Home লাইফ স্টাইল প্রত্যাখ্যান, বৈষম্য, সন্দেহ: জেল খেটে মুক্তির পর সমাজে জীবন কেমন হয়

প্রত্যাখ্যান, বৈষম্য, সন্দেহ: জেল খেটে মুক্তির পর সমাজে জীবন কেমন হয়

- প্রতিকী ছবি।

প্রমিলা কন্যা: কারা-ফটকের বাইরে পা রেখেই জাহাঙ্গীরের (ছদ্মনাম) মনে পড়ে গিয়েছিল ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাইয়ের কথা। ১৯৯০-এর দশকের জনপ্রিয় এই নাটকের চরিত্র বাকের ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে শেষপর্যন্ত ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল।

১৯৯৯ সালে জাহাঙ্গীর যখন গ্রেপ্তার হন, তখন তিনি অনিয়মিত মাদকসেবী ছিলেন। জাহাঙ্গীর বলেন, মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে তিনি বড়সড় এক মাদক-বিরোধের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। এর জেরে তাকে প্রায় পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও দীর্ঘদিন তিনি কোনো পারিবারিক বা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন না। লোকে কী বলবে, তা নিয়ে ভয় হতো।

জাহাঙ্গীর বলেন, ‘একদিন বিকেলে আমার মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি ডোরবেল বাজতে থাকি, কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। কয়েকবার দরজায় টোকাও দিলাম। যখন বুঝতে পারলাম তারা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না, তখন চলে আসি। তারা হয়তো ভেবেছিল আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে তাদের বাড়িতে গেছি।’

আরেকটি ঘটনা জাহাঙ্গীরকে এখনও ভীষণ কষ্ট দেয়। একবার তিনি এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী জাহাঙ্গীরকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের নতুন, দামি স্মার্টফোনটি আলমারিতে তুলে রাখেন। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমি কি চুরি করতে সেখানে গিয়েছিলাম? না, কিন্তু তার কাজ দেখে তা-ই মনে হয়েছিল।’

কয়েদিদের সমাজে পুনর্বাসন করার বিষয়টিকে কীভাবে দেখা উচিত? একজন প্রাক্তন কয়েদিকে কি উন্নত জীবনে ফেরার আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিত? এই প্রশ্নগুলো আমাদের সমাজে খুব কমই ওঠে।

জাহাঙ্গীর হতাশ গলায় বলেন, ‘সমাজ যদি আমাদের গ্রহণ না-ও করতে পারে, অন্তত আমাদের টেনে নিচে নামানো উচিত নয়। কারও জীবনের আগের ইতিহাস না জেনে লোকে কেন তাকে বিচার করে ফেলে?’

সালাম (ছদ্মনাম) ১৭ বছর জেল খেটেছেন।

তিনি বলেন, ‘আগে আমার কারাগারের জীবন সম্পর্কে মানুষকে বলতাম, কিন্তু এখন আর বলি না। যতবারই বলেছি, তা আমার বিরুদ্ধে গেছে। আমি বিয়ে করতে চাই, জীবনে থিতু হতে চাই, কিন্তু কেউ আমাকে মেয়ে দিতে চায় না।’

সালাম জানান, ২০০৫ সালে খিলগাঁও ফ্লাইওভার উদ্বোধন করার সময় একদল বন্ধুর সঙ্গে সেটি দেখতে গিয়েছিলেন। ‘ফেরার পথে একটা দুর্ঘটনা দেখি আমরা। ঘটনাস্থলে অনেক মানুষের ভিড় ছিল। হঠাৎ মারামারি শুরু হয়। তারপর পুলিশ আসে।’

তিনি দাবি করেন, অন্যদের সঙ্গে পুলিশ তাকেও আটক করে। তারপর তাকে এমন একটি হত্যাকাণ্ডের আসামি করে, যার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না।

সালাম মনে করেন, তাকে অপরাধী হিসেবে দেখা বা তার অতীত বিচার করা অযৌক্তিক। ‘মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্যিই সমস্যা আছে। তারা মনে করে, যে লোক কারাগারে গেছে, সে খুব খারাপ; কারণ সে অন্যান্য খারাপ লোকেদের সঙ্গে থেকেছে। কিন্তু আমি কখনও কারও কোনো ক্ষতি করিনি—না কারাগারে, না বাইরে।’

সালাম ও জাহাঙ্গীর দুজনেই জানান, বাইরের জগতের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে তারা কারাগারের ভেতরে কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। জেল খেটে আসা আসামিকে যেসব নিন্দা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়, তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না।

জেল থেকে বের হওয়ার কয়েক বছর পরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন জাহাঙ্গীর। সেই ঘটনা এখনও তাকে কষ্ট দেয়। ‘একবার আমার ভাতিজা অন্য শিশুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছিল। তাতে বিরক্ত হয়ে আমার পরিবারের এক চিৎকার করে ওকে বলেছিল, “তোর চাচা অপরাধী ছিল, তুইও তা-ই হবি।”‘

‘জিনিসপত্রের ব্যাপারে আমাকে বিশ্বাস করতে পারত না’

নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরে একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম সালামের। ১৯৯০-এর দশকে ইসলাম গ্রহণের পর পরিবার তাকে ত্যাজ্য করে। শেষে তার পরিবার ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ভারতে স্থায়ী হয়।

২০১৬ সালে বিচারক সালামকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সালাম জানান, দুইজন আইনজীবীর সহায়তায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। ‘আমাকে এত বছর কারাগারে রাখার জন্য রাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেন বিচারক। অবশেষে ২০২২ সালের মার্চ মাসে আমি মুক্তি পাই।’

আরও পড়তে পারেন-

ছাড়া পাওয়ার পর সালাম বেশ কিছুদিন একটি মেসে ছিলেন। মেসের সদস্যরা তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন, তার সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। মেসের সদস্যরা তার সঙ্গে খেতেনও না, কখনও তার সঙ্গে এক ঘরে একা থাকতেনও না। ‘তারা তাদের জিনিসপত্রের ব্যাপারে আমাকে বিশ্বাস করতে পারত না, [ভাব দেখে মনে হতো] আমি যেন একটা চোর। আমি রুমে থাকলে তারা কখনোই ফোন চার্জে দিয়ে বাইরে যেত না।’

সালামের চাচা এখনও নোয়াখালীতে থাকেন। সালামকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তার ভাগ্নিরা স্কুলে যেত। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাননি সালাম। ‘ওরা আমার রক্ত, আমার পরিবার। ওদের দেখতে, ওদের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে।’

‘ডাক্তারও এখন আমার দিকে অন্যভাবে তাকায়’

সালাম বলেন, ‘আমি একবার এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। যেই তিনি শুনলেন আমি কারাগারে ছিলাম, সেই মুহূর্তেই আমার প্রতি তার মনোভাব বদলে গেল। আমার সঙ্গে তিনি অন্যরকম আচরণ করতে শুরু করলেন। অভিজ্ঞতাটা আমার একটুও ভালো লাগেনি।’

আমরা সালামকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কেন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন এবং ওই চিকিৎসক তাকে ঠিক কী বলেছিলেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারবেন কি না। বিস্তারিত কিছু জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন।

সালাম এখন ধানমন্ডির একটি এমব্রয়ডারির দোকানে কাজ করেন। সেই দোকানের বারান্দায়ই ঘুমান। মেস ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। ‘আমি একটা রুমও ভাড়া নিয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে সেই এলাকা ছাড়তে হয়। কারণ আমি যে কয়েদি ছিলাম, তা নিয়ে মানুষ ক্রমাগত কথা বলছিল।’

‘ভালো মানুষ এখনও আছে’

জেল থেকে বের হওয়ার পর জাহাঙ্গীরের মা যখন তাকে প্রথম দেখেন, তখন তিনি ‘আমাকে কিছু বলেননি, শুধু কাঁদছিলেন।’

জাহাঙ্গীর পরে বিয়ে করেছেন, সন্তানও হয়েছে। কিন্তু শুরুতে তার স্ত্রীকে ভীষণ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছিল। বছর দশেক আগে তারা যখন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, জাহাঙ্গীরের শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিল। ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বলেছিলেন, মেয়েকে “জেল-খাটা আসামী’র সাথে বিয়ে দেওয়ার চাইতে ওর মরে যাওয়াই ভালো।’

তবে জাহাঙ্গীরের অতীত নিয়ে তার স্ত্রীর কোনো সমস্যা ছিল না। পরিস্থিতি হালকা করার জন্যই যেন জাহাঙ্গীর বললেন, ‘আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা ওর কাছে একটু আকর্ষণীয়ও মনে হয়েছে। ও বোধহয় দেখতে চেয়েছিল বন্দিরা দেখতে কেমন হয়!’

মেসের সদস্যরা সালামের উপস্থিতি পছন্দ না করলেও তার সেখানে থাকা নিয়ে মেস মালিকের কোনো সমস্যা ছিল না। ‘তিনি আমার জীবনের ঘটনা জানতেন, কিন্তু সেটা নিয়ে তার কোনো সমস্যা ছিল না। বরং ছুটি কাটাতে গ্রামে যাওয়ার সময় তিনি বিল্ডিঙের চাবিও আমার কাছে রেখে গিয়েছিলেন। আমাকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন।’

‘ভালো মানুষ এখনও আছে। আমার এক আইনজীবী, অ্যাডভোকেট আলমগীর আমাকে ২০ দিন তার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে স্মার্টফোন কিনতে দেননি, জেলখানায় টেইলারিংয়ের কাজ করে যে সামান্য টাকা সঞ্চয় করেছিলাম, তা-ও খরচ করতে দেননি। আমাকে তার নিজে একটা ফোন দিয়েছিলেন তিনি,’ সালাম বলেন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, আমাদের কাজ ও (সাবেক কয়েদিদের সমাজে পুনর্বাসন-সংক্রান্ত) নীতির মধ্যে মিল নেই। ‘কাউকে কারাগারে পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো সংশোধন, যাতে ওই ব্যক্তি আরও ভালো হয়ে ওঠে—এবং কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সমাজে ফিরে ভালো জীবনযাপন করতে পারে ও বেআইনি কোনো কাজে ফিরে না যায়। কিন্তু আমাদের দেশে কাউকে কারাগারে ঢোকানোর পুরো কারণই হলো প্রতিশোধ, সংশোধন নয়।’

তিনি বলেন, একজন ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানোর অনেক আগেই তার শাস্তি শুরু হয়। ‘কারাগারে যারা থাকে, তারা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর জন্য প্রায় কোনো চিকিৎসা পায় না। এছাড়া গোটা পরিবেশ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। তবে এই সমস্যাটিকে [মানসিক স্বাস্থ্যের] অবশ্যই প্রতিটি পর্যায়ে তুলে ধরতে হবে।’

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম:এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।