Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন সালাম-কালামের আদব-কায়দা

সালাম-কালামের আদব-কায়দা

।। আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী ।।

পৃথিবীর প্রায় সকল জাতির মধ্যেই পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় বিভিন্ন পদ্ধতির অভিবাদন ও শিষ্টাচারের রীতি চালু আছে। কেউ বলে গুড মর্নিং, গুড নাইট, আবার কেউ বলে আদাব। প্রাচীন আরবরা বলত, হাইয়্যাকাল্লাহ।

কিন্তু ইসলাম এসবগুলোর পরিবর্তে সালামের প্রচলন করেছে। ইসলামের প্রবর্তিত এ সালাম পদ্ধতি অন্যান্য জাতির ব্যবহৃত বাক্যগুলি থেকে বহুগুণে উত্তম। এর কারণ বুঝতে হলে সালামের তাৎপর্য বুঝা দরকার। যা পরে আলোচনা করা হবে। এখানে উদাহরণতঃ শুধু বাক্যের অর্থগত ব্যবধান উল্লেখ করা হচ্ছে। যেমন- গুড নাইট অর্থ- শুভরাত্রি।

এখানে দিনের শুভা-শুভের উল্লেখ নাই। আর গুড মর্নিং অর্থ শুভ প্রভাত। এখানে দিনের বাকী অংশের এবং রাতের শুভা-শুভের কোন উল্লেখ নাই। আর আদাব শব্দের মর্মার্থ হচ্ছে সম্মান প্রদর্শন। এখানে সম্মান লাভের মূল উৎসের সন্ধান নেই। অন্যরূপভাবে হাইয়্যাকাল্লাহ্ অর্থ তোমাকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখুন বা দীর্ঘজীবি করুন। এ অর্থে এখানে দীর্ঘজীবন কি সুখময় হবে, না দুঃখময় হবে, তার কোন উল্লেখ নাই।

কিন্তু ইসলামের প্রবর্তিত সালাম বা আস্সালামু শব্দের অর্থ হচ্ছে শান্তি। এটা আল্লাহ পাকের একটা গুণবাচক নাম। সুতরাং আস্সালামু আলাইকুম এর মর্মার্থ হচ্ছে- আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এখানে “আল্লাহর পক্ষ থেকে” বলার মাধ্যমে একদিকে শান্তির মল উৎসের সন্ধান রয়েছে। আপরদিকে দিন-রাত সকাল-বিকাল নির্বিশেষে সার্বক্ষণিক শান্তির দোয়া রয়েছে।

সালামের আদি ইতিহাস

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ পাক হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করার পর তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বললেন যে, ফেরেশ্তাগণের কাছে গিয়ে তাদেরকে সালাম করুন এবং তাঁরা এর কি জবাব দেয় তা শুনুন। কারণ এ সালামই হবে আপনার বংশধরদের পারস্পরিক সাক্ষাতের অভিবাদনের পদ্ধতি।

তখন হযরত আদম (আ.) আল্লাহর নির্দেশমত ফেরেশতাগণের কাছে গিয়ে বললেন, “আস্সালামু আলাইকুম”। জবাবে ফেরেশ্তাগণ বললেন, “ওয়াআলাইকাস্সালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহ্”। (দ্রষ্টব্যঃ সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাতে তাফ্সীরে মাযহারী)।

সালাম সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশ

উপরোক্ত বিবরণ মতে হযরত আদম (আ.) ও ফেরেশতাদের আদান-প্রদানকৃত সালামের পদ্ধতিই ইসলামে চালু হয়েছে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসা-এর ৮৬ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, “যদি তোমাদেরে কেউ সালাম করে, তাহলে তোমরা আরও উত্তম শব্দে অথবা অনুরূপ শব্দে সালামের জবাব দাও।”

উল্লেখ্য যে, পারস্পরিক সালামের মূল শব্দটি হচ্ছে, “আস-সালাম” দু’পক্ষের সালাম আদান-প্রদানের পদ্ধতি হচ্ছে প্রথম পক্ষ বলবে, “আস্সালামু আলাইকুম” আর দ্বিতীয় পক্ষ তার জবাবে বলবে- “ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম”। এটা হচ্ছে উভয় পক্ষের সালামের সবচেয়ে কম সংখ্যক শব্দ সমষ্টি।

উপরোল্লিখিত আয়াতে “অথবা অনুরূপ শব্দে সালামের জবাব দাও” বলে সালাম আদান প্রদানের এ সংক্ষিপ্ত শব্দের সমষ্টির  প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে এর পূর্বে বলা হয়েছে যে, উত্তম শব্দে সালামের জবাব দেয়ার জন্য। এর তাফসীর নিম্নে বর্ণিত হচ্ছে।

সালামের উত্তম জবাব

সালামে ব্যবহৃত বাক্যে দোয়া সূচক শব্দ সর্বমোট তিনটি। এর বেশী নয়। শব্দ তিনটি হচ্ছে যথাক্রমে সালাম, রহমত এবং বরকত। সুতরাং যিনি প্রথমে সালাম করবেন তাঁর জন্য সর্বমোট তিনটি বাক্য রয়েছে সালামে ব্যবহারের উপযোগী। যথা- (১) আস্-সালামু আলাইকুম। অর্থাৎ আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। (২) আস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। অর্থাৎ আপনাদের প্রতি শান্তি এবং আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। (৩) আস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্। অর্থাৎ আপনাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।

উপরোক্ত প্রথম বাক্যে শুধু সালাম বা শান্তি বর্ষণের দোয়া রয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যে সালামের সাথে রহমত যুক্ত হয়েছে। আর তৃতীয় বাক্যে রহমতের পরে বরকতও যুক্ত হয়েছে। শুধু সালাম শব্দ সম্বলিত বাক্যের জবাবে “ওয়া আলাইকুমুস্ সালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহ্” বলে রহমত শব্দ যোগ করে দেয়া হচ্ছে উত্তম পদ্ধতির জবাব। আর রহমত শব্দ সম্বলিত সালামের জবাবে “ওয়া বারাকাতুহ্” যুক্ত করা হচ্ছে উত্তম পদ্ধতির জবাব। কিন্তু প্রথম পক্ষই যদি তাঁর সালামে শব্দ তিনটি উল্লেখ করে ফেলে, তাহলে তাকে শুধু হুবহু জবাব দেয়া যাবে। কিন্তু উত্তম পদ্ধতিতে জবাব দেয়ার উপায় বাকী থাকবে না। তাই সালাম দেয়ার উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে বরকত শব্দ যুক্ত না করা। যেন তার জবাবে বরকত শব্দ যুক্ত করতঃ উত্তম পদ্ধতিতে জবাব দেয়ার সুযোগ বাকী থাকে। বিষয়টির প্রতি অনেকেই লক্ষ্য করেন না। বিস্তারিত বিবরণের জন্য তাফ্সীরে মাযহারী লক্ষ্যণীয়।

সালামের তাৎপর্য

অন্যান্য জাতির পারস্পরিক সাক্ষাতের শিষ্টাচারের চেয়ে ইসলামের সালাম পদ্ধতি উত্তম হওয়ার মূলে রয়েছে এর সুদূর প্রসারী তাৎপর্য। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সালাম আল্লাহ পাকের একটি গুণবাচক নাম। সুতরাং সালাম দাতা এর মাধ্যমে প্রথমতঃ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে, অর্থাৎ আল্লাহর যিক্র করে। দ্বিতীয়তঃ সালামের মাধ্যমে অপরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তৃতীয়তঃ সালাম শব্দের অর্থ হচ্ছে শান্তি। সুতরাং সালাম দাতা তার মুসলমান ভাইয়ের জন্য শান্তির দোয়া করে। চতুর্থতঃ সালামের মর্মসমূহের অন্যতম মর্ম হচ্ছে আমার পক্ষ থেকে আপনাদের সাথে শান্তির আচরণ হবে, এর পরিপন্থী কোন আচরণ হবে না। সুতরাং সালামের দ্বারা মুসলমান ভাইয়ের প্রতি নিরাপত্তা প্রদান করা হয়।

পঞ্চমতঃ সালামের দ্বারা মুসলমান ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা ও সম্প্রীতি ব্যক্ত করা হয়। এসব তাৎপর্য ইসলামের সালাম পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন জাতির শিষ্টাচার পদ্ধতিতে নেই। (তাফ্সীরে মা’আরিফুল কুরআন)।

সালামের ফযীলত

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান আনবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতের যোগ্য হবে না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরে ভালবাসা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করবেনা, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না। আর তোমাদের পরস্পরে ভালবাসা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রসার করা। (সহীহ মুসলিম শরীফ)।

হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসঊদ (রাযি.)এর বর্ণিত এক হাদীসে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম করবে, সে ব্যক্তি অহংকার মুক্ত সাব্যস্ত হবে। (বাইহাকী)।

হযরত আবু উমামা (রাযি.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রথম সালামকারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক ঘনিষ্ট। (তিরমিযী শরীফ)।

হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন আস (রাযি.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, উত্তম স্বভাব হচ্ছে সর্বলোককে আহার করানো এবং চেনা-অচেনা নির্বিশেষে সকল মুসলমানকেই সালাম করা। (দ্রষ্টব্যঃ সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম শরীফ)।

সালামের বিধি-বিধান

সালাম সংক্রান্ত বিধি-বিধানের বিবরণ অনেক ব্যাপক। তাই এখানে শুধু কতিপয় বিশেষ বিশেষ বিধানের উল্লেখ করা হচ্ছে।

প্রথমে সালাম করা সুন্নাত। অতঃপর সালাম দাতার সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব। (দ্রষ্টব্যঃ তাফ্সীরে মা’আরিফুল কুরআন)। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে সালাম করা নিষেধ। অনুরূপভাবে বিভিন্ন অবস্থায় সালামের জবাব দেয়াও ওয়াজিব নয়। যার বিস্তারিত বিবরণ পরে উল্লেখ করা হবে।

অন্য কোন কথা বলার আগে সর্বপ্রথমেই সালাম করা সুন্নাত। এমর্মে হযরত জাবির (রাযি.)এর বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে যে, সালামের পর্যায় হচ্ছে কথা বলার আগে। (দ্রষ্টব্যঃ তিরমিযী শরীফ)। তবে  এ বিধান হচ্ছে সাক্ষাৎকালীন সালামের ক্ষেত্রে। আরেক প্রকার সালাম আছে সাক্ষাত প্রার্থীর জন্য। তার নিয়ম-নীতি স্বতš এবং তা পরে আলোচনা করা হবে।

মুসাফাহা এবং মুয়ানাকার স্তর হচ্ছে পর্যায়ক্রমে সালামের পরে। (তাফসীরে মাযহারী)। সুতরাং সালাম বিহীন মুসাফাহা ও মুয়ানাকা সুন্নাতের পরিপন্থী। এ বিষয়টির প্রতিও আজকাল অনেকেই উদাসীন দেখা যায়। অর্থাৎ আজকাল অনেকেই অজ্ঞতা অথবা উদাসীনতা বশতঃ সালাম ছাড়াই মুসাফাহা এবং মুয়ানাকা করেন। এটা ভুল।

সাক্ষাৎ প্রার্থীর সালাম-কালাম

পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নূর এর ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদের ঘর ব্যতীত অপরের ঘরে আলাপ পরিচয় ও গৃহবাসীকে সালাম না করতঃ প্রবেশ করো না।”

এখানে কারো সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তার বাড়ীতে প্রবেশের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে যে ঘরে বা বাড়ীতে বিশেষতঃ যেখানে অপর কোন মেয়েলোকের অবস্থান করার সম্ভাবনা আছে, সেখানকার কারো সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গেলে আগে বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ীর বাসিন্দাকে ডেকে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করতে হবে। সাক্ষাতের আবদার জানাবে এবং সালাম করবে।

অতঃপর প্রবেশের অনুমতি পেলে প্রবেশ করবে। তারপর সূরায়ে নর এর ২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে- “যদি সেখানে কাউকে না পাও (অর্থাৎ কারো সাড়া না পাও), তাহলে সেখানে প্রবেশ করো না; যতক্ষণ না তোমাদেরে অনুমতি দেয়া হয়। আর যদি বলা হয় যে, ফিরে যাও, তাহলে ফিরে যাবে।”

অর্থাৎ সাক্ষাৎ প্রার্থীকে যদি আপাততঃ সাক্ষাতে কোন অসুবিধাবশতঃ ফিরে যেতে বলা হয় অথবা গৃহবাসীর পক্ষ থেকে কোন জবাব না আসে, তাহলে সাক্ষাৎ প্রার্থীর ফিরে যাওয়াই উচিত এবং সাক্ষাতের জন্য পীড়াপীড়ি করা অন্যায়। বাকী রইল এ প্রশ্ন যে, সাক্ষাত প্রার্থী গৃহবাসীকে আগে সালাম করবে, না আগে আলাপ পরিচয় করে নিবে? এর উত্তর ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। অর্থাৎ সাক্ষাতকারী যদি গৃহবাসীর কাছে এমন অপরিচিত হয় যে, তার কন্ঠস্বরে তাকে চিনতে তারা সক্ষম হবে না, তাহলে আগে পরিচয় দিবে এবং পরে সালাম করবে। আর যদি সাক্ষাত প্রার্থীর কণ্ঠস্বর গৃহবাসীর কাছে সুপরিচিত হয়, তাহলে আগে সালাম করবে, তারপরে সাক্ষাতের আবদার জানাবে। (তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন)।

সালামের জবাব না পেলে কি করতে হবে

উপরোক্ত আলোচনায় দু’ধরণের সালামের কথা ব্যক্ত হয়েছে। একটা হচ্ছে সাক্ষাত প্রার্থনার সালাম। আরেকটা সাক্ষাতের পরবর্তী সালাম। আরেক প্রকার সালাম আছে আনুষ্ঠানিক বিদায় গ্রহণের সময়। (তাফ্সীরে মাযহারী)।

এ তিন প্রকার সালামে ব্যবহৃত বাক্য একই। অর্থাৎ সালামকারীর সংক্ষিপ্ত বাক্য হবে- আস্সালামু আলাইকুম। আর জবাব দাতার সংক্ষিপ্ত বাক্য হবে- ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম।

উপরোক্ত তিন প্রকার সালামের ক্ষেত্রেই একটা প্রশ্ন দাঁড়ায় তখন, যখন সালাম করার পর জবাব না পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে একটা মারাÍক ভুল প্রথা পরিলক্ষিত হয়। আর তা হচ্ছে একবার সালাম করে জবাব না পেলেই বলে জবাব দিন। আবার কেউ কেউ বলে আলোক দিন। কেউ বলে সালাম করেছি, জবাব চাই। অথচ এরূপ বলাটা ভুল। বরং বিধান হচ্ছে, একবার সালাম করার পর জবাব না পেলে আবার পূর্বের ন্যায় সালাম করতে হবে। দ্বিতীয়বার জবাব না পেলে তৃতীয়বার সালাম করতে হবে।

তৃতীয়বার জবাব না পেলে বুঝতে হবে যে, যাকে সালাম করা হচ্ছে, তার পক্ষে জবাব দিতে কোন না কোন বাধা আছে। তাই তার কাছ থেকে সালামের জবাব কামনা না করে এবং তাকে আর সালাম না করে চলে যাওয়া উচিত। (তাফ্সীরে মা’আরিফুল কুরআন)।

এ মর্মে হাদীস শরীফে একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণিত আছে। ঘটনাটির সার-সংক্ষেপ হচ্ছে, একদা হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’দ বিন উবাদা (রাযি.)এর বাড়ীতে গিয়ে নিয়ম মুতাবেক তিনবার সালাম করলেন। এরমধ্যে একবারও সালামের জবাব শুনতে না পেয়ে ফিরে চলে যাচ্ছিলেন। অতঃপর বাড়ী থেকে বের হয়ে হযরত সা’দ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাত করেন। (মুসনাদে আহমদ)। সুতরাং যে কোন অবস্থায় কাউকে তিনবার সালাম করার পর জবাব না পেলে আর অত্যুক্তি না করে চলে যাওয়াই উচিত। এটাই রাসূলের শিক্ষা।

সালামের পরিশিষ্ট

মুসাফাহা এবং মুয়ানাফা সালামের পরিশিষ্ট। (তাফসীরে মাযহারী)। তবে সালাম হচ্ছে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। যা পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে সকল মুসলমানকেই করার বিধান আছে। কিন্তু মুসাফাহা ও মুয়ানাকা এমন নয়। অথচ আজকাল অনেকেই সালামের চেয়েও মুসাফাহা মুয়ানাকাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে যে, শরীয়তের প্রতিটি বিধানকেই যথাযথভাবে পালন করতে হবে। এ মর্মে শরীয়তের সমস্ত বিধানকে প্রধানতঃ দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) জরুরীয়াতে দ্বীন বা ধর্মের যে সকল বিধানকে বাধ্যতামলক করা হয়েছে। (২) যাওয়ায়েদাতে দ্বীন বা যেসকল বিধান পালন করাকে ঐচ্ছিক পর্যায়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর বাধ্যতামূলক বিধানগুলি তিন প্রকার। যথাঃ (ক) ফরয, (খ) ওয়াজিব ও (গ) সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্।

ঐচ্ছিকগুলি প্রধানত তিন প্রকার। যথা- (ক) সুন্নাতে যায়েদা (খ) নফল ও (গ) মুস্তাহাব। তন্মধ্যে সালামের আদান-প্রদান বাধ্যতামূলকের পর্যায়ে পড়ে। আর মুসাফাহা ও মুয়ানাকা পড়ে ঐচ্ছিকের পর্যায়ে। তাই সালামের প্রতি উদাসীন হয়ে মুসাফাহা এবং মুয়ানাকার জন্য অস্থির হয়ে পড়া শরীয়তের বিধানে বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সালাম বাধ্যতামলক হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় শরীয়তের বিধানে তাও নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ অবস্থায় সালাম করা শরীয়তের বিধানে বাড়াবাড়ী ছাড়া আর কি হতে পারে। নিম্নে সালামের নিষিদ্ধ অবস্থাগুলির সংক্ষিপ্ত তালিকা পেশ করা হচ্ছে।

যে সকল অবস্থায় সালাম করা নিষেধ

নিম্নোক্ত অবস্থায় সালাম করা নিষেধ। যথা- (১) নামাযীকে নামাযরত অবস্থায়। (২) তিলাওয়াতকারীকে তিলাওয়াত রত অবস্থায়। (৩) ওয়ায-নসীহত, তাসবীহ ও যিকরে রত ব্যক্তিকে। (৪) ঈদ, জুমআ ও বিয়ের খুতবাদানে রত ব্যক্তিকে। (৫) ইসলামী শিক্ষাদানে রত ব্যক্তিকে। (৬) পাঠ, ওয়ায ও খুতবা শ্রবণে রত ব্যক্তিকে। (৭) ইসলামী আলোচনায় লিপ্ত ব্যক্তিকে। (৮) বিচারক যখন ইজলাসে বসেন। (৯) মুয়াজ্জিন যখন আযান দেন, তখন তাকে অথবা অন্য কাউকে।

(১০) ইকামত দানরত ব্যক্তিকে। (১১) পরনারী অর্থাৎ যে নারীর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শরীয়ত মতে বৈধ, তেমন নারীকে যুবতী অবস্থায় সালাম করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ (অবশ্য যে পরনারী এতই বৃদ্ধা যে, তার প্রতি যৌনাকর্ষণের লেশমাত্রও বাকী নেই, তাকে সালাম করা নিষিদ্ধ নয়)। (১২) খেলাধুলায় লিপ্ত ব্যক্তিকে। (১৩) যে কোন ফাসিক অর্থাৎ যে ব্যক্তি কবিরা গুনাহ্ করে, অথচ তাওবা করে না। (১৪) সহবাসরত ব্যক্তিকে। (১৫) সকল প্রকার অমুসলিমকে।

(১৬) সতর অর্থাৎ শরীরের যেসব অঙ্গ ঢেকে রাখা ফরয, সেসব অঙ্গ যাদের খোলা আছে, তাদেরকে সালাম করা নিষিদ্ধ। (১৭) মিথ্যুক, জুয়াড়ী ও সেই বয়োঃবৃদ্ধকে- যে বাজে আলাপে অভ্যস্ত এবং পরনিন্দাকারী। (১৮) প্রশ্রাবরত ব্যক্তিকে। (১৯) মলত্যাগরত ব্যক্তি এবং (২০) পানাহারে রত ব্যক্তিকে সালাম করা নিষিদ্ধ। অবশ্য সালামকারী ব্যক্তি যদি পানাহারের প্রয়োজন থাকে, আর পানাহারকারী তার প্রয়োজন বুঝে আমন্ত্রণ জানাবার আশা থাকে, তাহলে এমতাবস্থায় পানাহারকারীকে সালাম করা নিষিদ্ধ নয়। (ফাতওয়ায়ে শামী, মা’আরিফুস্ সুনান, ও ফাতহুল মারাম শরহে ফয়যুল কালাম)।

সালাম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ বা বাধ্যতামলক সুন্নাত হওয়া সত্ত্বেও উপরোক্ত অবস্থাবলীর ব্যক্তিবর্গকে সালাম করা নিষেধ। শুধু তাই নয় বরং স্বাভাবিক অবস্থায় সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও নিুোক্ত অবস্থাবলীতে সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়।

যে সকল অবস্থায় সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়

নিম্নোক্ত অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিকে কেউ সালাম করে বসলেও তার সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়। যথা- (১) মুসল্লীকে নামাযরত অবস্থায় সালাম করলে। (২) তিলাওয়াতকারীকে তিলাওয়াতরত অবস্থায় কেউ সালাম করে বসলে। (৩) পানাহারকারীকে সালাম করলে। (৪) দোয়ায় রত ব্যক্তিকে সালাম করলে। (৫) যিকরে লিপ্ত ব্যক্তিকে সালাম করলে। (৬) খুতবা পাঠকারী ব্যক্তিকে। (৭) হজ্বের সময় তালবিয়া পাঠকারী ব্যক্তিকে। (৮) প্রস্রাব-পায়খানারত ব্যক্তিকে। (৯) ইকামত দাতাকে। (১০) আযান দাতাকে। (১১) অবোধ শিশুর সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়। এমনিভাবে- (১২) মাতাল ব্যক্তির (১৩) বেগানা যুবতীর (১৪) ফাসেকের (১৫) তন্দ্রাচ্ছন্ন ব্যক্তির (১৫) নিদ্রিত ব্যক্তির সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব নয় (১৬) সহবাসরত অবস্থায় কেউ সালাম করে বসলে তার সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়। (১৭) ইজলাসে বসা অবস্থায় বিচারপতিকে কেউ সালাম করলে। (১৮) গোসলখানা থেকে জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়। (১৯) পাগলের সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়।

– আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত মুফাসসীরে কুরআন ও ইসলামী স্কলার।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।