Home ফিকহ ও মাসায়েল ‘ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ হারাম: সর্বস্তরের মুসলমানকে এই পাপের লাগাম টেনে ধরতে হবে’

‘ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ হারাম: সর্বস্তরের মুসলমানকে এই পাপের লাগাম টেনে ধরতে হবে’

ট্রান্সজেন্ডার মতবাদকে ‘হারাম’ ঘোষণা করে ফতোয়া ‍দিয়েছে দেশের শীর্ষ ইসলামী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম হাটহাজারী (মাদরাসা মাদরাসা)। একইসাথে দেশের অন্যতম প্রাচীন এ কওমি মাদরাসাটি এ মতবাদকে ‘অভিশপ্ত’ আখ্যা দিয়েছে।

বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) প্রতিষ্ঠানটির ফতোয়া ও ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগ থেকে পাঁচজন মুফতি স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে (ফতোয়া) এ ঘোষণা দেয়া হয়। হাটহাজারী মাদরাসার অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে আজ দুপুরে ফতোয়াটি প্রচার করা হয়।

সদ্য ঘোষিত ফতোয়ায় স্বাক্ষর দানকারী পাঁচজন মুফতি হলেন- মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক ও মুহাদ্দিস- মুফতি কিফায়াতুল্লাহ, মুফতি জসীমুদ্দীন, মুফতি আবু সাঈদ, মুফতি হুমায়ুন কবীর ও মুফতি মুহাম্মদ রাশেদ।

ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ বিষয়ক হাটহাজারী মাদরাসার ফতোয়াটি নীচে তুলে ধরা হলো-

সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পুরুষ বা নারী হিসেবে সৃজন করেছেন। যাদের দেহ শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি তারা পুরুষ, যাদের দেহ ডিম্বাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি তারা নারী। এটা শুধু বাহ্যিক যন্ত্রপাতির বিষয় না ; পুরো প্রজননব্যবস্থার বিষয়।

মানবজাতির খুব অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ আছেন যাদের প্রজননব্যবস্থা এবং যৌন বিকাশের ত্রুটি থাকে। বাহ্যিকভাবে তাদের দেহে জন্মগতভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ দেখা যায়। এধরনের মানুষকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতে হয় ইন্টারসেক্স (Intersex) বা আন্তঃলিঙ্গ শব্দ। আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত হিজড়া বলতে মূলত ইন্টারসেক্স বা আন্তঃলিঙ্গ মানুষদের বুঝিয়ে থাকে ; এর বাইরে তৃতীয় কোনো লিঙ্গ আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেননি। আর এটাই ছিলো সর্বমহলে সমাদৃত।

এভাবে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললেও থেমে থাকেনি পশ্চিমাদের অপতৎপরতা। নতুন চিন্তা, নতুন মতবাদ হিসেবে এরা বিশ্বের সামনে উপস্থিত করে ট্র‍্যান্সজেন্ডার নামের এক নতুন বিকৃত যৌনচার । এর মূলে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের ব্যক্তি স্বাধীনতার কখনো বাধ্য করে, কখনোবা কৌশলে এই চিন্তাধারা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী।

অথচ ১৯৬৫ সনের আগ পর্যন্ত এমন বিকৃত চিন্তাধারার কোনো আওয়াজ ছিলো—এমন তথ্য পাওয়া যায় না। যার প্রবক্তারা পৃথিবীবাসীকে এমন এক পথের দিকে আহ্বান করছে , যেখানে শরীর নয়, মনই ব্যক্তির আসল লিঙ্গ-পরিচয়। অর্থাৎ একজন পুরুষের যদি মনে হয় সে নারী, তাহলে সে নারী। আবার একজন নারীর যদি মনে হয় সে পুরুষ, তাহলে সে পুরুষ। মোটকথা তারা দাবি করে, তাদের মানসিক লিঙ্গ শারীরিক লিঙ্গ থেকে ভিন্ন। এ জন্য তারা মানসিক লিঙ্গবোধ অনুযায়ী শরীরে পোশাক-আশাক পরিধান করে থাকে। তাদের দাবী হলো ; তাদের বাহ্যিক লিঙ্গ আর বিকৃত চিন্তাগত লিঙ্গ দুটো ভিন্ন ভিন্ন। এরা আরও দাবি করে ;ডাক্তারের সাহায্যে তাদের মনের রূপকে বাস্তবেই রূপান্তর করা সম্ভব। এইজন্য দেখা যাই যে, ডাক্তারের সাহায্যে অস্ত্রোপচার করে তারা তাদের মনের রূপকে বাস্তবে রূপান্তর করার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে । আর সেই বেশেই এরা এখন নিজেকে প্রদর্শন করছেন।

☞ চিকিৎসার মাধ্যমে কি মনের রূপকে বাস্তবে রূপান্তরণ করা সম্ভব?

প্রকৃত বাস্তবতা হলো;তথাকথিত লিঙ্গ পরিবর্তন সার্জারির মাধ্যমে কেউ আসলে পুরুষ থেকে নারী বা নারী থেকে পুরুষ হয় না। মূলত এগুলো এক ধরনের কসমেটিক সার্জারি। এ ধরণের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেবল বাহ্যিকভাবে কিছু পরিবর্তন আনা যায়, সৃষ্টিগত লিঙ্গের কোনো পরিবর্তন করা যায় না। এইজন্য কোনো ট্র‍্যান্সজেন্ডার মেয়ে যার জন্ম হয়েছে পুরুষ হিসেবে, শত অস্ত্রোপচার করা হলেও কোনো দিন তার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব নয়। অথচ মা হতে পারা স্ত্রী লিঙ্গ হওয়ার সবচেয়ে বড় আলামত। কারণ ট্র‍্যান্সজেন্ডার মেয়ের বাচ্চাদানি থাকে না। তেমনি কোনো ট্র‍্যান্সজেন্ডার পুরুষের পক্ষে কোনো দিন বাবা হওয়া সম্ভব নয় । তাদের এই দাবি অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রূপান্তর সম্ভব ; প্রতারণা আর ধোঁকা বৈ কিছুই না।

☞ ট্র‍্যান্সজেন্ডার মতবাদের সামাজিক ক্ষতি

ট্র‍্যান্সজেন্ডারের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো সমকামিতাসহ অন্যান্য বিকৃত যৌনতার প্রসার। কারণ, একজন ট্র‍্যান্সজেন্ডার মেয়ে (যে কিনা বাস্তবেই একজন পুরুষ) যখন কোনো পুরুষের প্রতি আসক্ত হয়ে মেয়ের রূপ ধারণ করবে,পরবর্তীতে বিয়ে করে তার সাথে মিলন করবে, বাস্তবে মিলনটা হবে পুরুষে-পুরুষে। কারণ একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টিগত লিঙ্গের পরিবর্তন সম্ভব নই। আর পুরুষের সাথে পুরুষের মিলন এবং নারীর সাথে নারীর মিলনের নাম হলো সমকামীতা। যা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। হযরত লূত আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্প্রদায়কে এই পাপের কারণে আল্লাহ তায়ালা ভূমি উল্টিয়ে এবং পাথুরে বৃষ্টি বর্ষণ করে ধ্বংস করেছেন।

আরও পড়তে পারেন-

দ্বিতীয়ত: ট্র‍্যান্সজেন্ডারকে যদি বৈধতা দেওয়া হয় এবং মনের রূপকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা ট্র‍্যান্সজেন্ডার মেয়েদের যদি মহিলা বিশেষায়িত স্থান তথা মহিলা হোষ্টেল ইত্যাদিতে প্রবেশের অবাধ অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে সুকৌশলে ব্যভিচারের পথকে আরো সহজ করে দেওয়া । কারণ আমরা আগেও উল্লেখ করছি, অস্ত্রোপচার বা অন্য কোনো মাধ্যমে শরীরের কিছু পরিবর্তন আসলেও তাদের সৃষ্টিগত লিঙ্গের কোনো পরিবর্তন হয় না। সুতরাং এভাবে একজন ট্র‍্যান্সজেন্ডার মেয়েকে(যে কিনা বাস্তবে একজন পুরুষ) মহিলা বিশেষায়িত স্থানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া তার জন্য ধর্ষণের পথ খুলে দেওয়া নয়কি?যেমনটা ঘটেছে অ্যামেরিকাতে।

২০১১ সালে হত্যার দায়ে ত্রিশ বছরের জেল হয় ডেমিট্রিয়াস মাইনর নামের এক যুবকের। ৯ বছর জেলে খাটার পর হঠাৎ করে নিজেকে নারী দাবি করতে শুরু করে সে। ট্র‍্যান্সজেন্ডারবাদের বিষে আচ্ছন্ন অ্যামেরিকান বিচারব্যবস্থা এ দাবি মেনে নিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয় এক মহিলা কারাগারে। কারাগারে নারীদের সাথেই এক সাথে রাখা হয় আপাদমস্তক পুরুষ ডেমিট্রিয়াসকে। ফলে যা হবার তাই হয়, ডেমিট্রিয়াসের সাথে শারীরিক সম্পর্কের জের ধরে গর্ভবতী হয়ে পড়ে দুই নারী কয়েদী। এ ঘটনার পর ডেমিট্রিয়াসকে আবারো পাঠানো হয় পুরুষদের কারাগারে।

☞ ইসলামি শরীয়ার দৃষ্টিতে ট্র‍্যান্সজেন্ডারের বিধান ও আমাদের করণীয় ;

আল্লাহ তায়ালা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। যাকে যেভাবে সৃজন করার দরকার তাকে সেই রূপেই সৃজন করেছেন। মানুষকে জমিনে নিজের খলিফা হিসেবে মনোনীত করেছেন।এবং মানবজাতির হেদায়েতের জন্য বিভিন্ন বিধান অবতীর্ণ করেছেন।ক্ষেত্র বিশেষে নারী-পুরুষের বিধান গুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে ।এখন যদি এর বিপরীতে গিয়ে সবাইকে তার মনের রূপকে রূপান্তর করার অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে পূরো সমাজের ব্যবস্থার চিত্রটায় পাল্টে যাবে এবং ইসলামি শরীয়াহ পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে যাবে। যা আল্লাহর সাথে বিদ্রোহের নামান্তর। পশ্চিমা বিশ্ব এইটা বিশ্বব্যাপী চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের অজান্তেই তাদের ফাঁপা বুলি ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর আঘাত করছে। সাথে সাথে ঈমান বিধ্বংসী এই ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃতির সবক দেয়। আর আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন করা অত্যন্ত পাপ ও হারাম কর্ম। যা আজ পশ্চিমা বিশ্বের দোসররা মুসলিম দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর এবং তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় দিবানিশি কাজ করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সর্বস্তরের মানুষের দায়িত্ব, ঈমান বিধ্বংসী এই ফিতনার লাগাম টেনে ধরা এবং এর প্রসার রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। অন্যথায় এই পাপের শাস্তি হিসেবে যদি আল্লাহ তায়ালার গজব নেমে আসে, তাহলে তা আমি, আপনি এবং আমাদের সবাইকে গ্রাস করে নিবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমরা ভয় করো ওই শাস্তিকে, যেটা শুধু তোমাদের মাঝে সীমালঙ্ঘনকারীদের উপর আসবে না (বরং শক্তি ও সমর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা এটা প্রতিহত করেনি, তাদেরকেও গ্রাস করে নিবে)।

তথ্যসূত্র- সূরায়ে নিসা- ১১৯, তাফসীরে কাবীর- ৪/২২৩, সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৫৮৮৫ ও ৫৮৮৬, ফাতহুল বারী- ১/৩২৩, তাফসীরে কুরতুবী- ৫/৩৯১, সূরায়ে আনফাল- ৯-১০ আয়াত।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।