Home আন্তর্জাতিক পাকিস্তানের ‘জেনারেলদের’ নির্বাচন যেভাবে ইমরান ম্যাজিকে পরিণত হলো

পাকিস্তানের ‘জেনারেলদের’ নির্বাচন যেভাবে ইমরান ম্যাজিকে পরিণত হলো

পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ, চলছে শেষ মুহূর্তের গণনা। এই নির্বাচনে ব্যালট পেপারে ছিল টেবিল, চেয়ার, আপেল, উড়োজাহাজ, ক্যালকুলেটর এবং রান্নাঘরের যন্ত্রপাতিসহ বহু প্রতীক। কিন্তু সেখানে জায়গা হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআই-এর প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটের।

কেননা কারাবন্দি ইমরান খানের দলের প্রতীককে বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। যা দেশটিতে থাকা বিপুল সংখ্যক নিরক্ষর মানুষের থেকে ইমরানের দলের ভোট প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সেক্ষেত্রে পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে অন্যান্য প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

তবে অভিযোগ রয়েছে, দেশটির নির্বাচনের প্রকৃত ক্ষমতা কখনোই ব্যালট পেপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং জনরায়কে উপেক্ষা করে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে দেশটির সেনাবাহিনী।

ইতোমধ্যেই নির্বাচনটিকে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে কারচুপির নির্বাচন বলা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একে বিদ্রুপ করে ‘জেনারেলদের নির্বাচন’ বলেও অভিহিত করা হচ্ছে। এটি থেকেই পারমাণবিক শক্তিধর দেশটিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাবের বিষয়টি আঁচ করা যায়।

সেক্ষেত্রে ভোটের আগেই অনেকটা স্পষ্ট ছিল যে, সরকার যেই গঠন করুক না কেন পেছন থেকে দেশ পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে। আর নবনির্বাচিত সরকারকে টিকে থাকার জন্য জেনারেলদের সমীহ করেই চলতে হবে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭৬ বছরের ইতিহাসে পাকিস্তানে একটি ‘হাইব্রিড রেজিম’ গড়ে উঠেছে। যাতে রয়েছে রাজনীতি এবং নির্বাচনি গণতন্ত্রে সামরিক হস্তক্ষেপের মিশ্রণ। এক্ষেত্রে অনেকটা পরোক্ষভাবে দেখা যায় যে, জেনারেলরা দেশটির প্রতিরক্ষা এবং বিদেশি নীতিগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। আর দেশীয় আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলি রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির হাইব্রিড মডেলেও পরিবর্তন আসছে। যা দেশটির জন্য আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি বয়ে আনতে পারে। কেননা একদিকে যেমন সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। কিন্তু তার পালটা তীব্র প্রতিক্রিয়াকে সামাল দেওয়ার জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে যে প্রস্তুতির দরকার, সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে ইমরান খান সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারানোয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতেই চরম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে প্রবীণ রাজনীতিবিদ নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন)। ধারণা করা হচ্ছিল যে, হয়ত খুব সহজভাবেই নওয়াজ নির্বাচনে জিতে যাবে।

কিন্তু পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অনুমানের চেয়েও ভালো ফলাফল করছে। এমতাবস্থায় নওয়াজ গতকাল (শুক্রবার) কৌশল পরিবর্তন করে ঘোষণা করেন যে, তিনি জোট সরকার গঠনের কথা ভাবছেন।

নওয়াজ শরীফ বলেন, “অন্যদের সমর্থন ছাড়া সরকার গঠনের জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই আমরা জোটে যোগ দেওয়ার জন্য মিত্রদের আমন্ত্রণ জানাই। যাতে করে আমরা পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের জন্য যৌথভাবে চেষ্টা করতে পারি।”

পাকিস্তানের নির্বাচনী আইন অনুসারে, দেশটির বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী পরবর্তীতে যেকোনো দলে যোগ দিতে পারেন। অন্যদিকে কারাবন্দি ইমরান খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস করার মতো প্রায় ২০০ টি অভিযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জনপ্রিয় এই সাবেক ক্রিকেটার ও রাজনীতিবিদ আরও কয়েক বছর কারাবন্দি থাকতে পারেন।

এক্ষেত্রে লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো এবং ‘মিলিটারি ইনকর্পোরেটেড: ইনসাইড পাকিস্তানের মিলিটারি ইকোনমি’ এর লেখক আয়েশা সিদ্দিকা অবস্থাটিকে পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য মোটেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। তিনি বলেন, “সংসদে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে এটি একটি অরাজক ও হাস্যকর জাতীয় সংসদ হবে। যেখানে প্রত্যেকে একে অপরের ঘায়েল করতে চাইবেন।”

আরও পড়তে পারেন-

পাকিস্তানের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিবিড়ভাবে তদারকি করেছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আসিম মুনির। একইসাথে দেশটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটের মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে।

এদিকে ইমরান খান জেলবন্দি থাকলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি এখনো বেশ শক্তিশালী। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দাবি, তার বিরুদ্ধে করা অগণিত আইনি অভিযোগগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এক্ষেত্রে ২০২২ সালের নভেম্বরে জেনারেল মুনির সেনাপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে ইমরান খানের আইনি সমস্যা বহুগুণ বেড়েছে। পাকিস্তানি মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মুনিরকে পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান থেকে সরিয়ে অন্য একজন অনুগতকে বসান। সেখান থেকেই এই দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরে।

এদিকে গত ৩ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ঠিক কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের এক আদালত ইমরান খান এবং তার স্ত্রী বুশরা বিবির বিয়েকে ‘অ-ইসলামিক’ বলে একটি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। যদিও এই রায় আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।

তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ে প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন বরং ইমরান খানকে সামরিক বাহিনীর সমর্থিত প্রার্থী হিসাবে মনে করা হয়েছিল।

ইমরান খান ও নওয়াজ শরীফের ভাগ্যের পরিবর্তন যেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে নাটকীয়তাকেই ফুটিতে তোলে। অনেকেই আবার এটিকে বিদ্রুপ করে বিখ্যাত ‘গেম অফ থ্রোনস’ সিরিজের সাথে তুলনা করেছেন।

এদিকে চার বছর নির্বাসনে থাকার পর গত অক্টোবরে পাকিস্তানে ফিরে আসেন নওয়াজ। তার প্রত্যাবর্তনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হয়ত তাকেই ক্ষমতাশীলরা সবচেয়ে বেশি বিবেচনা করছে।

এদিকে স্বাধীনতার সাত দশকেরও বেশি সময় পর পাকিস্তান সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। গত বছর আইএমএফ ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেলআউট প্যাকেজ অনুমোদন করায় দেশটি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিল।

তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের পরেও যে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে, সেটা আপাতদৃষ্টিতে মনে যাচ্ছে না।

এ সম্পর্কে আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, “অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থীই পিটিআই সমর্থিত। এক্ষেত্রে যদি শরীফের পিএমএল-এনকে সরকার গঠন করতে হয়, তবে তাদের জোট গঠন করতে হবে। সেক্ষেত্রে জোট যত দুর্বল, সামরিক বাহিনী তত শক্তিশালী হবে।” সূত্র- ফ্রান্স ২৪ ডটকম

অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।