও বিদ্বেষের ওপর ভর করে। বর্ণবাদ ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ডেনমার্কের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মুসলিমদের প্রতি ডেনিশ মিডিয়ার ঘৃণাপূর্ণ মনোভাব অপরাধকে ডেকে আনতে থাকে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে শঙ্কার ঘণ্টা বাজাতে শুরু করে।

২০০৫ সালে ডেনিশ সংবাদপত্র Jyllands-Posten ‘দ্য মুহাম্মদ ড্রয়িংস’ প্রকাশ করে, যা মহানবী সা:-এর নামে কিছু অপমানজনক ব্যঙ্গচিত্রের সমষ্টি। মুসলিম দুনিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে তা ক্ষুব্ধ করে। ডেনিশ মিডিয়া এটিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে প্রচার করলেও এ ছিল ইসলামোফোবিক অনুভূতির বিদ্বেষপূর্ণ প্রকাশ। মহানবী সা:-এর নামে একটি কার্টুন সাজিয়ে পাগড়িতে বোমা রাখা কোন ধরনের বাক-স্বাধীনতা? ইসলামে মহানবী সা:-এর চিত্র আঁকা নিষেধ। সে ক্ষেত্রে এমনটি না করাই তো ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা। মুসলিমরা কখনোই যিশুখ্রিষ্ট কিংবা কোনো ধর্মপ্রবর্তকের অপমান করে না। ইসলামই এসব কাজ নিষিদ্ধ করেছে।

ডেনিশ মিডিয়ায় ইসলামের নেতিবাচক ফ্রেমিং ও তথাকথিত Muslim misery বা মুসলিম দুর্দশার প্রচার নিয়ে অনুসন্ধান চালায় ডেনিশ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ। ওই গবেষণাকর্ম প্রশ্ন তোলে যে, মুসলিমদের নেতিবাচক চিত্রায়ন ডেনিশ সংবাদমাধ্যমের প্রধান অসুখ কি না! গবেষণাকর্মে ডেনমার্কের চারটি প্রধান সংবাদপত্রের ওপর দৃষ্টি দেয়া হয়। রাজনৈতিকভাবে সংবাদপত্রগুলো যদিও বৈচিত্র্যময়, কিন্তু ইসলামঘৃণায় তারা পরস্পরের লগ্ন। জিল্যান্ডস পোস্টেন এই ধারার প্রধান এক সংবাদপত্র, অন্য পত্রিকাগুলো হলো সোশ্যাল লিবারেল দৈনিক Politiken, ঐতিহ্যবাহী ট্যাবলয়েড Ekstra Bladet, (ডেনমার্কের র‌্যাঙ্কিংয়ে কাগজটির অবস্থান সবার উপরে), ইভাঞ্জেলিক্যাল সংবাদপত্র ক্রিস্টেলিগট ডাগব্লাড।

প্রধান এই চার কাগজের সংবাদ, কলাম, সম্পাদকীয়, প্রতিবেদন ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে ডেনিশ ন্যাশনাল সেন্টার এই উপসংহারে পৌঁছে, ডেনমার্কের মিডিয়া সাধারণত মুসলিম এবং ইসলামকে নেতিবাচকভাবে কভার করে এবং ডেনিশ মুসলমানরা যেসব বৈষম্য বা বর্ণবাদের মুখোমুখি তা উপেক্ষা করে। ইসলামকে প্রায়ই ‘ডেনিশ মূল্যবোধ’ বা খ্রিষ্টধর্মের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

মুসলিমবিরোধী বয়ানগুলো ডেনিশ প্রেসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মিডিয়ার এই প্রচারণা ইসলামকে যেভাবে উপস্থাপন করে, তার ফলে প্রজন্মের মন শুধু বিদ্বেষে ভরপুর হচ্ছে না; বরং ইসলামোফোবিয়া ডেনমার্কের রাজনীতির প্রধান আবেগে পরিণত হচ্ছে। জন্ম নিচ্ছেন রাসমুস পালুদানের মতো নেতৃত্ব।

আরও পড়তে পারেন-

তবে আশার বিষয়, মিডিয়ায় প্রচারিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ন্যারেটিভগুলো অনেক সময় ধসে পড়ে বাস্তব অনুসন্ধানে। যার নজির লক্ষ করা যায় নবদীক্ষিত মুসলিমদের অভিজ্ঞতায়। তারা ঘৃণার ভেতর থেকে ইসলামকে সত্যিকারভাবে জানতে চেয়েছেন এবং অবশেষে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এর সুন্দর দৃষ্টান্ত ফার-রাইট ফ্রিডম পার্টির সাবেক এমপি জোরাম ভ্যান ক্লাভেরেনের ইসলাম গ্রহণ।

তিনি বলতেন, ‘ইসলাম মানেই হলো মিথ্যাচার’ এবং ‘কুরআন একটি বিষাক্ত গ্রন্থ’। ইসলামকে কেন উচ্ছেদ করা দরকার, সেই বয়ানের প্রচারে ২০১৪ সালে একটি বই লিখতে চাইলেন জোরাম। কিন্তু ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে ২০১৮ সালে তিনি দীক্ষিত হন ইসলামে। দলটির আরেক এমপি আর্নড ভ্যান ডোর্নেরও একই অভিজ্ঞতা হয়। ইসলাম অধ্যয়ন করতে গিয়ে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন।

জোরাম এখন এন্থনি জানসুন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। এর কাজ হলো ইসলামের সত্য উপস্থাপন করে ইসলামের বাইরে থেকে জন্ম নেয়া ইসলাম-বিষয়ক ভুল ধারণার নিরসন করা।

লেখক : কবি, গবেষক। ইমেইল- 71alhafij@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।