।। রিন্টু আনোয়ার ।।
আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে শেষ হলো চার দিনের বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন। ২৬ কোটি মার্কিন ডলারের দু’টি মোটাদাগের বিনিয়োগ প্রস্তাব মিলেছে সম্মেলনটিতে। আরো আছে পাইপলাইনে। তাৎক্ষণিক কত বিনিয়োগ পাওয়া গেল, তা সামিটের উদ্দেশ্য ছিল না; বরং একটি ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন তৈরি করা, মানে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে সম্ভাবনা তুলে ধরা, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পরিচয় করে দেয়া এই সামিটের উদ্দেশ্য। এবারের সামিটে অংশ নেয়া প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ১৮ থেকে ২০ মাসের মধ্যে তাদের অনেকে বিনিয়োগ করবে এমন প্রত্যাশা দেখা দিয়েছে। ঠিক এমন আশাব্যঞ্জক একটি সম্মেলনকালে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত।
মাত্র ক’দিন আগে, ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর অপেক্ষা ছিল দুই দেশের পরিবর্তীত পরিস্থিতি দেখার। আশা করা হচ্ছিল, সম্পর্ক অবনতির পারদ কমবে। কিন্তু, দৃশ্যত ঘটল উল্টোটা। বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। দেশটির বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য রফতানির সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সঙ্গে আবার এ কথাও বলা হয়েছে, এ পদক্ষেপের কারণে নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
বিবেকবান যে কারো পক্ষেই বোধগম্য হবে হীনম্মন্যতার পরিচয় দেয়া ভারতের এই আচরণ। বুঝাই যাচ্ছে,বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত করাই দেশটির উদ্দেশ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ভারতের এ অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ মোটাদাগে উদাহরণ হিসেবে লেখা থাকবে। যেমনটি লেখা হয়ে গেছে, সম্প্রতি শুল্ক ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চিঠি এবং এতে ট্রাম্পের সাড়া দেয়ার ঘটনা। চিঠিতে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশের ওপর আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রস্তাব স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইউনূস। এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আবারো প্রমাণিত হলো। অন্য দিকে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের যুক্তি হিসেবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, একটি বড় সময় ধরে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিতে থাকায় তাদের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে বেশ জট দেখা দিয়েছে। পরিবহন সরঞ্জাম ও অন্যান্য সুবিধা দেয়ার কারণে তাদের নিজেদের রফতানি বিঘ্নিত হচ্ছে। পণ্যের জট তৈরি হচ্ছে। সেই কারণে এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
পরে এক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধির জয়সোয়াল। বিবৃতি বা ব্যাখ্যায় যা-ই বলা হোক, রফতানি প্রশ্নে বাংলাদেশ কিন্তু একটি ধাক্কা খেয়েছে। আর ভারতও তার স্বরূপ আবার প্রকাশ করেছে। অথচ ইউনূস-মোদি বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়েও কথা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বড় বাজার আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ওমান ও কাতার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১০০ দেশে ৩৪১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের খাদ্যপণ্য রফতানি করেছে। আগের অর্থবছরে ছিল ৩৮৩ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার। ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটানসহ ১৪৫টির বেশি দেশে মসলা, জুস, মুড়ি, স্ন্যাকস ও কনফেকশনারিসহ প্রচুর খাদ্যপণ্য রফতানি করে। এতে ধারণা করা যায়, ভারতের একটি মহলের তা সহ্য হচ্ছিল না। বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্যে পোশাক খাতে ভারতের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বাংলাদেশ। যা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে একটি বার্তা দিয়েছে। ঝানু কূটনীতিক এবং বনেদি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, ভারতের এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সাময়িক ধাক্কা খেলেও তা কেটে যাবে। গেল ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি হয়। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকের পরে দুই পক্ষের মধ্যে ইতিবাচকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মতো একটি পরিবেশ তৈরি হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল কিন্তু ঘটল বিপরীত।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বলেছেন, হঠাৎ ভারতের এভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে শেষ পর্যন্ত আমাদের সমস্যা হবে না। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সঙ্কট কাটাতে চেষ্টা করা হবে। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রতিবেশী ভুটান নেপাল ও মিয়ানমার পণ্য পরিবহনের ট্রান্সশিপমেন্ট হঠাৎ বাতিলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সঙ্কট কাটাতে চেষ্টা করতেই হবে বাংলাদেশকে। বাড়াতে হবে নিজস্ব বাণিজ্যিক সক্ষমতা। বাংলাদেশের বাণিজ্য স্থলপথে বন্ধ করতেই ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু নৌপথে যাতে এমন কিছু না হয়, সে জন্য বাংলাদেশকে এখনই সতর্ক হতে হবে।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
এ দিকে, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারত প্রত্যাহারের ফলে মালদ্বীপের সাথে বাণিজ্যে কোনো সমস্যা হবে না বলে এরই মধ্যে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত শাউনিন রশিদ। ভারতের এমন সিদ্ধান্তে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্কে তেমন বড় কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশের সাথে মালদ্বীপের বাণিজ্য অস্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ নেই।
অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বময় কঠিন এ সময়টিতেই ঢাকায় শেষ হলো বিনিয়োগ সম্মেলন। নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের। স্টার্টআপ কানেক্ট অধিবেশনে দেশী-বিদেশী তরুণ ও উদ্ভাবনী উদ্যোক্তারা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল মাধ্যমে রেকর্ড করা বক্তব্য দেন লিংকডইনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রিড হফম্যান। ‘এম্পাওয়ারিং ইনোভেশন কানেকটিং অপরচুনিটি’ শিরোনামের এ বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ কী পেয়েছে, কী পাবে সেই হালখাতা এখনই মেলানো সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে এ সম্মেলনের প্রাপ্তি দৃশ্যমান হবে ধীরে ধীরে। যেকোনো বিনিয়োগকারী দেশে-বিদেশে যেখানেই বিনিয়োগের চিন্তা করেন তার বিনিয়োগকৃত অর্থের নিশ্চয়তাই চাইবেন আগে। বিনিয়োগ করতে কত সময় লাগবে, বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছ থেকে কি রকম সহায়তা মিলবে, তা ভাবতে হয় সব বিনিয়োগকারীকেই। ঢাকায় এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এর একটি বার্তা পেয়েছেন, অথচ বিভিন্ন সরকারের সময়ে বাংলাদেশে সম্ভাব্য বিনিয়োগের আওয়াজ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ বিনিয়োগ করেছে কি না, সেই তথ্য কেউই রাখেন না। বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের কাছেও এ সংক্রান্ত সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন কিছুটা ভিন্ন, অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সরাসরি প্রতিশ্রুতিসহ তালিকা তৈরির কাজ হয়েছে। সে তালিকা অনুযায়ী আগামী ১৮ থেকে ২০ মাসের মধ্যে তাদের সাথে যোগাযোগ ও প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ করানো সম্ভব হবে। বিগত বিভিন্ন সরকারের সময়ে বিনিয়োগ সম্মেলন হতো বিদেশে। যার ফলে বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের সময়, দেশ থেকে দল বেঁধে ব্যাংকাররা যেতেন, সাথে থাকতেন কিছু দলকানা ব্যবসায়ী, আমলা ও বিশেষ কোটারির কিছু সাংবাদিকের লটবহর। সবাই মিলে মোজমাস্তিতে সরকারি টাকা খরচ করে আসতেন। কেউ কেউ থেকেও যেতেন বা পরে সুবিধা মতো সময়ে বিদেশে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এবার সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগের বলটি বাংলাদেশেই এসেছে। সেখানেও পেছন থেকে টেনে ধরার দৃষ্টান্ত ছিল। একটি সুসংবাদ আসতে না আসতেই তা ঢেকে যাচ্ছে কোনো দুঃসংবাদে। খেয়াল করার বিষয়, চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন শুরুর দিনেই তৌহিদি জনতার নামে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।
বিনিয়োগ সম্মেলনটি চলাকালে এই লুটপাট। কথিত ‘তৌহিদি’ জনতার ফিলিস্তিন নিয়ে এই আন্দোলনকারীরা মোটেই তাওহিদ-চর্চাকারী নয়। ইসলামপন্থী বড় বা প্রতিষ্ঠিত কোনো দলের নেতাকর্মীও নয়। কারো নিয়োগে বা বুঝে না বুঝে এসব করে তারা কার স্বার্থ রক্ষা করছে প্রশ্ন থেকেই গেল। বারবার এ জাতের দুর্বৃত্তরা একেকটি অপকর্ম করছে আর ড. ইউনূসকে দৌড়াতে হচ্ছে দেশের মানমর্যাদা রক্ষায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে এ ধরনের হামলার উসকানিটা এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগেই যা ঘটার ঘটিয়ে দিয়েছে তারা। আওয়াজ তোলা হয়েছে বিদেশী পণ্য বর্জনের। বর্জন আর লুটপাট মোটেই এক নয়। দোষটা চাপে মুসলমানদের ঘাড়ে। এই পুরো প্রক্রিয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কখনো ব্রিটেন বা কখনো ইসরাইল বা কখনো ভারত, চায়না, জাপান বা কখনো রাশান-ইউরোপিয়ানরা লাভবান হয়। মুসলিমরা কেবল মার খায়, বেইজ্জত হয়। খুলনায় বাটার দোকান লুট হওয়ার আগে সেখানে হাজারের বেশি লোকের সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশ শেষে মুখে কাপড় বেঁধে একদল লোক ঢুকে লুট করেছে কিন্তু চালিয়ে দেয়া হয়েছে ‘তৌহিদি জনতা’ নামে।
বাংলাদেশকে বিনিয়োগের একটি হাব বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে ড. ইউনূসের বিশ্ব ইমেজকে ঘিরে। বিনিয়োগ সম্মেলন প্রশ্নে এবারের আবহটা ছিল ভিন্ন। বড় মোক্ষম ও প্রাসঙ্গিক সময়ে বাংলাদেশের কোর্টে নিয়ে আসা হয় বিনিয়োগের বলটি। যখন যাবতীয় আলোচনা-পর্যালোচনার মূলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সফরে চীন কী দিয়েছে, আরো কত কী দেবে বাংলাদেশকে এ প্রশ্ন নিয়ে। সেই আলোচনায় ছেদ ফেলে বিমসটেক সম্মেলন, সেখানে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক। সেখানে আবার ছেদ-ছন্দপতন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কারারোপের ঘটনা। সেটি কাটতে না কাটতেই ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল। এরপর কোন ঘটনায় ব্যস্ত থাকতে হবে কে জানে!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ইমেইল- rintu108@gmail.com
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএ