Home সম্পাদকীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল, যানজট ও জনদুর্ভোগ থামানো...

জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল, যানজট ও জনদুর্ভোগ থামানো যাবে না

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েই চলেছে। গত ১৫ জানুয়ারী থেকে দেশে ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। সঙ্গতকারণেই এ সময়ে সড়কে বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনার হার কমে আসার কথা থাকলেও আদতে বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। নতুন বছরের শুরুতে ট্রাফিক পক্ষ পালনের মধ্য দিয়ে সড়কে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা কমার যে প্রত্যাশা জনমনে জেগেছিল তা ইতিমধ্যে চুপসে গেছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী নতুন বছরের শুরুতে সড়ক দূর্ঘটনা ভয়াবহ পর্যায়ে ঠেকেছে। প্রতিদিনই অসংখ্য দুর্ঘটনার খবর আসছে গণমাধ্যমে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় নিহতের চেয়ে আহত,পঙ্গুত্ব বরণকারী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। একটি জাতীয় দৈনিক তাদের রিপোর্টে সড়কপথে গত ৬৯৭ দিনে ৬ হাজার ৭৩জন মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে। এটা কোনো নতুন তথ্য নয়। সড়কের এই প্রাণঘাতী রূপ নিয়ে মানুষের উদ্বেগ, অস্বস্তি ও ভোগান্তি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, আন্দোলন ও প্রতিশ্রুতিও কম হয়নি। বাস্তবে কোনো পরিবর্তন বা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

গত আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবীতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসার পর সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সড়ক নিরাপত্তায় যে সব প্রতিশ্রæতি ও পরিবর্তনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল ট্রাফিক শৃঙ্খলাপক্ষেও তার ইতিবাচক প্রতিফলন না থাকা হতাশাজনক। এতদিনে এটা পরিস্কার যে, যানজট নিরসন এবং সড়ক ও গণপরিবহণে শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তায় গৃহিত সরকারী উদ্যোগগুলো তেমন কোনো কাজে আসছে না। দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের অন্যতম লাইফ লাইন,সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার পরও যানজট ও দুর্ঘটনা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এখনো প্রায়শ এই মহাসড়কে ২০-৩০ কিলোমিটার লম্বা যানজটের খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

ট্রাফিক পক্ষ পালন জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আইন অমান্যকারী হাজার হাজার চালক ও পরিবহনের বিরুদ্ধে মামলা, জরিমানা আদায় ইত্যাদি সব উদ্যোগ সত্তে¡ও সড়ক পথের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন না আসায় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নতুন ভাবে চিন্তা করে উদ্যোগ নিতে হবে। যে হারে দুর্ঘটনা ঘটছে, যানজট ও বিশৃঙ্খলার শিকার হচ্ছে সড়কের যাত্রীরা, সড়ক ও গণপরিবহণের উপর সে অনুপাতে নজরদারি ও আইনানুগ ব্যবস্থা গৃহিত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে অবশ্য সংশয় আছে। হাইওয়ে পুলিশের কার্যকারিতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সড়ক পরিবহন খাতের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, নজরদারি, জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

সড়কে নিরাপত্তাহীনতা,যানজট, বিশৃঙ্খলা, সাধারণ মানুষের জিম্মিদশা ইত্যাদি আমাদের সামগ্রিক সমাজবাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বিগত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী যখন সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের নেতা হিসেবে বেপরোয়া আচরণের বহি:প্রকাশ ঘটান, যখন সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের আকষ্মিক কর্মবিরতিতে সারাদেশের মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে, বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ রাজপথে নিগৃহীত হয়, তখনো এসব ঘটনার নেপথ্য ব্যক্তিরা ধরা ছোঁয়ার উর্ধ্বে থেকে যায়। এসব উদাহরণই বলে দেয় গণপরিবহন খাতের শীর্ষ ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা কেন আগের চেয়েও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচে অবকাঠামো উন্নয়ন, মহাসড়কগুলোকে চারলেন বা আটলেনে উন্নীত করলেই যে যানজট ও দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয় তা ইতিমধ্যেই প্রমানীত হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে আলোচনা-সমালোচনা, বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্তে¡ও ঢাকার ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকার বেশীরভাগ বাণিজ্যিক ভবনেই গ্যারেজ নেই। ব্যক্তিগত গাড়ীগুলো মূল রাস্তা দখল করে রাখছে। ফুটপাথ হকারদের কাছে ভাড়া দিয়ে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থাকা সিন্ডিকেটের মাসোহারা আদায় বন্ধ হয়নি। এখনো পথচারিরা যত্রতত্র রাস্তা পার হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেও জবাবদিহিতা বা জরিমানার আওতায় আনা হচ্ছে না।

এখনো ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি ও অর্থ আদায় করছে। সড়ক মহাসড়কের দুর্ঘটনা ও যানজট প্রবণ এলাকাগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তিগত নজরদারি ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নের পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল, যানজট ও জনদুর্ভোগ লাঘব হবে না।