Home ইসলাম আসুন আগে নিজেকে সংশোধন করি

আসুন আগে নিজেকে সংশোধন করি

।। ড. মুহাম্মদ ইয়াসির কাদমানি ।।

মুসলমানদের ভেতর একটি আশ্চর্য স্বভাব তৈরি হয়েছে যে যখন তাদের দুই-চারজন একত্র হয়, তখন মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা, চারিত্রিক স্খলন, পারস্পরিক বিরোধ ও নেতৃত্ব শূন্যতার অভিযোগ করে। সবাই তাতে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অংশ নেয় এবং উৎসাহের সঙ্গে মুসলমানদের সামাজিক দুর্বলতাগুলো বর্ণনা করে।

তবে সবাই এ বিষয়ে একমত যে এমন পরিস্থিতির জন্য আল্লাহর অবাধ্যতা, কোরআন-হাদিসের নির্দেশ অমান্য করা, দ্বিনের ব্যাপারে উদাসীনতা ও ভ্রুক্ষেপহীনতা, পাপাচার ও শিরক-বিদআতে লিপ্ত থাকাই দায়ী।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যার ধর্মীয় জ্ঞান আছে তারা নিজের কথায় ওজন তৈরি করতে কোরআনের আয়াত ও হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়।

তাদের কথা শুনলে মনে হবে, তারা মুসলমানের অধঃপতন ও তার কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন, পরিণাম ও পরিণতি সম্পর্কে তারা ধারণা রাখে, এ বিষয়ে কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা সম্পর্কেও অবগত। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কেউ কেউ আলোচনা কিয়ামত ও কিয়ামতের আলামত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় এবং তাদের মতে, মুসলমানের এই পশ্চাৎপদতা, স্খলন ও পতনের কারণ কিয়ামত ঘনিয়ে আসা।

ঘটনাক্রমে এমন এক বৈঠকে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে মুসলিম সমাজের পতন ও তার কারণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।

একজন বলল, আমানতদারিতা না থাকা কিয়ামতের সবচেয়ে বড় আলামত। এই যুগে কি এমন কোনো লোক আছে, যাকে আমানতদার বলা যায়?

আরেকজন বলল, কিয়ামতের একটি বড় আলামত নামাজে একাগ্রতা না থাকা। বর্তমানে কয়জন মানুষ একাগ্রতার সঙ্গে নামাজ আদায় করে?

তৃতীয় একজন বলল, সুদদাতা ও গ্রহিতার বিরুদ্ধে আল্লাহ কোরআনে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এক টাকা সুদ নেওয়া ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও জঘন্য। আমাদের সমাজে সুদ কতটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। সমাজের বহু ভালো মানুষ তাতে জড়িয়ে আছে।

চতুর্থ ব্যক্তি বলল, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, একসময় এমন সময় আসবে যখন নারীরা উলঙ্গ বের হবে। পোশাক পরিধানের পরও তাদের শরীর প্রকাশ পাবে। তারা নিজেরা পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট থাকবে এবং পুরুষদেরও তাদের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবে।

তাদের মাথার চুল হবে উটনির চুটির মতো। তারা জান্নাতে যাওয়া তো দূরের কথা, জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। নির্লজ্জতার এমন দৃশ্য কি আমাদের চোখে পড়ে না? মুসলিম নারীদের এমন নির্লজ্জ চলাফেরা কি এখন গোপন বিষয়?

পঞ্চম ব্যক্তি বলল, ঘুষের কথা কি আপনারা ভুলে গেলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুষ দাতা ও গ্রহিতা উভয়ের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে ঘুষ ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যায় না। হারাম উপার্জনই মানুষের মূল উপার্জনে পরিণত হয়েছে। আলোচনা চলছিল এবং আমি মাথা নিচু করে সব শুনছিলাম। এভাবে এক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলো; কিন্তু মুসলমানদের সমালোচনা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি, মুসলিমসমাজের হতাশার চিত্রায়ণ এবং আক্ষেপ চলতে থাকল।

আমি মনে মনে বলি, এসব কথা নিজ নিজ স্থানে ঠিক আছে। এসব মন্দ দিকগুলো আমাদের সমাজে আছে। প্রশ্ন হলো, মুসলমানের দোষ-ত্রুটি নির্ণয়কারী এসব লোক সমাজের অন্যদের চেয়ে ভিন্ন কেউ? তাদের অভ্যাস ও আচরণ, তাদের পথ ও পদ্ধতি, চাল-চলনে কি কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না? সমাজের এই অধঃপতনে সমালোচকদের ভুল-ত্রুটির কোনো ভূমিকা নেই? তারা কি পুরোপুরি ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ মেনে চলে?

বাস্তবতা হলো, এই আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকের পরিবর্তে সুদি ব্যাংকে টাকা রাখে। নামাজে একাগ্রতা ও মনোযোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। কেননা প্রত্যেকেই নিজের নামাজ সম্পর্কে অবগত। যারা নারীদের পর্দা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁদের নিজের ঘরেও পর্দার লেশমাত্র নেই। হারাম উপার্জন এখন এত ব্যাপক হয়ে গেছে যে হারামখোরদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। শ্রমিকের পারিশ্রমিক আত্মসাৎ করা, নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, মোহর পরিশোধ না করা, ব্যবসায় প্রতারণা করা, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, জাকাত আদায় না করা এখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

বৈঠকে ঘুষ নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ এমন ব্যক্তি করছিলেন, যিনি কেবল নিজের সময় বাঁচাতে, লাইনে দাঁড়ানোর কষ্ট না করতে নির্দ্বিধায় ঘুষ দেন এবং বলেন, কী করব ভাই? ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। বৈঠকে অভিযোগ ছিল আরাম-আয়েশে মত্ত থাকার এবং অর্থের অপচয় করার; ব্যক্তি প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয় করার এবং শুধু ভোগ-বিলাসের জন্য বেঁচে থাকার। কিন্তু আমি যখন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের জীবনযাত্রার প্রতি মনোযোগ দিলাম, তখন অর্থ অপচয়ের সব চিহ্ন খুঁজে পেলাম। তাদের জীবনে ঐশ্বর্যের ছাপ দৃশ্যমান। আমি নিশ্চিত হলাম, তারা শুধু আনন্দ-ফুর্তির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে।

এসব লোকের মুসলিমসমাজ নিয়ে অভিযোগ ও অস্থিরতার শেষ নেই। নিজের অবস্থা ও পরিণতি নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। অথচ সামগ্রিক অর্থে সেই ভেঙে যাওয়া কাচেরই একটি টুকরা মাত্র। এসব লোকের অবস্থা দেখে আমার সেসব ব্যক্তির কথা মনে পড়ল, যারা মালিক বিন দিনার (রহ.)-এর বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিল। বৈঠকে তাঁর ওয়াজ ও উপদেশ শুনে তাদের ভেতর প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো এবং সবাই কাঁদতে লাগল। কিন্তু এসব লোকের উপস্থিতিতে মালিক বিন দিনার (রহ.)-এর কোরআনের অনুলিপিটি হারিয়ে গেল। পরের দিন ওয়াজের সময়ও তারা খুব কাঁদল। তাদের কান্না দেখে তিনি বললেন, সবাই তো খুব কাঁদছে; তাহলে কোরআনের অনুলিপি কে চুরি করল? বাস্তবতা হলো, মুসলমানের অধঃপতনের জন্য আমরা সবাই খুব আক্ষেপ ও হতাশা প্রকাশ করি। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য আমরা নিজেদের দায়-দায়িত্ব নিয়ে ভাবি না। তাই আসুন আগে নিজেকে সংশোধন করি। নিজের উন্নয়নেই নিহিত সমাজের উন্নতি।

তামিরে হায়াত থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।