Home ইসলাম কর্জে হাসান কারা নিতে পারবেন

কর্জে হাসান কারা নিতে পারবেন

।। সানা উল্লাহ মুহাম্মাদ কাউসার ।।

জাকাত ও কর্জে হাসান পরস্পর একই মাতার দুই ভ্রাতার মতো গলাগলি ধরে সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে। দারিদ্র্যের কশাঘাত ও সুদের চপেটাঘাত থেকে হতোদ্যম মানুষকে উদ্ধার করতে একাত্ম হয়। ঠিক এই কারণে পবিত্র কোরআনে জাকাত ও সালাত প্রসঙ্গের সঙ্গে মহান আল্লাহ কর্জে হাসানের প্রসঙ্গ এনেছেন।

কর্জে হাসানের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

কর্জে হাসান কী? এ ব্যাপারে কোরআন থেকে যে পরিচয় বের হয়ে আসে তা হলো, সুদের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার এক কার্যকর পদ্ধতি।

কোরআনের পাঁচটি সুরার আট জায়গায় এটির বিশদ পরিচয়, মূলনীতি আলোচনা করা হয়েছে। কেন কর্জে হাসানকে সুদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে হচ্ছে, সেটিরও ইঙ্গিত সুরা বাকারার ২৭৮ নম্বর আয়াতে আছে। কেননা এর পরই আল্লাহ ২৮০ নম্বর আয়াতে ‘কর্জে হাসান’কে সুদের বিপরীত সমাধান হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন মহান রব বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যেসব বকেয়া আছে তা মাফ করে দাও। যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৮)

এ ছাড়া অন্য আয়াতে বলেন, ‘যদি সে (ঋণগ্রহীতা) দরিদ্র হয়, তাহলে তার সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অবকাশ দেবে। আর যদি তোমরা উপলব্ধি করতে (তাহলে বুঝতে পারতে) মাফ করে দেওয়াটা তোমাদের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮০)

উপরোক্ত দুটি আয়াতের তত্ত্বীয় বিশ্লেষণে আমরা দেখি, মহান রব দুটি প্রিন্সিপাল (মূলনীতি) এবং দুটি আউটপুট (ফলাফল)-এর সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

যেমন—প্রথম আয়াতে মাফ করে দেওয়ার জন্য আদেশ-এর সঙ্গে আল্লাহকে ভয় করার প্রাসঙ্গিকতার পাশাপাশি মুমিন হওয়া না-হওয়ার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। অর্থাৎ মুমিন হলেই আল্লাহকে ভয় করার মাধ্যমে সুদের বাকি অংশ মাফ করে দিতে হবে।
দ্বিতীয় আয়াতেও মাফ করে দেওয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন কল্যাণকর হওয়া না-হওয়ার ব্যাপারটি উপলব্ধি করার মাধ্যমে। অর্থাৎ মুমিনদের উচিত যে ঋণগ্রহীতাকে হয় সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অবকাশ দেবে নতুবা মাফ করে দেবে। এবং এটাই যে কল্যাণকর সেটা উপলব্ধি করতে হবে।

ড. ওমর চাপড়ার মতে, ‘Oard-al-hassan is a loan which is returned at the end of the agreed period without any interest of share in the profit of loss of borrower. অর্থাৎ কর্জে হাসান হলো এমন এক ঋণ, যা সুদমুক্ত ও চুক্তিবদ্ধ সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে হয় এবং এর মধ্যে কোনো ধরনের লাভ-লোকসানের অংশীদারি নেই।

কর্জে হাসান কারা নিতে পারবেন?

কর্জে হাসানসংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের ১১টি আয়াত এবং ২৯টি বিশুদ্ধ হাদিস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই : প্রধাণত, এই ঋণ অভাবী বা নিঃস্বদের দেওয়ার প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও সাধারণত সর্বস্তরের সব মানুষ এ ঋণের উপকার ভোগ করতে পারবে। অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ের খেটে খাওয়া থেকে শুরু করে উচ্চমহলের লোকজন এ সুবিধার আওতাভুক্ত থাকবে দল-মত-নির্বিশেষে।

এবং এ লেনদেন হবে সম্পূর্ণ শরিয়াভিত্তিক। তবে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে যদি সরকার কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, সে ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় আইনজ্ঞদের সম্মিলিত ফতোয়ার ভিত্তিতে জনকল্যাণ ও মানবিকতার স্বার্থে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত পদ্ধতিতে অমুসলিমদের এ ঋণের আওতায় আনা যেতে পারে। তখন নিম্নের শর্তাবলি আবশ্যক হবে—

১. লিখিত রাখার বিধান হবে ব্যাংক/প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিতে,

২. সাক্ষীর ব্যাপারটিও হবে ব্যাংকিং সিস্টেমের আদলে,

৩. একজন গ্যারান্টর ও দুজন বা ততোধিক রেফারেন্স সংযুক্তকরণ করতে হবে,

৪. সাধারণ বিবেচনার খাতিরে না দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় মানবিক দৃষ্টিতে এ ঋণ প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ

শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য ও বাসস্থান- এই চার ক্যাটাগরিতে অমুসলিম ঋণ সুবিধা পাবে।

ফান্ডিং পদ্ধতি

ক. এককালীন মূলধন জমা।

খ. সাময়িক মূলধন জমা।

গ. ব্যবসায়। (রিজার্ভ ফান্ডের অর্থ নিয়ে)।

ঋণগ্রহীতার ওপর ধার্য করা ফি

কর্জে হাসান ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কোনো ফি আদায় করা সমীচীন নয়। তবে একান্ত ফর্ম, ডকুমেন্টস বা মেনটেন্যান্স ফি হিসেবে শুধু খরচটা নেওয়া যেতে পারে।

প্রজেক্ট সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বেতন-ভাতা

প্রজেক্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বেতন-ভাতা প্রজেক্টের মূলধনের সঙ্গে রিজার্ভ ফান্ডে থাকা অর্থের ব্যাবসায়িক লভ্যাংশ দিয়ে বহন করা হবে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ঋণগ্রহীতার সব মেনটেন্যান্স ফি উক্ত লভ্যাংশ বহন করবে। এভাবে একটি মডেল প্রজেক্ট উপকারভোগীদের সম্পূর্ণ নিখরচা সার্ভিস প্রদান করতে সচেষ্ট হবে। তবে প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাশ্রমের মানসিকতা লালন করতে হবে।

রিজার্ভ ফান্ড গঠনপ্রক্রিয়া

কিছুসংখ্যক উদ্যোক্তা বা ডোনারের সমন্বয়ে কিছু অর্থ একত্র করার মাধ্যমে যেকোনো বৈধ ব্যাবসায়িক ইনভেস্টমেন্ট এবং তদুপরি লভ্যাংশ জমা করা হবে রিজার্ভ ফান্ডে। অথবা প্রয়োজনীয়সংখ্যক ঋণ প্রদানের পর নির্দিষ্ট কিছু অর্থ পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে অর্জিত লভ্যাংশের মাধ্যমে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান করা যেতে পারে।

কর্জে হাসানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা কেন!

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য মতে, ব্যক্তিগত কর্জে হাসানের প্রতি তাগাদা দেওয়া এই সার্ভিসকে কেন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটার প্রধান কয়েকটি কারণ হলো—

১. ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তার জন্য।

২. লিখিত ডকুমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য।

৩. পারস্পরিক সম্পর্কচ্ছেদ না ঘটার জন্য।

৪. ঝুঁকিমুক্ত লেনদেন নিশ্চিতকরণের জন্য।

৫. ঋণগ্রহীতাকে ঋণের অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগানোর প্রতি আগ্রহী করানোর জন্য।

৬. ব্যক্তিগতভাবে লোকসান থেকে বাঁচার জন্য।

৭. কর্জে হাসানের ব্যাপকতা বৃদ্ধির জন্য।

৮. ‘কর্জে হাসান’ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকরণের মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেম চালু করার পথ সুগম করা।

সর্বোপরি এটি একটি সুদ নির্মূলে সম্মিলিত সফল প্রচেষ্টা।

পরিচালনা পর্ষদ

ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিটি প্রজেক্ট নিজের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যদের সমন্বয় করে একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবেন। সেখানে থাকবেন উপদেষ্টা পরিষদ, পরামর্শক, পরিচালক, ঋণদান প্রতিনিধি ও সাধারণ সদস্য।

ঋণের লেনদেন পদ্ধতি

ঋণের লেনদেনের পদ্ধতি সম্পর্কে সুরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতের আলোকে কয়েকটি ধাপ নিশ্চিত করে লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে, যেমন—

ন্যায়সংগতভাবে লিখিত ডকুমেন্ট রেডি করা।

ঋণগ্রহীতা লিখিত দলিল স্পষ্টভাবে পড়বেন ও বুঝবেন। (প্রয়োজনে তিনি তাঁর বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ব্যাপারও তুলে ধরবেন।)

ঋণগ্রহীতা নিরক্ষর বা মানসিকভাবে বুঝতে অক্ষম হলে গ্রহীতার পক্ষের একজন অভিভাবক তা সম্পন্ন করবেন।

দুজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুজন নারী সাক্ষী হিসেবে থাকবেন। (যেহেতু কর্জে হাসান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হবে, সেহেতু দুজন পুরুষ কর্মকর্তা অবশ্যই থাকবেন এবং এ লেনদেন সম্পন্ন করবেন।) লেখক-সাক্ষী-ঋণগ্রহীতা-দাতা সবাইকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে।

ঋণ থেকে বাঁচার জন্য করণীয়

তবে ঋণগ্রস্ত হওয়া কিংবা ঋণে অভ্যস্ত হওয়া কারো জন্য কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে যথাসাধ্য ঋণমুক্ত থাকার ও ঋণমুক্ত হওয়ার চেষ্টা মুমিনদের থাকতে হবে। তাই বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত ঋণ না নেওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধের প্রবল সম্ভাবনা ছাড়া ঋণ না নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করে চলা। মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। না একেবারে মুক্তহস্ত হওয়া আর না বদ্ধমুষ্টি হওয়া।

আরও পড়তে পারেন-

নামডাক, কৃত্রিমতা ও রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা। খরচের বাহুল্য পরিত্যাগ করা। যেসব কাজ জান-মাল ও ইজ্জতের পক্ষে সহায়ক, তা গুরুত্বের সঙ্গে করা। আর যেগুলো বরকত বিনষ্টকারী, তা থেকে সযত্নে বেঁচে থাকা। একই সঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা। একবারের জন্য ঋণ নিয়ে থাকলে ওই ঋণ পরিশোধ না করে পুনরায় ঋণের দ্বারস্থ হওয়া থেকে বিরত থাকা।

পরিশেষে

মানুষ মরে গিয়েও তার রেখে যাওয়া কর্মপরিধির মধ্য দিয়েই ‘সাদকায়ে জারিয়াহ’র একটি জরুরি অংশ পেতেই থাকে কবরজগতে। কর্জে হাসান ঠিক তেমনই একটি চলমান দান। সুদের করালগ্রাসে নিমজ্জিত রাজ্যে সুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু তখনই হাড্ডাহাড্ডি হবে, যখন সদস্যসংখ্যার পর্যাপ্ততা আর মূলধনের পরিধি হবে ব্যাপক। সুতরাং মহান রব ঘোষিত—‘কে আমাকে উত্তম ঋণ দেবে, আমি তাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেব!’ (সুরা : হাদিদ/১১, সুরা : বাকারা-০২/২৪৫, সুরা : তাগাবুন-৬৪/১৭)

এর বাস্তব প্রতিফলন যেন তারই আনুগত্যের আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সুতরাং আসুন, ‘সুদ’কে ‘না’ বলি আর ‘কর্জে হাসান’ প্রতিষ্ঠিত করি।

লেখক : সরকারি চাকরিজীবী (শিক্ষক) ও গবেষক

sukawsar@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।