Home পরিবার ও সমাজ একজন ভালো বাবা হচ্ছেন পরিবারের ক্যাপ্টেন, সন্তানের জীবনের ছায়াশক্তি

একজন ভালো বাবা হচ্ছেন পরিবারের ক্যাপ্টেন, সন্তানের জীবনের ছায়াশক্তি

শাহানা হুদা রঞ্জনা: আমার জন্ম হয়েছিল খুব শীতে। সেসময় আমাদের বাসায় কোন গৃহকর্মী ছিল না। বড় হওয়ার পর আম্মাই বলেছেন আব্বা সকালে উঠে আমার সব কাপড়-চোপড় ধুয়ে, বাইরে শুকাতে দিয়ে তারপর কাজে যেতেন। বাসায় থাকলে আমার জন্য গরম পানি করা, দুধ বানানো, বোতল ধোয়ার কাজটিও আব্বা করতেন। যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি বাজার থেকে জিনিসপত্র এনে আব্বাই সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন। কোথাও বেড়াতে গেলে আমি আব্বার কোলে করেই যেতাম। আব্বা নাকি আম্মাকে বলতো, ‘তুমি শাড়ি পরে, সেজেগুজে বেড়াতে যাচ্ছো, সেখানে বাচ্চা কোলে নিয়ে হাঁটাটা খুব একটা সুবিধার হবে না।’

আব্বা সাংবাদিক ছিলেন বলে অনেক রাতে ফিরতেন। আম্মা না খেয়ে অপেক্ষা করতেন। তখন আব্বাই বলতেন, তার ফেরার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে শুয়ে পড়তে। রাতে খাওয়ার পর আব্বা বাসনকোসন ধুয়ে রাখতেন যেন সকালে উঠে আম্মার কষ্ট না হয়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিয়ে হয়েছিল আম্মার। আব্বা অনেকবার বলেছিলেন ঢাকার একটা কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করতে। কিন্তু আম্মার পড়াশোনার প্রতি তেমন কোন আগ্রহ ছিল না বলে পড়াটা আর হয়নি।

অথচ বড় হয়ে আমি দেখিনি সংসারের কোন কাজে আব্বাকে হাত লাগাতে। বাজার করা ছাড়া আর কিছু করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বরং দেখেছি অসময়ে বাজার এনে বাসায় একটা হৈচৈ ফেলে দিতে। তবে সেসময় বাসায় দু’জন গৃহকর্মী ছিল বলে খুব একটা অসুবিধা হয়নি আম্মার। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব নিয়ে আনন্দ করাটা ছিল আব্বার নৈমিত্তিক কাজ। এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে বড় হতে হতে আমি অনুভব করেছি, কোনরকম ধারণা বা ট্রেনিং ছাড়াই আমার বাবা ছিলেন একজন জেন্ডার সংবেদনশীল, প্রগতিশীল ও আধুনিক মানুষ।

যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় নারী স্বাধীনতা, জেন্ডার ধারণা, নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্য দেওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কোন চিন্তাই ছিল না। সাধারণ পরিবারতো দূরের কথা, শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও নারী অধিকারের তেমন কোন চর্চা ছিল না। সেই হিসেবে আমাদের মতো কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক পরিবারে জেন্ডার ধারণা আসবে কোথা থেকে।

কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি, বিস্ময়করভাবে এইসব ধারণা, চিন্তা ভাবনা, কাজ সবই আমার পরিবারে বিশেষ করে আব্বার মধ্যে ছিল। পরিবারে কাজে হাত লাগানো, দায়িত্ব শেয়ার করা, স্ত্রীকে সম্মান করা, কন্যা সন্তানকে স্বাধীনতা দেওয়ার ধারণা আব্বাকে কেউ শেখায়নি, ট্রেনিংও দেয়নি। অথচ তিনি সেটা অন্তরে ও কাজের মাধ্যমে বহণ করে গেছেন সারাজীবন ধরে।

এখন যেটাকে আমরা পুরুষতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব বলি, সেটারও চর্চা ছিল না আমার ‘পুরুষ’ বাবার মধ্যে। আম্মাকে অসম্মান ও ছোট করে কথা বলতেও দেখিনি কখনো। আম্মা খুব একটা পড়াশোনা শেখেননি, তাও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বড় বড় প্রোগ্রামে ও কূটনৈতিক দাওয়াতে আব্বা নির্দ্বিধায় আম্মাকে সাথে নিয়ে গেছেন, সম্মান দিয়েছেন।

‘গ্যাসোলাইটিং’ বলে যে মানসিক অসুস্থতা অনেকেই বিশেষ করে পুরুষরা ধারণ করেন আচরণে ও অন্তরে, আব্বার মধ্যে তা বিন্দুমাত্রও ছিল না। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, পরিবার আমাদের প্রথম ও সবচেয়ে শক্তিশালী শিক্ষাক্ষেত্র। সেখানে সন্তান যে শিক্ষা পাবে, সেই শিক্ষাই তাদের অন্তরে প্রোথিত হয়ে যাবে। তা আমার বাবার ক্ষেত্রে পুরো সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

জেন্ডার সংবেদনশীল আচরণ করা, নারীকে সম্মান দেওয়া, নিজের ধারণা বা পছন্দ-অপছন্দ অন্যের উপর চাপিয়ে না দেওয়া, ছেলে সন্তান ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে কোন পার্থক্য না করা, অন্য মানুষকে বিশেষ করে স্ত্রীকে গ্যাসোলাইটিং না করার শিক্ষা মানুষ প্রকৃতপক্ষে পরিবার থেকে গ্রহণ করে। পরে প্রশিক্ষণ পেয়ে বা পড়াশোনা করে তাকে ধারালো করে। কিন্তু বেসিকটা থাকতে হয় পরিবারে, মনের ভেতরে।

আমি পরবর্তীতে অনেককে দেখেছি নারী অধিকার, জেন্ডার ধারণা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন, কথা বলছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন, নেতৃত্বে আছেন কিন্তু আদতে নিজ পরিবারে তা পালন করছেন না। অর্থাৎ তারা এইসব কনসেপ্টকে শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির কনসেপ্ট বলে মনে করেন। নিজেরা পরিবারে, সমাজে গ্যাসোলাইটিং এর চর্চা করেন। যারা মানুষকে ঘায়েল বা নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তারা প্রথমেই চান সেই মানুষের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিতে হবে। অনেক পরিবারেই এই একটা বিষয়ের চর্চা করা হয় জোরেশোরে। এই গ্যাসোলাইটিং শিক্ষাঙ্গন, কর্মক্ষেত্র, বন্ধুদের মধ্যেও ঘটে থাকে। এ ধরনের সম্পর্ককেই মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘গ্যাসলাইট আচরণ’। পারিবারিক সহিংসতার একটি বড় অস্ত্র এই গ্যাসলাইটিং।

গ্যাসলাইটিং হচ্ছে এক ধরনের মানসিক নির্যাতন। একজন ব্যক্তি যখন অন্য একজন ব্যক্তিকে তার বিবেচনাবোধ, স্মরণশক্তি অথবা দুর্বল বাস্তবতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা খোঁটা দেন, তখন তা এই গ্যাসলাইটিং এর মধ্যে পড়ে। যে ব্যাক্তি এ ধরনের ব্যবহারের শিকার হন তারা দ্বিধান্বিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং ক্রমে নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এবং তখনই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যাক্তির পক্ষে। আমাদের চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীকে সবার সামনে হেয় করছেন, সেটা কখনো বন্ধুদের আড্ডায়, কখনোবা আত্মীয় পরিজনের সামনে।

নারীকে অসম্মান করার জন্য, দুর্বল করে রাখার জন্য এ যেন চলমান প্রক্রিয়া। গ্রামেগঞ্জে, নগর জীবনে, শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তের সংসারে এ যেন পরিচিত দৃশ্য। অথচ আমি আমার দাদা-বাবা কারো মুখেই শুনিনি ‘আরে তুমি কী বুঝো? চুপ কর,’ ‘মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের মতো থাকো’ – এই কথাগুলো। বরং পড়াশোনা করে কিভাবে নিজের পায়ে শক্ত করে দাঁড়াতে হবে সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।

একটা সময় আমাদের দেশের সামাজিক কাঠামোতে বাবাই সংসারের সবকিছু ছিলেন। যেহেতু তিনিই সব দায়িত্ব পালন করতেন, কাজেই তার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাই সংসারে অবশ্য পালনীয় ছিল। কেউ তার কথার বিরোধিতা করতে পারবে না, তার সামনে কোন যুক্তি তর্ক খাটবে না। বাবারা বাসায় এলে বাচ্চারা মায়ের আঁচলের তলায় আশ্রয় নিতো। যা কিছু আনন্দ করতে হবে, তা বাবাকে লুকিয়েই করতে হবে। বাবার ভালবাসা ও আশ্রয় ছাড়া যেহেতু পারিবারিক কাঠামোই দুর্বল, তাই সেই সময়ের বাবাদের আত্ম অহংকার ও তেজ একটু বেশিই ছিল। একেই আমরা বলি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, তারই প্রতিফলন দেখা যেতো অনেক বাবাদের মধ্যে। তাই বাবারা সন্তানের সঙ্গে কম কথা বলতেন, হাসতেন কম ও মেলামেশাও করতেন কম। আর সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব করারতো প্রশ্নই আসে নাই।

কিন্তু আমাদের কাছে বাবা মানে সংসারের ছায়া, বাবা মানে এক ঝুড়ি আনন্দ। আমাদের বহু-সদস্য বিশিষ্ট এই পরিবারে আব্বা ছিলেন প্রাণ, হাসির উৎস। প্রতিদিন বিকেলে আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম আব্বা কখন বাড়ি ফিরবেন। কারণ আব্বার হাতের ব্যাগে অবশ্যই কিছু না কিছু থাকতো। থাকতো খাবার, গল্পের বই, কলমসহ আরো অনেক ইন্টারেস্টিং কিছু। আব্বা বাসায় ফেরা মানে সেই ব্যাগেই এক ঝাঁক গল্প নিয়ে ফেরা। সন্ধ্যায় পড়তে বসার আগে ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আব্বার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে গল্প আর হাসাহাসি করা ছিল আমাদের অবশ্য কাজ। সেই আসরে আম্মা, আমি, আমার ভাই ছাড়াও ফুপু, খালা, মামা, কাজিনদের একটা বড় দল থাকতো। অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে আব্বা আমাদের ছাড়া একা টিভিও দেখতে পারতেন না।

পরিবারের সবার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, আমোদ-আহ্লাদ, বিয়ে সবকিছুর দায়িত্ব সাধারণত বাবাকেই বহন করতে হয়। সমাজ পুরুষের ঘাড়ে সংসার পরিচালনার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। যেকোন মূল্যে পুরুষকেই এই হাল চালিয়ে নিতে হয়। এখন অবশ্য অনেক পরিবারেই বাবাদের ভূমিকা পাল্টে গিয়েছে, ঠিক যেমনটা পাল্টে গেছে মায়ের দায়িত্ব ও ভূমিকা। এখন সন্তান পালনের ক্ষেত্রে ছেলেরাও অংশীদার হচ্ছেন, গৃহস্থালি অনেক কাজেই হাত লাগাচ্ছেন।

এরপরেও জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সন্তানের দাঁড়িয়ে থাকা ও পুরো পরিবারের বেঁচে থাকা অনেক সহজ ও সম্ভব হয় একজন ভালো বাবার জন্যই। বাবারা সন্তানের জীবনের ছায়াশক্তি। বাবা যদি সৎ হন, মানুষের বন্ধু হন, পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তাহলে তিনি চলে গেলেও তার সন্তানেরা মানুষের ভালবাসা ও সহযোগিতা পাবেই।

আরও পড়তে পারেন-

যেসব বাবা সংসারের দায়িত্ব সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান, স্ত্রীকে যুদ্ধের মাঠে একা ফেলে চলে যান, সংসারের কর্তা হিসেবে একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করেন, যারা দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ পথে টাকা আয় করে সন্তানকে মাত্রাতিরিক্ত সুখে রাখার চেষ্টা করেন, যারা চরিত্রহীন, পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহিংস আচরণ করেন, যারা সবক্ষেত্রেই যৌন কর্তৃত্ববাদী- সেইসব লোকগুলো আদতে কোনদিন বাবাই হতে পারেননি, পারবেনও না।

একজন আধুনিক ও প্রগতিশীল বাবা তার সন্তানদের শেখাবেন মানুষকে ভালবাসার কথা ও সম্মান দেওয়ার কথা। তিনি শেখাবেন ভালবাসা মূল্যবান জিনিস, তা পেতে চাইলে আগে অন্যকে ভালবাসতে হবে। কীভাবে দুঃখ-কষ্টকে জয় করতে হয়, সৎ থেকে বাঁচা যায়, সেটাও ভালো বাবারাই সন্তানকে শেখান।

পরবর্তী জীবনে এসে আমরা দেখতে পারছি এরকম আধুনিক বাবাদের। যারা সন্তানের ও স্ত্রীর বন্ধু হতে পেরেছেন বা বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা স্ত্রীর হাত ধরে তাকে এগিয়ে চলতে সহায়তা করেন। পরিবারের কাজ, সন্তানের দায়িত্ব ভাগ করতে পারেন। যেহেতু ঘরে-বাইরে এখন স্ত্রীরাও একা হাতে অনেক কাজ করেন, সন্তান প্রতিপালন করেন, স্বামীর কাজে সহযোগিতা করেন, কাজেই বাবা ও স্বামী হিসেবে একজন আধুনিক পুরুষের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে।

সন্তানকে সুন্দর করে বড় করতে হলে বাবা-মা দু’জনেরই উচিৎ হবে নিজেদের ক্রমাগত পরিবর্তন করা। একজন আধুনিক ও সহনশীল বাবা তার সন্তানকে আচার-আচরণে, মেলামেশায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, তথ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন – শুধু পুরুষ হিসেবে নয়, একজন যথার্থ বাবা হিসেবে। আব্বাই ছিলেন আমাদের পরিবারের সেই ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন।’

সবশেষে বলি, আশ্রয়-প্রশ্রয়, ভালবাসা ও স্নেহ দিয়ে আব্বা আমাদের বড় করেছেন, দিয়েছেন কথা বলার, যুক্তি প্রদর্শনের, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং ঘুরে বেড়ানোর অপার স্বাধীনতা। পাশাপাশি এও শিখিয়েছেন ঠিক কোথায় থামতে হবে, কার সাথে কী বলতে হবে, কী করতে হবে। ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার ৩১ পরও আমরা তার সেই শিক্ষা নিয়েই বেঁচে আছি, সুখে আছি।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।