Home ইতিহাস ও জীবনী মাকারিমে আখলাক: নববী আচরণ-সৌন্দর্য

মাকারিমে আখলাক: নববী আচরণ-সৌন্দর্য

।। বিনতে জাহাঙ্গীর ।।

আখলাক বা চরিত্র মানব-জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক গুণ বা সৌন্দর্য। চারিত্রিক সৌন্দর্যহীনতা একটি পরিবার, সমাজ তথা গোটা জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। জাহেলি যামানার চরিত্রহীনতার সেই অমাবস্যায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছিলেন ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ হয়ে। তাঁর পবিত্র জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে হাজারো চরিত্র-মাধুরীর হৃদয়ছোঁয়া আফসানা। নববী সীরাত আমাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দেয় ‘উত্তম চরিত্রও এক মহৎ ইবাদত’। 

আখলাকের তাৎপর্যঃ

নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মুমিন তাঁর মহৎ গুন ও সুন্দর চরিত্রের কল্যাণে রাতে সালাত ও দিনে সিয়াম পালনকারীর মর্যাদা ও পুরস্কার লাভ করে’। (সুনানে তিরমিযী- ১০৮২)।

নবীজি আরো ইরশাদ করেন, ‘আমি জান্নাতে নিম্নভূমিতে অবস্থিত একটি বাড়ির যিম্মাদার। বাড়িটি ঐ ব্যক্তির জন্য যে অধিকার থাকা সত্ত্বেও তর্ক করে না, ঝগড়া পরিত্যাগ করে। এবং জান্নাতের সাধারণ উচুঁ ভূমিতে অবস্থিত একটি বাড়ির যিম্মাদার ওই ব্যক্তির জন্য, যে মিথ্যা বর্জন করে। ঠাট্টা-রসিকতা করেও মিথ্যা বলে না। আর আমি জান্নাতে সবচেয়ে উচুঁ ও অভিজাত ভূমিতে অবস্থিত বাড়ির যিম্মাদার ওই ব্যক্তির জন্য, যার আখলাক ভালো ও চরিত্র সুন্দর’। (ইসতামতি বিহায়াতিক)।

হযরত উম্মে সালামা (রাযি.) নবীজিকে প্রশ্ন করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন মহিলার দুজন স্বামী ছিল (অর্থাৎ- ১ম জনের মৃত্যুর পর অন্যজনকে বিবাহ করেছে), মৃত্যুর পর তারা তিনজনই জান্নাতী হয়েছে। তবে মহিলাটি কার সঙ্গে থাকবে? নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার আচরণ ও ব্যবহার সবচেয়ে ভাল ছিল, তার সঙ্গে থাকবে’। (ইসতামতি বিহায়াতিক)।

খুলুকুন আযীম

রব্বে কারীম স্বীয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে ইরশাদ করেন-‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা কলাম- ৪ আয়াত)।

স্বয়ং নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয় আমি উত্তম চরিত্র পূর্ণতা দানের নিমিত্তে প্রেরিত হয়েছি’। (আদাবুল মুফরাদ- ১২২)।

ইহসানকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা

মক্কায় কাটানো দিনগুলোকে স্মরণ করে নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন- ‘আমি মক্কার মানুষের ছাগল চড়ানোর কাজ করতাম’। (আত-তারিখুল কাবির- ১৩১, তারিখুত তাবারি- ৩৯৩, আস-সুনানুল কুবরা- ১৫৯৮০)।

বার্তাঃ সুউচ্চ রুচি, তীক্ষ্ন অনুভূতির পরিচায়ক ছিল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম গুণ। চাচা তাঁকে বাবার স্নেহে আগলে রেখেছেন। জীবিকা উপার্জনের মাধ্যমে পিতৃতুল্য চাচার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তিনি । এ ছিল নবীজির কৃতজ্ঞশীলতার বহিঃপ্রকাশ।

সকলের প্রতি সদাচার-সহযোগিতা

জীবনের চল্লিশতম বর্ষে হেরা গুহার ধ্যানমগ্নে নাযিল হয় জান্নাতি আলোড়ন। সূরা আলাকের কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে সূচিত হয় নবুওয়তি জীবনের পবিত্র শুভযাত্রা। প্রিয় নবীজি কাঁপছিলেন ভয়ে । ফিরে এলেন ঘরে। খাদিজা (রাযি.)কে বললেন, ‘আমায় চাদরাবৃত করো, আমি নিজের ব্যাপারে ভয় করছি’। ঘটনার অদ্যোপান্ত সব শুনে চেহারায় আশ্বাসবাণী ফুটিয়ে খাদিজা (রাযি.) বললেন- ‘আল্লাহর কসম! কক্ষনো না। আল্লাহ তাআলা আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম আচরণ করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, দরিদ্রকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন’। (সহীহ বুখারী- ১৭৩)।

বার্তাঃ নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী- ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐব্যক্তি যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।’ নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম আচরণ, দয়াদ্রতার প্রতি নিজ সহধর্মীনির এতটাই আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, এমন মহান চরিত্রের মানবের প্রতি কোন খারাপ কিছু হবে না। কোন জিন ইত্যাদি তাঁর ক্ষতি করতে পারবে না।

দীনের তরে কষ্টবরণ

সকলের প্রিয় আল-আমিন মুহাম্মাুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অহীর জান্নাতি আলোয় আলোড়িত হলেন। আলোড়িত হল পবিত্রা সহধর্মীনির মনোজগত। সেই নূর আল্লাহর হুকুমে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন নবীজি আশোপাশে, স্বজনদের মাঝে। যুগ যুগে আধাঁরাচ্ছন্ন সমাজের বিশিষ্টরা সহজেই তা মেনে নিতে পারেনি। নির্মমভাবে সাহাবি ও নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর তারা নির্যাতন শুরু করে। ঘৃণ্য-নিষ্ঠুর সব উপায়ে কষ্ট দিতে থাকে প্রাণপ্রিয় নবীজিকে। আহ!

একদা মক্কার এক গলিপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নিষ্ঠুর কাফিরদের অত্যাচার থামলনা। এক কাফির নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মাথায় মাটি নিক্ষেপ করলো। ঘরে ফিরেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবীজির এক মেয়ে মাথা ধুয়ে দেন ও মনোবেদনায় কাঁদতে লাগলেন। নবীজি একটু বদ দুআ করলেন না। করলেন না সামান্য আফসোসও। বরং মেয়েকে বললেন- ‘মা আমার! কেঁদোনা; নিশ্চিত জেনে রাখো, তোমার বাবার হিফাজতকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। (তারিখুত তাবারি- ২/২৪৪, সীরাতু ইবনি হিশাম- ১/১৫৮)।

বার্তাঃ সকল অপমান-লাঞ্ছনার পরেও বদ দুআ দেননি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ব্যথিত স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন এরাই ইসলাম কবুল করবে। আর এ অপমানের বদৌলতে রয়েছে রবের কাছে উত্তম পুরষ্কার। প্রত্যেক যামানায় দীনের দাঈরা এভাবেই প্রথমে বাধাগ্রস্থ হয়। সবর ও ক্ষমার মাধ্যমে অচিরেই ফিরে সফলতা।

বিনম্রতার প্রতীক

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদীনায় আগমন। ‘আমাদের উপর চাঁদ উদিত হয়েছে/ বিদা’ উপত্যকা হতে’ নাশিদ সুরে উচ্ছসিত প্রতিটি প্রাণ। প্রতিটি দিলের একটিই কামনা ‘হোক নবীজি মোর মেহমান/ কামিয়াব হবে মোর জীবন/ জুড়াবে হৃদয়-প্রাণ!’

মসজিদুন নববী। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুমে খনন করা হল প্রাচীন কবর। কেটে ফেলা হল খেজুর গাছ। গর্তগুলো ভরাট করে সমান করা হল। মসজিদ নির্মাণের কাজে শরীক ছিলেন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও। পাথর স্থানান্তরের কাজও করেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (ই’লামুস সাজিদ, ২২৪-২২৫)।

বার্তাঃ মাদীনার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়েছিলেন পেয়ারে হাবীব সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মক্কার অপমান-অবহেলার পর, মদীনার উষ্ণ-অভ্যর্থনা! কিন্তু বিনম্রতার প্রতীক প্রিয় নবীজি নিজেকে সাধারণ হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। সাহাবীদের প্রতিটি কাজে শ্রম দিয়ে শরীক থেকেছেন। বলেছেন, ‘আমি তো তোমাদের ভাই, আমিও কাজে শরীক হতে চাই!’

অন্যেকে অগ্রাধিকার

ইহুদীদের ইতিহাস সর্বদাই কলুষিত। নিজ নবীদের হত্যা করতে সামান্য দ্বিধাবোধ করে নি এরা। মিত্রতার ভান ধরে ভেতরে পুষত চরম মুসলিম-বিদ্বেষ। মুসলিমদের সাথে সন্ধিবদ্ধ ছিল বনু নাজির। কিন্তু নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয় অহীর মাধ্যমে। দেশান্তরিত কার হয় তাদের। যুদ্ধাস্ত্র ব্যতীত উটের বোঝা পরিমাণ সম্পদ নেয়ার অনুমতি ছিল। বিনা যুদ্ধে অর্জিত সম্পদের মালিক নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যই ছিল বিশেষভাবে। তবুও নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা হতে মুহাজির সাহাবিদের অংশ দেন এবং অতি দরিদ্রতার কারণে দু আনসারি সাহাবি (সাহল ইবনু হানিফ ও আবু দুজানা সিমাক বিন খারশা রাযি.)দেরও দেন। (উয়ুনুল আসার- ২/৫১ পৃষ্ঠা)।

বার্তাঃ অন্যকে অগ্রাধিকারের মহৎ গুণ ছিল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সারাজীবনের আদত। নিজ ব্যক্তিগত সম্পদের থেকে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করে দিতে সামান্যতম দ্বিধাও করেননি। নিজে থেকেছেন অনাহারে-অর্ধাহারে, শোকর-সবরে।

হাসোজ্জ্বল বচন

হযরত আমর বিন আস (রাযি.)। জ্ঞান-গরিমা, মেধা-প্রতিভায় ছিলেন আরবে শ্রেষ্ঠদের অন্যতম। নিজ গোত্রেরও সর্দার ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি যখনই নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আগমন করতেন, তখনই লক্ষ করতেন, নবীজি তাঁকে দেখে মুচকি হাসেন। তার আগমনে আনন্দপ্রকাশ করেন। পছন্দনীয় নামে ডাকেন! আপ্লুত হন আমর (রাযি.)। মনে মনে ভাবেন, আহা! আমিই হয়তো নবীজির সবচেয়ে প্রিয়তম! প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জবানেই শুনতে ইচ্ছে হল নিজের প্রতি নবীজির ভালবাসার কথা। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন- ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে?

নবীজি (সা.) বললেন- ‘আয়েশা’।

আমর (রাযি.) বললেন, ‘না, আমি আসলে জানতে চাচ্ছি – পুরুষদের মাঝে কে অধিকতর প্রিয়?

নবীজি (সা.) বললেন- ‘আয়েশার পিতা (আবু বকর)’।

আমর (রাযি.) বললেন- ‘তারপর?’

নবীজি (সা.) বললেন- ‘উমর বিন খাত্তাব’।

আমর (রাযি.) বললেন- ‘তারপর?’

নবীজি (সা.) এরপর ইসলামের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা সহ্যকারী একেক সাহাবীর নাম ধারাবাহিক বলতে থাকলেন। হযরত আমর (রাযি.) পরবর্তীতে বলেন- ‘আমার নাম সবার শেষে বলেন কিনা, এ ভয়ে আমি চুপ হয়ে গেলাম!’ (মুসতাদরাকে হাকিম- ৪৪০, ইকমালুল মু’লিম শরহু মুসলিম- ১৯৪)।

বার্তাঃ সবার সাথে হাসোজ্জ্বল মুখে কথা বলে, মনের অজান্তেই ‘সর্বোচ্চ ভালবাসা’ হয়ে গেছেন। তাই সকলেই ভাবত ‘আমিও হয়ত নবীজি (সা.)এর সবচেয়ে ভালো লাগা! তাই হয়ত তিনি এত ভালবেসে, এত হাসোজ্জ্বলতা নিয়ে ডাকেন আমায়!’

গরিবদের সাথে আন্তরিকতা

বেদুঈন সাহাবী যাহির বিন হারাম (রাযি.)। মরু এলাকা হতে এলেন নূরের মাদীনায়। প্রথমেই নবীজির দরবারে এলেন। বাড়িতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেলেননা। তাই বিক্রয়ের পণ্যগুলো নিয়ে বাজারে গেলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক বেশি ভালবাসতেন গরিব এই সাহাবীকে। বাড়ি ফিরে নবীজি (সা.) জানতে পারলেন, যাহির শহরে এসেছেন ও তাঁকে খুঁজে গেছেন। নবীজি (সা.) তখনি বাজারে গেলেন, প্রিয় সাহাবীর সাক্ষাতে। দেখলেন, ঘামে ভিজে একাকার যাহির (রাযি.)এর পরিধেয় বসন। ঘামের গন্ধও আসছে কাপড় হতে। পেছন হতেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন মমতায় ।

যাহির (রাযি.) তখনো দেখেন নি নবীজিকে। ঘাবড়ে তাই বলতে লাগলেনÑ ‘কে আপনি? আমাকে ছেড়ে দিন’।

নবীজি (সা.) নিশ্চুপ। মমতায় আরেকটু বেশিই যেন জড়িয়ে নিলেন বুকে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকলেন তিনি। হঠাৎ পিছনে দৃষ্টি ঘুরতেই মুগ্ধ হলেন যাহির (রাযি.)। এ যে তাঁর প্রাণপ্রিয় রাসূল! 

খুশিতে আবেগে এবার নিজ পৃষ্ঠদেশকে নবীজি (সা.)এর পবিত্র বুকে আরো আলতোভাবে মিলিয়ে রাখলেন। নবীজি (সা.) একটু রসিকতা করে উচ্চ আওয়াজে বলতে লাগলেন- ‘কে কিনবে এ গোলামটি? কে নিবে এ গোলামটি?’

নবীজি (সা.)এর কথা শুনে যাহির নিজেকে নিয়ে ভাবলেন যে, সহায়-সম্পদ, অবয়ব-সৌন্দর্য কোনটাই নেই আমার। তদুপরি দরিদ্র-বেদুঈন। অসহায়ভাবে বললেন- ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে তো গোলামটি অনেক সস্তায় বিক্রি করতে হবে।’

নবীজি ভালবাসা-মাধুরি মিশিয়ে বললেন- ‘কিন্তু আল্লাহর কাছে তুমি সস্তা নও। অনেক দামী’। (আহমাদ- ১২৬৬৯, বায়হাকি- ২১৭০৪)।

বার্তাঃ একটু উষ্ণ অভ্যার্থনা ও হাসিমুখের দুটো মধুর বচন, গরিবের দিলে দেয় হাজারো প্রশান্তির সমীরণ!

অধীনস্থদের সাথে কোমলতা

তায়েফের সেই বেদনাদায়ক দিন। স্বজাতির ইসলাম বিমুখতায় হৃদয়ে বড় আশা নিয়ে নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম   এলেন তায়েফে। ইসলামি পয়গাম শোনাতে। তিরস্কার করলো তায়েফবাসি। দুষ্ট ছেলেদের লেলিয়ে দিলো ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যাওয়া নবীজি (সা.)এর পিছে। রক্তাক্ত-জখমি হয়ে গেল কোমল পবিত্র দেহখানি। ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে নবীজি সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসলেন এক আঙুরবাগানের ছায়ায়। রাবিআপুত্র উতবা ও শায়বার বাগানে। বাগানেই ছিল তারা। নবীজি (সা.)এর প্রতি তায়েফবাসির নিমর্মতা তারা অবলোকন করছিল। রাসূলের প্রতি তাদের দিলে দয়ার উদ্রেক হল। খৃষ্টান গোলাম আদ্দাসকে একথোকা আঙুর দিয়ে নবীজি (সা.)এর কাছে পাঠালো। আদ্দাস তাই করলো। নবীজি ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে খেতে শুরু করলেন।

গোলাম আদ্দাস অবাক হয়, এমন কথা তো কারো মুখে শোনা যায় না (তবে কে তিনি?!)! নবীজি (সা.) জানতে চান, তুমি কোন এলাকার ও তোমার ধর্ম কী? সে বলল, আমি ঈসায়ী ও আমার বাড়ি মাওসিলের নিনাওয়া। নবীজির আচরণে মুগ্ধ হয়ে আদ্দাস কাছে এসে হাত-পায়ে চুমু খেতে থাকে ও ইসলাম কবুল করে। (সিরাতে ইবনু হিশাম/১, পৃ: ৪২০)

বার্তাঃ কোমল আচরণ ব্যক্তি জীবনে সফলতার অন্যতম যামানত।

বিরোধীদের সাথে দাওয়াহ প্রদানে সবর

দাওয়াতের এ মহান কর্ম হতে নবীজি (সা.)কে নিবৃত করতে কুরাইশরা ধারাবাহিক প্রচেষ্টা করেই যাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আবু ইমরান এলেন। কুরাইশ নেতৃবর্গের মতই নবীজি (সা.)কে শোনাতে লাগলেন বিভিন্ন কথা- ‘তুমি আমাদের পারস্পরিক ঐক্য নষ্ট করছো। আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করেছো।’

নবীজি (সা.) চুপচাপ শুনতে লাগলেন। তার কথা শেষ হল।

নবীজি (সা.) বললেন- ‘আবু ইমরান! আপনার কথা শেষ হয়েছে?’

সে বলল- ‘হ্যাঁ।’

নবীজি (সা.) বললেন- ‘তবে এবার আমি যা প্রশ্ন করি, উত্তর দিবেন’।

আবু ইমরান বললেন- ‘ঠিক আছে, বলুন’।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-‘আপনি প্রতিদিন কতজন মাবুদের ইবাদত করেন?’

জবাবে বললেন- ‘সাতজনের; ছয়জন জমীনে আর একজন আসমানে’।

আরও পড়তে পারেন-

নবীজি (সা.) বললেন- ‘বিপদের সময় ও সকল আশা-আকাঙ্খা কার কাছে ব্যক্ত করেন? সাতজনের কাছেই?’

‘না, বরং আসমানে যিনি আছেন তাঁর কাছে।’

এবার নবীজি (সা.) সুযোগ মত বললেন, হুসাইন (আবু ইমরান)! যদি আপনি ইসলাম কবুল করতেন, আপনাকে আমি এমন দুটি বাক্য শিখাতাম, যা আপনার জন্য অনেক কল্যাণকর হতো।

নিজ কঠোরতার বিপরীতে নবীজি (সা.)এর কোমল আচরণে মুগ্ধ হলেন আবু ইমরান। সাথে সাথেই ইসলাম কবুল করেন। বিনয়ের সাথে আরয করেনÑ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেই দুআটি এবার শিখিয়ে দিন।’

নবীজি (সা.) বললেন- اَللّهٌمَّ اَلْهِمْنِي رٌشْدِي وَاَعِذْنِي مِنْ شَرِّ نَفْسِي ‘হে আল্লাহ আপনি আমায় সৎ পথে চলার তাওফীক দান করুন এবং আমাকে আমার মাঝের সব ধরণের ক্ষতি হতে রক্ষা করুন’। (মুসনাদে আহমাদ- ১৯৯৯২)।

বার্তাঃ দাওয়াহ এর অঙ্গনে কঠোর আচরণকারীর জবাবে নিশ্চুপ সবর করা, ফলশ্রুতিতে কঠোর আচরণকারীকেই লজ্জিত করে। সবরকারীর প্রতি করে মুগ্ধ-আসক্ত। যা একজন দাঈর অন্যতম গুণ।

ব্যক্তি বুঝে আচরণ

মুয়াবিয়া বিন হাকাম (রাযি.)। বকরীর সবুজ ঘাসের সন্ধানে তিনি চষে বেড়াতেন বিস্তৃত মরুভূমি। সুযোগ সময় মত হাজির হতেন নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে। সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য গ্রহণের সুযোগ হতোনা। একবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তিনি শিখেন হাঁচির মাসআলা। মুসলিম ভাই হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহর জবাবে বলতে হয় ‘ইয়ারহামুকাল্লহ’। ফিরে গেলেন তিনি নিজ বাসস্থানে। অনেকদিন পর ফিরলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে। নবীজির পিছনে নামাযে দাঁড়ালেন। মুসল্লীদের কেউ একজন হাঁচি দিলো। মুয়াবিয়া (রাযি.) উচ্চস্বরে বলে উঠলেন ‘ইয়ারহামুকাল্লহ’। নামাযরত সাহাবিরা আড়চোখে তাকে দেখতে লাগলেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আরে! সকলে এমন করে তাকাচ্ছ কেন!!

সালামান্তে নবীজি (সা.) জানতে চাইলেন, কে কথা  বলেছে? মুবাবিয়া (রাযি.)কে সামনে পেশ করা হল। নবীজি সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমল স্নেহে বলেনÑ ‘মুয়াবিয়া! নামাযে তো কথা বলার অনুমতি নেই। নামায তো কেবল তাসবিহ, তাকবির ও তেলাওয়াতের নাম।’ পরবর্তীতে উক্ত সাহাবি বলতেন, ‘আল্লহর কসম নবীজি (সা.)এর মত উত্তম শিক্ষক আমি জীবনেও দেখিনি’। (হিকায়াতুস সাহাবাহ)।

বার্তাঃ না জেনে ভুলকারী ব্যক্তিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা ও তার জ্ঞানের পরিধি অনুযায়ী বুঝিয়ে বলা।

অসুস্থ রোগীর নিকট দীর্ঘক্ষণ না থাকা

নবীজি (সা.) ইরশাদ- ‘তোমরা অসুস্থ রোগীর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকো না’। (ইবনে মাজাহ- ৩৫৩৩, মুসনাদে আহমাদ- ১৯৭১)।

বার্তাঃ একজন অসুস্থ মানুষ অস্বস্তিতে থাকে। তার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে, তিনি আরো অস্বস্তি ও লজ্জাবোধ করেন। পেয়ারে হাবীব সেই অনুভুতি অনুধাবন করেই বলেছেন। মানুষের দিলের হালত কতটা বুঝতেন তিনি! কত দরদে দিল! প্রত্যেক মানুষের অবস্থা বুঝে আচরণ করা ও অসুস্থতার ব্যাপারে অধিক প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করাও নববী আখলাকের অন্যতম অংশ!

মন্দের বিপরীতে ভাল আচরণ

মসজিদে নববিতে উপবিষ্ট প্রিয় নবীজি (সা.)। তাঁকে ঘিরে বসেছে সাহাবিদের মাজলিস। এক বেদুঈন নবীজি (সা.)এর কাছে এলো। সে নিজে বা অন্য কেউ এক ব্যক্তিকে খুন করে ফেলেছে। রক্তপণ আদায়ের জন্য তার সাহায্য প্রয়োজন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কিছু সাহায্য দান করলেন ও কোমল কন্ঠে বললেন, ‘আমি কি তোমার সাথে উত্তম আচরণ করতে পেরেছি?’

সে বলল, ‘না সদাচারণও করেননি, সৌজন্যমূলক আচরণও করেননি’।

সাহাবিরা প্রচন্ড রাগ হলেন। নবীজি (সা.) নিজ ঘরে গেলেন এবং ডেকে নিলেন বেদুঈন সাহাবিকেও। ঘরে যা ছিল, তা থেকে আরো কিছু দিলেন বেদুঈনকে। এবার বললেন, ‘এখন কি আমি উত্তম আচরণ করতে পেরেছি তোমার সাথে?’

বেদুঈন এবার বলল, ‘হ্যাঁ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে আমার পরিবার ও গোত্রের পক্ষ তে উত্তম প্রতিদান দান করুন।’

নবীজি (সা.) এবার বললেন- ‘তুমি এসেছিলে কিছু সহায়তার জন্য। আমরা যতটুকু সম্ভব দিয়েছি। এরপর তুমি যা বলার বলেছো। আমার সাহাবীরা কষ্ট পেয়েছে। এখন সবার সামনে তুমি ‘কৃতজ্ঞতার’ এই বাক্যগুলো বলো। তাহলে তাঁদের মনোকষ্ট দূর হবে।’

সাহাবিদের মজলিসে ফিরে এলেন নবীজি (সা.), সাথে বেদুঈন সাহাবিও। নবীজি (সা.) বললেন- ‘সে এসেছিলো কিছু সহায়তার জন্য। আমরা যতটুকু সম্ভব দিয়েছি। এরপর সে অসৌজন্যমূলক কিছু কথা বলে ফেলেছে। আমি তাঁকে আরো কিছু দিয়েছি। এখন সে বেশ খুশি!’

বেদুঈনের দিকে ফিরে নবীজি (সা.) বলেন- ‘তাই নয় কি?’

বেদুঈন এবার বলল, হ্যাঁ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে আমার পরিবার ও গোত্রের পক্ষ তে উত্তম প্রতিদান দান করুন’।

বেদুঈন চলে গেল। নবীজি এবার সাহাবিদের বলেন- দেখো বেদুঈনের অসৌজন্য আচরণের জবাবে তোমরা যা করতে যাচ্ছিলে, আমি যদি তাতে সায় দিতাম, তবে সে জাহান্নামী হয়ে যেত। অর্থাৎ তোমরা তাকে তাড়িয়ে দিলে সে মুরতাদ হয়ে জাহান্নামি হয়ে যেত। (মুসনাদুল বাযযার)।

বার্তাঃ অশোভন আচরণের জবাবে সদাচার, অনেক বড় ক্ষতি হতে বাঁচিয়ে রাখে।

উম্মাহ২৪ডটকম:আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।