Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন সঙ্ঘাতময় বিশ্বে ইমাম ও খতিবদের ভূমিকা

সঙ্ঘাতময় বিশ্বে ইমাম ও খতিবদের ভূমিকা

।। ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ।।

ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মসজিদের ইমাম ও খতিবরা দ্বীনের মর্মবাণীর প্রচার-প্রসার, শিক্ষা-দীক্ষা ও দাওয়াত-তাবলিগের খিদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। ইমামতির পাশাপাশি ইমাম ও খতিবরা প্রায়ই মুসল্লিদের উদ্দেশে বক্তব্য পেশ করেন। বিশেষভাবে প্রতি সপ্তাহে জুমার দিন, ঈদের দিন, শবেকদরে ওয়াজ নসিহত পেশ করা একরকম বাধ্যতামূলক। তাদের বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, ইসলামের মূল পঞ্চস্তম্ভ, বিদআত পরিহার, সুন্নাতে রাসূলের পুনরুজ্জীবন, সাহাবা ও আউলিয়ায়ে কেরামদের জীবনকাহিনী, তাওবা, নারীর অধিকার, দাম্পত্য জীবনে করণীয়, পর্দার গুরুত্ব, মা-বাবার সেবা, প্রতিবেশীর হক, মানবাধিকার, সময়ের কদর, পরকালীন জবাবদিহি, মানবসেবা, মাদকের অপব্যবহার, যৌতুক, সন্ত্রাসবাদ, অন্যায়, জুলুম ও অসত্যের প্রতিবাদ ইত্যাদি। ইসলামী আদর্শের আলোকে সমাজ বিনির্মাণে ইমাম ও খতিবদের ভূমিকা ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।

ইসলামের সোনালি যুগে মহানবী সা: স্বয়ং, সম্মানিত চার খলিফা, উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমি, সেলজুক, মুসলিম স্পেনের রাষ্ট্রপ্রধানরা দেশ পরিচালনার পাশাপাশি রাজধানীর কেন্দ্রীয় মসজিদে ইমামতি করতেন ও জুমার খুতবা দিতেন। তারা মক্কা-মদিনা সফর করলে হারামাইনেও নামাজ পড়াতেন ও খুতবা দিতেন। খুতবায় তারা সমসাময়িক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতেন। পরবর্তীতে এই নিয়ম রহিত হয়ে যায়। ২০১২ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট ড. হাফেজ মুহাম্মদ মুরসি যেখানে যেতেন নামাজের সময় হলে ইমামতি করতেন। ইমাম ও খতিবদের বক্তব্য রাখার পরিধি ব্যাপক। মসজিদের বাইরেও প্রায় সারা বছর বিভিন্ন ওয়াজ, তাফসির ও সিরাত মাহফিলে তাদের শরিক থাকতে হয়। ইলম ও আমলের বরকতে সমাজে যাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে তারাই ইমাম ও খতিব হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ভক্তিজনিত কারণে মুসল্লি ও সাধারণ মানুষ তাদের কথা শোনেন ও মানেন। সমাজে তাদের প্রভাব স্বীকৃত। ইমাম ও খতিবদের বক্তব্য, ওয়াজ ও নসিহতের ফলে সমাজে অপরাধের হার হ্রাস পায়। জীবন আখিরাতমুখী হয়। পাপমুক্ত জীবন পরিচালনার দীক্ষা পায়। ফরজ ও নফল ইবাদতের প্রতি নতুন উদ্যম তৈরি হয়। আল্লাহ তায়ালার সাথে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

২০১৮ সালের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে মসজিদের সংখ্যা দুই লাখ ৫০ হাজার ৩৯৯। এই সব মসজিদে কমবেশি প্রায় পাঁচ লাখ ইমাম-খতিব কর্মরত। কেবল ঢাকা শহরে আছে তিন হাজার মসজিদ। তিনটি সরকারি ছাড়া সব বড়-ছোট মসজিদ স্থানীয় কমিটি নিয়ন্ত্রিত। মুসল্লিদের স্বেচ্ছাদানে এসব মসজিদ নির্মিত ও পরিচালিত হয়। ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন, খাদিমের জন্য কোনো স্বীকৃত বেতন কাঠামো নেই, নেই চাকরিবিধি। সামান্য ভাতা নিয়ে তারা যুগ যুগ ধরে এই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আড়াই লাখ মসজিদের জন্য সরকারি অনুদান একেবারেই অপ্রতুল। সুলতানি ও মুঘল আমলে বড় বড় মসজিদের নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সরকারিভাবে করা হতো। দিল্লি, লাহোর, আগ্রা, কাশ্মির, আহমদাবাদ, ফতেপুর সিক্রির বাদশাহি মসজিদগুলো তার প্রমাণ। মসজিদের ব্যয়ভার বহনের জন্য কমিটির অনুকূলে বিপুল নিষ্করভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হতো। ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর বন্দোবস্তি বাতিল করা হয়। ইমাম ও খতিবরা বিনা বেতনে মসজিদের খিদমত অব্যাহত রাখেন। স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী মুসল্লিদের সহায়তায় মসজিদ আবাদ রাখেন।

সিরিয়া ছাড়া আরব লিগভুক্ত দেশের বেশির ভাগ মসজিদ সরকারি। ধর্ম ও আওকাফ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। বহু বাংলাদেশী ইমাম ও খতিব সেখানে কর্মরত। সম্মানজনক বেতন-ভাতা, বাসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও তারা ভোগ করেন। আসমানের ওপরের আর জমিনের নিচের কথা বলতে কোনো বাধা নেই। তবে সমাজ, রাষ্ট্র বা অব্যবস্থা নিয়ে সংযত হয়ে কথা বলতে হয়। ইউরোপ, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর মসজিদ আছে। বেশির ভাগ মসজিদ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম কমিউনিটি দ্বারা পরিচালিত। বিদেশে ইমাম ও খতিবরা বেশ কোয়ালিফায়েড। তারা সংশ্লিষ্ট দেশের আইন ও রীতি মেনে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তাদের বক্তব্যের মূল বিষয়- ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতার পাশাপাশি আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও বহুমাত্রিক সমাজে সহিষ্ণুতা। মসজিদগুলো বাংলাদেশী, পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান, আফ্রিকান, মিসরি, সুদানি, সোমালি, ইরিত্রিয়ান, লেবানিজ মসজিদ নামে পরিচিত। ভূমি কিনে অথবা সরকার থেকে লিজ নিয়ে নিজেদের অর্থায়নে মুসলমানরা মসজিদ কমপ্লেক্স তৈরি করেন। সৌদি বাদশাহ ফাহাদ ও বাদশাহ আবদুল্লাহর আগ্রহে ও অর্থায়নে স্পেন, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাসহ অমুসলিম দেশে বেশ কিছু মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মিত হয়। দু-চারটি দেশ ছাড়া সরকার বা স্থানীয় জনগণ মসজিদ পরিচালনায় বাধা দেয় না। মাঝে মধ্যে বর্ণবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী মসজিদে হামলা চালায় বা গুলিবর্ষণ করে ভীতির জন্ম দেয়। তারপরও মুসলমানরা থেমে নেই।

২০১৯ সালে এথেন্সের প্রথম সরকারি মসজিদে নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। ২০১৬ সালে গ্রিসের পার্লামেন্ট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই মসজিদটি নির্মাণের অনুমোদন দেয়। এ মসজিদে ৩৫০ জন মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। মিনারবিহীন এই স্থাপনা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় সোয়া আট কোটি টাকা। ১৮৩৩ সালে উসমানীয় শাসকদের হাত থেকে গ্রিস মুক্ত হওয়ার পর এথেন্সে আর কোনো মসজিদ ছিল না। বর্তমানে বৃহত্তর এথেন্সে প্রায় তিন লাখ মুসলিমের বাস। ১৮৯০ সালে গ্রিসের সংসদে এথেন্সে একটি মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হলেও তা নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। এথেন্স একমাত্র ইউরোপীয় রাজধানী, যেখানে মসজিদ ছিল না। এতদিন অস্থায়ী ও ব্যক্তিগত জায়গায় এথেন্সের মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতেন (মাসিক আত-তাওহিদ, চট্টগ্রাম)।

আরও পড়তে পারেন-

২০১৭ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের ১২টি দরজা-জানালা ভেঙে ফেলে। ২০১০ সালে রাজধানী ওয়ারশ’তে দ্বিতীয় আরেকটি মসজিদ নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল বের করে। পোল্যান্ডে চার কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৪০ হাজার মুসলমান। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য হলো- জরিপে ৪০ হাজার বলা হলেও মুসলমানদের সংখ্যা আসলে অনেক বেশি। যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের পরে পোল্যান্ডে মুসলমানদের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে বছরে ১৩ শতাংশ হারে মুসলমান বাড়ছে। এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরে পোল্যান্ডে মুসলমানদের সংখ্যা ইতালি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসকে অতিক্রম করবে। চীনে মসজিদের মিনার নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্যাগোডার আদলে মসজিদ তৈরি করার জন্য মুসলমানদের চাপ দেয়া হচ্ছে। স্লোভাকিয়ায় কোনো মসজিদ নেই অথচ মুসলমান আছে। সুইজারল্যান্ডে মসজিদের মিনার তৈরি নিষিদ্ধ। অবশ্য সেখানে ধর্মচর্চা ও অনুশীলনে কোনো বাধা নেই।

কিছু মসজিদ আছে মুতাওয়াল্লি শাসিত। সেখানে মসজিদ পরিচালনার সাথে সাধারণ মুসল্লি যুক্ত হতে পারেন না। মুতাওয়াল্লিদের মধ্যে নেককার ও বিবেচক বহু মানুষ আছেন, যারা মসজিদের উন্নয়নের পাশাপাশি ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিনের উন্নয়নের দিকেও নজর দেন। কিছু মুতাওয়াল্লির ভূমিকা স্বেচ্ছারিতাপূর্ণ। বহু সময় কমিটির চাপে ইমাম ও খতিব সব কথা বলতে পারেন না। আরব দেশগুলোতে সরকারিভাবে রচিত খুতবা পাঠ করা বাধ্যতামূলক। নামাজ শেষে পঠিত খুতবার রেকর্ড কপি জমা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট দফতরে। সরকারি খুতবার বাইরে কোনো কথা বললে তার জন্য কৈফিয়ত দিতে হয়। আরবের অনেক ইমাম-খতিব এখন কারাগারে। এক কথায় ইমাম ও খতিবের স্বাধীনতা বিশ^জুড়ে সীমিত এবং দায়িত্ব ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং।

প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতরেও ইমাম ও খতিবরা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে চলেছেন। সময় ও যুগ পরিবর্তনের কারণে নতুন সমস্যা, নতুন ইস্যু, নতুন ফিতনা তৈরি হয়েছে। হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা, জুলুম, যৌতুক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সহিংসতা, ধর্ম নিয়ে উপহাস ও কটূক্তি, এসিড নিক্ষেপ, মাদকাসক্তি, ধর্ষণ, বলাৎকার, আত্মহত্যা, এইডস প্রভৃতি এই মুহূর্তে আমাদের জীবন্ত সমস্যা। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, স্যানিটেশন, পথশিশু পরিচর্যা, রক্তদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, জাকাত আহরণ ও বিতরণ আলোচনার উপযুক্ত ও আধুনিক বিষয়। পবিত্র কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতির সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার রেফারেন্স তুলে ধরতে পারলে বক্তব্য আকর্ষণীয় হবে। যেকোনো মূল্যে সমাজ পরিবর্তনের প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। মসজিদে রাজনৈতিক বক্তব্য বা বিশেষ কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে সরাসরি বক্তব্য রাখা যুক্তিযুক্ত তো নয়ই, এমনকি কাক্সিক্ষতও নয়। রাজনীতির জন্য আলাদা প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। মুসল্লিদের মধ্যে নানা পথ ও মতের মানুষ থাকেন। ইবাদতের জন্য তারা মসজিদে আসেন; আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর কথা শোনার জন্য আসেন। এ ব্যাপারে ইমাম ও খতিবদের সতর্কতা প্রয়োজন। হক কথা বলতে হবে; করতে হবে জুলুমের প্রতিবাদ; দাওয়াতি রীতি ও অন্তরের দরদ নিয়ে। দাওয়াতি স্টাইলে বললে মানুষের মনে দাগ কাটে। আর রাজনৈতিক স্টাইলে বললে জিঘাংসা মনোবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
drkhalid09@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।