।। মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন ।।
আজ (২০২৪ সাল) থেকে পনের ষোল বছর আগের কথা। তখন ইমামতের সাথে সাথে পুরাণ ঢাকার তাঁতীবাজার ইসলামিয়া মাদরাসায় মুদাররিসী করতাম। টঙ্গি ইজতিমায় গিয়েছিলাম। মাদরাসার উস্তাদ ছাত্রদের সাথে বসা ছিলাম। বাদ জোহর মাওলানা সা’দ সাহেবের বয়ান চলছিল। তখনও সা’দ সাহেব এতোটা প্রসিদ্ধ হননি। তবে ইলিয়াস খান্দানের ব্যক্তি হওয়ায় তার ভক্তের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না। বয়ানে সা’দ সাহেব থেকে বিশেষ দু’টো কথা শুনেছিলাম যা মারাত্মক ভুল ছিল। কথাদু’টো আমার মত আরও অনেকের কাছে হয়তো আপত্তিকর লেগেছিল, কিন্তু তখন সা’দ সাহেবের বিভ্রান্তি নিয়ে কথা বলা শুরু হয়েছিল না বিধায় তারা হয়তো সেগুলো হালকাভাবেই নিয়েছিলেন। কিংবা যথাযথভাবে সিরিয়াসলিই নিয়েছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে বলাও শুরু করেছেন যা আমার জানা নেই। যাহোক মারাত্মক ও বিভ্রান্তিকর সেই কথাদু’টো হল-
(এক) তিনি বললেন: আল্লাহ কোনো আমল করেন না, কিন্তু দাওয়াতের আমল করেন। দলীল কুরআনের আয়াত-وَٱللَّهُ يَدْعُوٓاْ إِلَىٰ دَارِ ٱلسَّلَٰمِ। অর্থ করলেন- আল্লাহ শান্তির গৃহ তথা জান্নাতের দিকে দাওয়াত দেন। কথাটা শোনামাত্রই বলে উঠলাম, এটা আয়াতের অর্থে তাহরীফ (বিকৃতি সাধন)। (উল্লেখ্য- আয়াতটির সঠিক অর্থ হচ্ছে: আল্লাহ শান্তির গৃহ তথা জান্নাতের দিকে আহ্বান জানান।) বললাম, এ আয়াতে ‘দাওয়াত’ শব্দটি দাওয়াত-তাবলীগ অর্থে নয় বরং আহ্বান অর্থে। সম্রাট যেমন তার প্রজাদের আহ্বান জানান। সম্রাট বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দেন না। আমি বলেছিলাম, আয়াতের এই ‘দাওয়াত’ শব্দটি যদি দাওয়াত ও তাবলীগ অর্থেই হয়ে থাকবে, তাহলে আল্লাহ কার কাছে বা কার বাসায় দাওয়াত দিতে যান, সাথে গাশতের সঙ্গী কারা থাকেন? সা’দ সাহেবের মতো তাবলীগের আরও কিছু ভাইও বলে থাকেন- আল্লাহ কোনো আমল করেন না, কিন্তু দাওয়াতের আমল করেন। সম্ভবত সা’দ সাহেবের কথারই অবুঝ-প্রতিধ্বনি।
উল্লেখ্য, আল্লাহ কোন আমল করেন- এভাবে বলাটাও গলত। কারণ ‘আমল’ (আমলে সালেহ) বলাই হয় যা দ্বারা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য থাকে এবং ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক তা করা হয়।এখন আল্লাহ আমল করেন বললে তিনি আবার কোন্ আল্লাহর আনুগত্য করেন, কার্ সন্তুষ্টি সন্ধান করেন এবং আল্লাহর জন্য আবার শরীয়ত কী? নাঊযু বিল্লাহ!
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
(দুই ) তিনি বললেন: হযরত ইউনুস আ. দাওয়াতের কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণেই তার উপর আযাব এসেছিল। শুনেই বলে উঠলাম, নাঊযু বিল্লাহ! এটা তো ইসমতে আম্বিয়ার আকীদা পরিপন্থী কথা। এটা ঈমান বিরোধী কথা। উল্লেখ্য, জুমহুর আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা হল- আম্বিয়ায়ে কেরাম মা’সূম তথা গোনাহমুক্ত (قبل النبوة وبعدها)। এখন যদি বলা হয়, দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দেওয়ার কারণে ইউনুস আ.-এর উপর আযাব এসেছিল, তাহলে একথাই বলা হবে যে, তিনি গোনাহ করেছেন। গোনাহ না করলে তো আযাব আসে না। তদুপরি দাওয়াত দেওয়া নবীদের নবুয়তী দায়িত্ব। অতএব একজন নবী তার নবুয়তী দায়িত্ব পালন করেননি বলা সেই নবীর প্রতি কতো বড় অপবাদ আরোপ!
যাহোক কথাগুলো শোনার পর আমার মাথায় রাগ উঠে যায়। এইসব ভুল-ভ্রান্তি শোনার জন্যই কি এজতেমায় এসেছি! সময় নষ্ট করা! উঠে চলে আসি এই বলে যে, উনার বয়ান শুনতে চাই না, উনি কুরআন হাদীছের তাহরীফ করেন, উনার নজরিয়া (চিন্তাধারা) সহীহ নয়। কয়েক বছর পূর্বে হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব -দামাত বারাকাতুহুম- যখন সা’দ সাহেবের ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে লিখছিলেন, এক উমরার সফরে আমরা একত্রে ছিলাম। তিনি আমার থেকে এই কথাগুলো রেকর্ড করে নিয়েছিলেন।
এখন ভাবি- কতই না ভাল হতো যদি সেদিন রাগ করে উঠে না এসে ধৈর্য ধরে তার পুরো বয়ানটা শুনতাম এবং নোট করে রাখতাম। নোট করে রাখলে ভাল হত এজন্যই বলছি, তিনি সেদিন আরও এমন কিছু কথা বলেছিলেন যা আপত্তিকর মনে হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে মনে থাকেনি। নোট থাকলে এখন উম্মতকে জানাতে পারতাম।
সেই যে ইজতেমা থেকে উঠে এলাম, তখন থেকেই আমি মাওলানা সা’দ সাহেবের বিরুদ্ধে বলে আসছি। উলামায়ে কেরাম আরও দশ বারো বছর পর বলা শুরু করেছেন। সেই সময় থেকে আমি সা’দ সাহেবের এসব বক্তব্যসহ তাবলীগের আরও কিছু বিষয় অনেক আলেমের কাছে পেশ করে বলে আসছিলাম, তাবলীগ জামাত এভাবে গোমরাহির দিকে চলে যেতে পারে। এই জামাতকে রক্ষা করার স্বার্থে এখনই আমাদের মুখ খোলা দরকার। কিন্তু অনেকেরই মনোভাব যেটা বুঝেছি তা হল- মাঠে ময়দানে আমাদের একটিমাত্র জামাতই তো আছে, কিছুটা সয়ে যাই না কেন। আসলে কিছুটা সয়ে যাওয়া তো খারাপ ছিল না, কিন্তু আমরা একটু বেশিই সয়ে গেছি। আর এখন তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি।
যখন আমি সা’দ সাহেবের বিরুদ্ধে বলা শুরু করেছিলাম, অনেক ঘনিষ্ঠজনও -যারা সা’দ সাহেবের ভক্ত ছিলো- আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিল যে, উনি সা’দ সাহেবের মতো লোকের বিরুদ্ধে বলেন! অবশ্য এখন তারা আমার চেয়েও বেশি সোচ্চার।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ