Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ রাস্তা পারাপারে দৌড়, চালকের যাত্রীক্ষুধা- আমাদের ট্রাফিক আইন জ্ঞান!

রাস্তা পারাপারে দৌড়, চালকের যাত্রীক্ষুধা- আমাদের ট্রাফিক আইন জ্ঞান!

কার আগে কে যাবে- এটাই যেন মূল লক্ষ্য/ ছবি- আসমা সুলতানা প্রভা।

।। রাফিয়া মাহমুদ প্রাত ও আসমা সুলতানা প্রভা ।।

২১ বছর বয়সী আফিয়ার কাছে রাস্তা পার হওয়া এক আতঙ্কের নাম! কিন্তু অন্যদের চাপে পড়ে কখনো কখনো ওভারব্রিজ ছাড়াই ব্যস্ত রাস্তা পার হতে হয় তাকে। সেদিনও তা-ই হয়েছিল…

এক তপ্ত দুপুরে বাংলামোটর মোড়ে আফিয়া ও তার বোনেরা দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত রাস্তার দুপাশে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছিল যানবাহনগুলো। তিন বোন অপেক্ষা করছেন, সিগ্যনাল দিলেই রাস্তা পার হবেন। কিন্তু সিগন্যালের দেখা নেই। শেষমেশ অধৈর্য্য হয়েই চলন্ত রাস্তার মাঝ দিয়ে পার হবার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা।

মাঝ রাস্তায় যেতেই হঠাৎ খেয়াল হয়, ডানদিক থেকে প্রবল বেগে ছুটে আসছে একটি বাস। বাসটি যখন কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে, ঠিক তখনই বোনদের হাত ছেড়ে আফিয়া দিলেন এক দৌড়। উঠে যান রাস্তার ডিভাইডারের ওপর। একটু হুঁশ হতেই, চমকে গিয়ে দেখলেন বোনেরা কেউ নেই তার সাথে। কিছু হয়ে গেলো না তো বোনদের?

সৌভাগ্যবশত সেবার তারা বেঁচে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সিগন্যাল দিতেই রাস্তার ঐ পাড়ে দেখতে পেলেন দুই বোনকে। তারাও ওইপাশে দাঁড়িয়ে আফিয়াকেই খুঁজছেন। সেদিন থেকে তিন বোন পণ করলেন, আর কখনো সিগন্যাল না পড়লে রাস্তা পার হতে যাবেন না।

আফিয়ার মতো অনেককেই বাধ্য হয়ে রাস্তার মাঝে দিয়ে পারাপার হতে হয়। এই যেমন মুসান্নাত হোসেন, পড়ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওভারব্রিজ দিয়ে পার হচ্ছিলেন বাংলামোটরের রাস্তা। তিনি বলেন, ‘আমি একা থাকলে কখনোই রাস্তা দিয়ে পার হই না। একা রাস্তা পার হতে গেলে খুব ভয় কাজ করে। কিন্তু বন্ধুরা থাকলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পার হতে হয়। তখন আমিও ওদের সাথে ফাঁকফোকর দিয়ে পার হয়ে যাই।’

মুসান্নাতের বন্ধু বা আফিয়ার দুই বোনের মতো অসংখ্য মানুষ কেবল আলসেমির কারণেই ব্যস্ত রাস্তা পার হোন। তার একটি উদাহরণ হতে পারে বাংলামোটরের মোড়। ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত মোড় এটি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখান দিয়ে পার হয়। তবে সে তুলনায় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম। এক মিনিটে সেখানে ৪-৫ জন ব্রিজ দিয়ে পার হয়। সে অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় বা দিনে ওভারব্রিজ দিয়ে পার হওয়ার কথা প্রায় সাড়ে সাত হাজার জনের। তার মানে বাকি যারা পার হন, তারা চলমান রাস্তাতেই আফিয়াদের মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হয়ে যান শুধুই আলসেমি করেই।

‘আলস্য’ ছাড়াও দায়ী ‘নিরাপত্তাহীনতা’

২০১৮ সালের কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর ১২৮টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পথচারীদের পারাপারের জন্য রয়েছে ৮৭টি ফুট ওভারব্রিজ। এছাড়া রয়েছে তিনটি আন্ডারপাস। ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস মিলে মোট সংখ্যা ৯০। এরমধ্যে নিউমার্কেট, আগারগাঁও, শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর-১০ এলাকার ফুটওভারব্রিজগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মানুষের ভিড়। তবে কিছু ব্রিজ থাকে একেবারেই জনমানবশূণ্য। যেমন, পান্থপথে বসুন্ধরা সিটির সামনে ২০১৪ সালে নির্মিত ফুটওভার ব্রিজটি দিনের বেশির ভাগ সময়ই অব্যবহৃতভাবে পড়ে থাকে।

আলস্য ছাড়াও এই ফুট ওভারব্রিজগুলো ব্যবহার না করার অন্যতম বড় কারণ নিরাপত্তাহীনতা। প্রায়ই ওভারব্রিজগুলোতে ছিনতাইয়ের মুখোমুখি হতে হয় সাধারণ পথযাত্রীদের। আবার সন্ধ্যা হয়ে গেলে ওভারব্রিজ দিয়ে পার হতে অনেকেরই ভীতি কাজ করে। এ কারণে মানুষ ওভারব্রিজে উঠতে ভয় পায়। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ভীতিটা একটু বেশি।

পথযাত্রী সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘আমি প্রায়ই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করি। কিন্তু সন্ধ্যা হলে আমি ওভারব্রিজে আর ব্যবহার করি না। অনেকসময় দেখা যায় এখানে ভাসমান মানুষ, টোকাই, পাগলসহ আরও নানা ধরনের মানুষ থাকে, যাদের আমার কাছে নিরাপদ মনে হয় না। তাই দিনে মাঝেমধ্যে পার হলেও সন্ধ্যা বা নিরিবিলি থাকলে একদমই ওভারব্রিজ ব্যবহার করি না।

বয়সও একটি বাঁধা…

ফুটওভার ব্রিজগুলো এত বেশি উঁচু যে এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় মধ্যবয়সী বা বয়স্ক মানুষের। সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠার ভয় থেকে বয়স্করা ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হন। এমন একজন কানিজ-ই বাতুল। বয়স ৫০ এর ওপরে। সাথে তার মা জায়েদা বেগম। মগবাজার মোড়ে গোল চত্বরে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন তারা। মা-মেয়ে জানান, ওভারব্রিজ দিয়ে পার হওয়া একটু কঠিন হয়ে পড়ে। পায়ে সমস্যা হয়। তাই সিগন্যাল পড়লে জেব্রা ক্রসিং দিয়েই অনায়াসে পার হতে পারেন রাস্তা।

পঞ্চাশোর্ধ্ব পথচারি আজিজুল হক বলেন, ‘আমি ট্রাফিক নিয়ে অনেকটা সচেতন থাকার চেষ্টা করি। মাঝেমধ্যে মনে হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে যেকোনোভাবে পার হয়ে যাওয়াই যেন বেশি নিরাপদ। গাড়ির যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাতে গাড়ি চালানো, পায়ের উপর গাড়ি চালিয়ে দেওয়াসহ অনেক কিছু থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে অন্তত।’

অন্যদিকে আবার অনেক দরকারি জায়গায়ও ফুটওভার ব্রিজ নেই। যেমন গুলিস্তানের ব্যস্ত মোড়। সেদিন মোড়ের সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ার পরেও বেপোরোয়াভাবে রাস্তা পার হচ্ছিলেন উম্মে কুলসুম। কোলে তার কয়েক মাস বয়সী শিশু। আর হাত ধরে আছে পাঁচ বছরের ছোট ছেলে। এভাবেই দিব্যি পার হচ্ছিলেন কুলসুম। ভয় লাগে কি-না জিজ্ঞেস করতেই বীরের হাসি দিয়ে জানালেন, ‘আমরা তো প্রতিদিনই এভাবে পার হই। ভয়ের কী আছে! সবই অভ্যাস।’

গুলিস্তানের মতো ঢাকার দয়াগঞ্জ, তাঁতীবাজার, ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ, শংকর বাসস্ট্যান্ড, গুলশান-১ চত্বর, গুলিস্তান, মিরপুর মাজার রোডসহ আরো বেশ কিছু এলাকায় পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। এই এলাকার অনেক পথযাত্রী আছেন যাদের রাস্তা পারাপারে রয়েছে তীব্র মাত্রায় ভীতি। তাদের দাবি, একটা ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের!

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কী দিয়েছে?

ঢাকা শহরে ট্রাফিক এক যন্ত্রণার নাম। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তাই যে যেমন পারছে সেভাবে চলছে। ডান, বাম কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা নেই, কে কতটা আগে যেতে পারে অন্য সবাইকে পিছে ফেলে-এই হলো চিন্তা। তাই তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সার্জেন্ট ট্রাফিকরাও এখন ছাড় না দিয়ে জরিমানা আর মামলা ঠুকছে। আগের চেয়ে তাদের উপস্থিতি এখন অনেকটাই সরব ঢাকার রাজপথে।

মূলত, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর লাইসেন্সবিহীন গাড়িচালক হলে মামলা; উল্টোপথে গাড়ি, ইউটার্ন, সিগন্যাল ব্রেক করলে মামলা; হেলমেট পরিধানে বাধ্যবাধকতা ইত্যাদির মতো ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাতে এসেছে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারির এক পরিসংখ্যানমতে, বাংলাদেশে প্রায় উনত্রিশ লক্ষ যানবাহনের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কেবল উনিশ লক্ষ চালকের।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর এই লাইসেন্সে এসেছে কর্তৃপক্ষের নজরদারি। শাহবাগ পুলিশ বক্সের পুলিশ সার্জেন্ট সবুজ মিয়া জানান, ‘আগে প্রচুর গাড়ি ধরতাম যাদের কাগজপত্র বা লাইসেন্স থাকতো না। ঐ ছাত্র আন্দোলনের পর এই ব্যাপারটায় সবাই সচেতন হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, এমন গাড়ি আমরা এখন খুব কমই পাই।’

গুলিস্তান মোড়ের সার্জেন্ট মো: আকরামও (ছদ্মনাম) একই কথা বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় গাড়িরই লাইসেন্স থাকে যা ২০১৫-১৬ সালে ছিল না। মোটর সাইকেল যারা চালায় তারাও হেলমেট নিয়ে আগের চেয়ে সচেতন। সড়ক আন্দোলনের পর আগের চেয়ে কিছুটা হলেও আইন মান্য করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমি মনে করি।’

কিন্তু সে-ই বা কতটুকু। তাতে ঢাকার ট্রাফিকের চলমান অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন এসেছে? এসব জানতেই সেদিন বেড়িয়ে পড়েছিলাম ঢাকার রাজপথে। গুলিস্তান, গুলশান, মতিঝিল, শাহবাগ, ফার্মগেট- আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট, বাস সিনএনজি চালকসহ, সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের মতামতও।

প্রয়োজনের তুলনায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা কম

মাথার ওপর ঝকঝকে কাঠফাটা রোদ। এদিকে সামনে পেছনে পাশে সব জায়গা থেকে ভেসে আসছে কানফাটা হর্ণের শব্দ। এরমধ্যে হাতে ওয়াকিটকি, খেয়াল রাখতে হচ্ছে সেখানেও। এতসবের মাঝে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে রাস্তার গাড়িঘোড়ার ওপর। এক মিনিটও এদিক সেদিক যাবার ফুসরত নেই তাদের। এরই মাঝে সিগন্যাল উপেক্ষা করে মানুষের অবাধ চলাচল আটকাতে গিয়ে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশদের।

মানুষের এমন উৎপাত নিয়ে নীলক্ষেত-নিউমার্কেটের মোড়ে দায়িত্বরত পুলিশ পরিদর্শক ইন্সপেক্টর (ওসি-তদন্ত) সাঈদ ইবনে সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা জাতি হিসেবে এমন যে, কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করতে চাই না। আইন মানার চেয়ে আইন না মানাতেই বেশি অভ্যস্ত আমরা। পুলিশ কিছু বললেই সবাই সেই পুলিশ ট্যাগ ব্যবহার করে কথা বলে। পুলিশরাও যে মানুষ এই কথা কেউ ভাবে না। জোর করে কিছুই চেঞ্জ হয় না আসলে। মানুষের সচেতনতা, মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধই আসল জিনিস।’

আগে যাওয়ার প্রবণতা, স্টপেজে যাত্রী নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত গাড়ির গতি কমিয়ে রাস্তায় জ্যাম তৈরি করা, সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ার পরেও মাঝপথে যাত্রী তোলা থেকে শুরু করে নানা ধরণের কাজের কারণে ট্রাফিক পুলিশরাও ত্যক্তবিরক্ত। তার ওপর ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা অপ্রতুল, যা নগরীর যানজট নিয়ন্ত্রণে কষ্টকর।

আরও পড়তে পারেন-

শাহবাগ মোড়ের সার্জেন্ট সবুজ মিয়া বলেন, ‘আমরা এক একটি সিগন্যাল রাখি ২-৩ মিনিট। কিন্তু যাত্রীদের মনে হয় ৩০ মিনিট ধরে আটকে রাখছি তাদের। আমাদের লক্ষ্যই থাকে দ্রুত জ্যাম ক্লিয়ার করা। তাও গাড়িগুলোর আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে। অবশ্য এর পেছনেও যাত্রীদের হাত থাকে। তারা ড্রাইভারকে তাড়া দেয় দ্রুত সিগন্যাল পার হওয়ার জন্য। একজন পুলিশের কাছে কি সবগুলো গাড়ি চোখে চোখে রাখা সম্ভব?’

এইসবের পাশাপাশি বেপোরোয়া ড্রাইভিং এবং প্রতিদিন কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটার কাহিনী তো আছেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ঈদুল আযহার মাত্র ১৫ দিনেই সারাদেশে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত এবং ৫৪৪ জন আহত হয়েছে।

ঢাকা শহরের কোনো রাস্তার মোড়কে শতভাগ নিরাপদ দাবি করাই যেন কাল্পনিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কেউ কেউ শোনাচ্ছেন আশার বাণীও।

গুলিস্তান মোড়ে কর্মরত সার্জেন্ট মো. আকরাম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘এই মোড়ে অনেক বেশি জ্যাম থাকলেও দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে এসেছে। ছোটোখাটো যেসব দুর্ঘটনা ঘটে সেটাও কমে যেতো যদি একটা ফুটওভার ব্রিজ থাকতো। তাহলে রাস্তায় মানুষের অবাধে চলাচলের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমে যেতো।’

আবার গুলশানে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ জাহিদ হাসান (ছদ্মনাম) বলেন, ‘দিনে এখানে ৩-৪ টার চেয়ে বেশি মামলা আমরা দিই। এখানে মানুষ কোনো আইন মানে না। যে যেভাবে পারে পার হচ্ছে। তাছাড়া এখানে ফুটওভার ব্রিজও নাই।

কী বলছেন বাস, সিএনজি চালকরা

ঢাকার রাস্তায় কোন যানবাহনগুলো সবচেয়ে বেপোরোয়া জানতে চাইলে উঠে আসে বাস, সিনএনজি, মোটরসাইকেলের কথা। বিশেষ করে গুলশান, গুলিস্তান, ফার্মগেট, মতিঝিলের মতো ব্যস্ত কিছু অঞ্চলের সার্জেন্টদের সঙ্গে কথা বললে এ নামগুলোই আসে। বিপরীত দিকে গাড়ি চালালে, অতিরিক্ত গতি বা নির্ধারিত গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালালে, নিরাপত্তাবিহীন অবস্থায় গাড়ি চালালে, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা ফিটনেস সার্টিফিকেট, প্রকাশ্য সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে-প্রভৃতি কারণে এসব অঞ্চলে দিনে চার পাঁচটি মামলা দেন তারা।

এসব মামলারও পরও চলাচলে এসব যানবাহনের নেই কোনো পরোয়া। এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম একজন বাস চালকের কাছে। ‘দেওয়ান’ বাসের চালক তিনি। আট বছর ধরে বাস চালাচ্ছেন। এত জরিমানা থাকার পরও ইচ্ছেমত বাস থামিয়ে যাত্রী তুলে নেওয়া, বাসে বাসে প্রতিযোগিতা করে কে আগে যাত্রী তুলতে পারে এসব যে এখনও করেন। অকপটে স্বীকারও করলেন। সার্জেন্টের ভয় নেই? জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলেন, ‘এ জগতে ভয় আছে? ভয় পাইলে চলবো না। এই যে এখন আমি আস্তে আস্তে যাচ্ছি, যদি পেছনে আমার রুটেরই আরেকটা গাড়ি দেখি, তাহলেই জোরে চালাব। সবই হলো টাকার (হাত দিয়ে ইঙ্গিতে বোঝালেন) জন্য।’

আরেক সিএনজি চালক জসীম জানান, প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও মামলায় নাম ওঠে তার। জরিমানা যায়। তবে এগুলো কোনো বিষয় না।

কথা হয় একজন বাইক চালকের সঙ্গেও। নাম, মেহেদি হাসান। উল্টোপথে এসে সিগন্যালের প্রথম সারির যানবাহনগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন মেহেদী। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘আমি যখন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম তখন আমার এইসব আইন জানতে হয়েছে। আর কিছু আইন আমি নিজেই গুগল করে জেনে নিয়েছি। কমন কিছু আমরা সবাই জানি। আজকাল অনেকেই ফুটপাতের ওপর বাইক উঠিয়ে দেয়। আমি ফুটপাতে চালাইনি কখনো। তবে উল্টোপথে বাইক চালাতে হয় প্রায়ই। জানি এটা আইন বিরোধী, তাও করি তাড়াহুড়োর কারণে।’

সাধারণ মানুষ আইন কতটা জানে?

ট্রাফিক নিয়ম কেউ মানেনা, ঘুষ দিলেই উল্টো পথে যাওয়া যায়, কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই, সাধারণের দূর্গতি- এসবের পেছনে আসলে দায়ী কাকে করা যায়? ট্রাফিক পুলিশদের দাবি, মানুষের মাঝে আইন না মানার প্রবণতা বেশি। কিন্তু আসলেই দেশের মানুষ ঠিক কতটুকু সচেতন বা জানেন ট্রাফিক আইন বা নিয়ম সম্পর্কে?

২০২০ সালে প্রকাশিত ‘Road traffic accidents in Bangladesh: Why people have poor knowledge and awareness about traffic rules’ শীর্ষক একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। ২০১৭ সালে মোট ৭০০ জনের ওপর গবেষণাটির জন্য জরিপ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ৫৮.১% উত্তরদাতার বয়স ছিল ৩০ বা এর কম। জরিপে ট্রাফিক নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞান এবং সচেতন ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৬২%। তার মধ্যে ৪৩.২% এর ট্রাফিক সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই ছিল না।

তাছাড়া এই পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, এই বেপরোয়া ট্রাফিক ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী পুরুষ (৮১.৯%)। এরমধ্যে ৩৪.৪% পুরুষই ট্রাফিক সম্পর্কে অজ্ঞাত এবং অসচেতন।

এই উত্তরদাতাদের বেশিরভাগই ছিল (৫৫.১%) গ্রামীণ মানুষ এবং তাদের মধ্যে ৫২.৮% অসচেতন। যেখানে শহুরে উত্তরদাতাদের মধ্যে ৮০.৩% ই সচেতন।

আবার তাদের মধ্যে ৭৯% শিক্ষিত, কিন্তু এই শিক্ষিতদের মধ্যে আবার ২৯.৭% ই ট্রাফিক আইন এবং নিয়ম সম্পর্কে কিছু জানেনা।

সুতরাং, শিক্ষিত মানুষরাও যে ট্রাফিক সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখে, তা বলা যায় না।

ড্রাইভিং স্কুল কী শেখাচ্ছে?

যোগাযোগ করা হয়েছিল বাংলাদেশ ড্রাইভিং ট্রেনিং ইন্সটিউটের সঙ্গেও। ঢাকার ড্রাইভিং স্কুলগুলোর মধ্যে তালিকার উপরের দিকের একটি স্কুল এটি। ধানমন্ডি শাখার ম্যানেজার মামুন জানান, ‘এখানে আমাদের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস ২২টি, ইঞ্জিনের ওপর চারটি ক্লাস এবং তত্ত্বীয় ক্লাস হয় চারটি। এই থিওরির ক্লাসগুলোতেই আমরা শেখাই আইন, রুলস-রেগুলেশন। কিন্তু দেখা যায়, প্র্যাক্টিক্যাল আর ইঞ্জিনের ক্লাস করতে এলেও, থিওরির ক্লাসগুলোতে তারা অনুপস্থিত থাকেন।’

মামুন জানান, ‘সারাদেশের চালকদের মধ্যে ২০% চালক হয়তো ড্রাইভিং শিখতে আসেন। তারা নিজেদের গাড়ি বা বাইরে যাবার উদ্দেশ্যেই মূলত আসেন এখানে।’

মতিঝিল শাপলা চত্বর মোড়ে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের কাছে আইন বিষয়ক জ্ঞান নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ট্রাফিক পুলিশ আছি, আমাদের তো ট্রাফিক আইন আলাদা করে শেখানো হয়। তাই আমরা জানি কী কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। কিন্তু বাস চালকরা তো কিছুই জানেনা এসবের। তারা অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশদের মান্যই করতে চায় না। রাস্তায় নিজেদের রাজা ভাবতে থাকে।’

যাত্রী কল্যাণ সমিতির ভাষ্য কী?

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, ট্রাফিক সিস্টেমের এমন পরিণতির জন্য বিদ্যমান আইনই দায়ী। তিনি বলেন, ‘পুরো ট্রফিক সিস্টেমেই বড় ধরনের গলদ আছে। এখানে ট্রাফিক সার্জেন্টদের নির্দিষ্ট অংকের জরিমানা এবং নির্দিষ্ট অংকের মামলা দেওয়ার জন্য একটা লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া আছে। আইন কেউ মানুক আর না মানুক এই নির্দিষ্ট অংকের টাকা আদায় করা হয়-ই। ফলে যারা নিরীহ, আইন মেনে চলার চেষ্টা করে, তারাও এই অনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি হচ্ছে। এভাবে হতে হতে ড্রাইভাররা বিদ্যমান ট্রাফিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং অনাস্থা প্রকাশ করে।’

তার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্ট এলাকা বা পৃথিবীর অন্যান্য কোনো দেশে ট্রাফিকের এমন চিত্র দেখা যায় না। কারণ সেখানে এভাবে অহেতুক জরিমানা বা মামলা করার বিধান নেই। ট্রাফিক পুলিশদের পাশাপাশি যদি ক্যামেরা পদ্ধতি চলে আসে যেখানে কেউ আইন ভঙ্গ করলেই তার চেহারা চিহ্নিত হয়ে যাবে এবং সেটা তার এনআইডিতে অটোমেটিক একটা সমস্যা যোগ করবে, এবং যা বড় অংকের জরিমানা ব্যতীত ঠিক করা যাবেনা- তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবাই আইন মেনে চলবে। পাশাপাশি মোটর বাইক বাস, ট্রাক, রিকশার জন্য যদি আলাদা লেন করা হয়, তবে জ্যাম কমে যাওয়ার সাথে রাস্তায় শৃঙ্খলাও চলে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

পাঠ্যপুস্তকে কতটুকু আছে?

২০২০ ও ২০২৩ সালের পঞ্চম ও সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে সংযুক্ত ট্রাফিক নিয়ম কানুন
২০২৩ সালের প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক ঘাঁটলে সেখানে এই ট্রাফিক আইন বা সচেতনতা নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। শুধু ক্লাস থ্রি-তে ট্রাফিক নিয়ে একটি ছড়া, পঞ্চম ও সপ্তম শ্রেণিতে জেব্রা ক্রসিং, সিগন্যাল বাতি ও ওভারব্রিজ ব্যবহার করা নিয়ে এক পৃষ্ঠা বিবরণ পাওয়া যায়।

২০২০ সালের প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক ঘাঁটলে কেবল তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে পাওয়া যায় ট্রাফিক নিয়ে আলোচনা। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘নিরাপদে চলাচল’ শীর্ষক তিন পৃষ্ঠার একটি অধ্যায় পাওয়া যায়। আর পঞ্চম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ট্রাফিক সম্পর্কে লেখা পাওয়া যায়। মূলত জেব্রা ক্রসিং, সিগন্যাল বাতি ও ওভারব্রিজ ব্যবহার করা নিয়েই অধ্যায়গুলো সাজানো।

বইয়ের বাইরে ট্রাফিক সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আসলেই কতটুকু আছে তার একটি আনুমানিক চিত্র দাঁড় করাতে গিয়েছিলাম উদয়ন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে। ক্লাসে সেদিন উপস্থিত ছিল মোট ৫৭ জন। ট্রাফিক আইন এবং নিয়মনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানগুলো তারা কোথা থেকে পেয়েছে জানতে চাইলে তাদের উত্তরে উঠে আসে পরিবার, বাবা মায়ের কথা। সেইসাথে বইয়ে এসম্পর্কে কিছু পড়েছে কি-না জানতে চাইলে, তারা নির্দিষ্ট করে কোনো উত্তর দিতে পারেনা। উপরন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী হলেও, ক্লাসের অন্তত আটজন শিক্ষার্থীর বড় রাস্তাতেই মোটরসাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। লাইসেন্স নেই বলে পুলিশ ধরলেও ঘুষ দিলে ছেড়ে দেয় কিংবা নেতার নাম নিলে ছেড়ে দেয় বলে জানায় তারা।

এছাড়া, ট্রাফিক সচেতনতা বাড়াতে ক্লাসেই কোনোকিছু শেখানো হয় কি-না জিজ্ঞেস করলে স্কুলের স্কুলটির প্রাথমিক শিক্ষা সমন্বয়কারী ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক সবিদা দাস জানান, ‘সেভাবে আমরা কিছু শেখাই না। কিন্তু সাবধানে চলাফেরা করতে, রাস্তার দু পাশ খেয়াল রেখে চলাফেরা করার মতো এই ছোটোখাটো বিষয়গুলো বলি। আর বইয়ের যেগুলো আছে সেগুলো যদি নবম- দ্বাদশ শ্রেণিতে থাকে, তবে ভালো হয়। জিনিসগুলো এত ছোট ক্লাসেই দেওয়া যে, ওরা বুঝে উঠতে পারেনা এর বাস্তবিক প্রয়োগ।’

‘আমরা না জাগলে একটা সুন্দর সকাল কখনো আসবে না’

এ-ই হলো ট্রাফিক আইন নিয়ে মানুষের জানাশোনা এবং ট্রাফিক সিস্টেমের সার্বিক অবস্থা। যেখানে কার কী দোষ, কে কতটুকু আইন মানছে, পরোয়া করছে-এসব কোনোকিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কে কার আগে কত তাড়াতাড়ি যেতে পারে, সেটাই মুখ্য বিষয়। এই ছুটে চলার প্রতিযোগিতায় হয়তো কাউকে মাসুল দিতে হচ্ছে জীবন নাশের মাধ্যমে।

তবে আছেন মো: রাশেদের মতো মানুষও। বয়স ৬০ উপরে হলেও সৌম্য চেহারার এই পথচারী সকল নিয়মনীতি মেনেই পার হন রাস্তা। অনেকক্ষণ সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছিলেন তিনি। তার এমন ধীরস্থির অপেক্ষা এবং অন্যদের মতো আইন অমান্য করে রাস্তা পার হতে না চাওয়ার প্রবণতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আইন তৈরি হয় আমাদের নিরাপত্তার জন্যই। আমরাই যদি সেটা না মানি তবে কি আইনের দরকার আছে? কাজী নজরুলের সেই কবিতার কথা মনে আছে? ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ ট্রাফিক ব্যবস্থায় সকাল দেখতে চাইলে আমাদেরই জাগতে হবে। আমরা না জাগলে একটা সুন্দর সকাল কখনো আসবে না।’

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।