।। তাহছিনা জামান ।।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন শ্রম আইনে ‘গণিকাবৃত্তিকে বৈধ শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান’-সংক্রান্ত একটি সুপারিশ উত্থাপন করেছে। এ প্রস্তাব দেশের সংবিধান, বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হওয়ায় তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল স্টেকহোল্ডার হলো এ দেশের জনগণ। যেকোনো জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও মতামতকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে গণিকাবৃত্তিকে বৈধ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়। গণমানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এমন প্রস্তাব উত্থাপন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলোয় অনুচ্ছেদ ১৮(২)-এ বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো গণিকাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। যদিও অনুচ্ছেদ ৮(২) অনুযায়ী দ্বিতীয় ভাগের মূলনীতিগুলো বিচারিকভাবে বলবৎযোগ্য নয় অর্থাৎ রাষ্ট্রকে এই মূলনীতি বাস্তবায়নে বাধ্য করা যাবে না, তবে এই মূলনীতিবিরোধী কোনো কাজ করলে তা অবশ্যই সংবিধান লঙ্ঘন হবে এবং তখন সেটি নিরোধ করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে বিচারিকভাবে বাধ্য করা যাবে। কুদরত-ই-এলাহী পনির মামলায় বিচারক নাইমুদ্দিন আহমেদের রায়ে এবং ড. কামাল হোসেনের যুক্তিতে এই গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত হয়।
ড. কামাল হোসেন যুক্তি দেন, সংবিধানের এই মূলনীতিগুলো negatively enforceable, অর্থাৎ রাষ্ট্র যদি ওই নীতিমালাবিরুদ্ধ কোনো আইন প্রণয়ন করে বা কার্যক্রম গ্রহণ করে, তাহলে আদালত তা বাতিল ঘোষণা করতে পারেন। এই যুক্তির প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয় যে, গণিকাবৃত্তিকে বৈধ শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।
শুধু সাংবিধানিক যুক্তিতে নয়, বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধেরও বিরুদ্ধে যায় এই প্রস্তাব। এ দেশের সমাজবিন্যাস গড়ে উঠেছে ধর্মীয়, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে। ইসলাম ধর্মে গণিকাবৃত্তিকে হারাম ঘোষিত করা হয়েছে, অন্য ধর্মগুলোতেও এটি নিষিদ্ধ ও ঘৃণিত হিসেবে বিবেচিত। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গণিকাবৃত্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা দেওয়া একান্তই অগ্রহণযোগ্য।
এ ছাড়া সমাজের নৈতিক কাঠামোর দিক থেকেও এটি এক ভয়াবহ সিদ্ধান্ত হতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক বিকাশে এই প্রস্তাব একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে। গণিকাবৃত্তিকে শ্রম হিসেবে বৈধতা দিলে তা যৌনতার বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করবে, যা সমাজে ভোগবাদী মানসিকতা ও পারিবারিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি করবে। নারী পাচার ও শিশু নিপীড়নের পথ প্রশস্ত করবে এবং সমাজে নারীর মর্যাদাহানির মাধ্যমে গভীর সংকট সৃষ্টি।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
আমাদের সমাজে এখনো নারীকে নানাভাবে বঞ্চনা, বৈষম্য ও সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে নারীকে শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার অপসংস্কৃতি আরো বৈধতা পাবে, যা নারীর ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একদিকে রাষ্ট্র নারী অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলবে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীকে বিক্রির পণ্য হিসেবে বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব রাখবে— এটি এক ভয়াবহ দ্বিচারিতা। এমন অবস্থান নারীকে অবমাননার দিকে ঠেলে দেবে এবং সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের পথকে আরো প্রশস্ত করবে। ফলে সমাজে এক গভীর নৈতিক ও মানবিক সংকটের সৃষ্টি হবে, যার প্রভাব পড়বে পরবর্তী প্রজন্মের মূল্যবোধ গঠনের ওপরও।
এসব বিবেচনায়, গণিকাবৃত্তিকে বৈধ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বদলে রাষ্ট্রের উচিত এই পেশা থেকে তাদের বের করে আনা এবং ধীরে ধীরে দেশ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণিকাবৃত্তি সম্পূর্ণ নিরোধ করা। বর্তমানে যারা এই পেশায় জড়িত, তাদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পরিবার ও সমাজে পুনঃপ্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা সমাজের স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসতে পারেন। যারা ইতোমধ্যে এই পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি।
বিকল্প হিসেবে তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, ক্ষুদ্রঋণ, হস্তশিল্প, গার্মেন্ট বা কৃষিভিত্তিক কাজে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিকল্প জীবিকা গড়ে তোলা যেতে পারে। পাশাপাশি একটি ন্যায়ভিত্তিক পুনর্বাসন আইন প্রণয়ন সময়োপযোগী। বিশেষায়িত সামাজিক নিরাপত্তা আইন ও পুনর্বাসন আইন প্রণয়ন করে যৌনকর্মে জড়ানো ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং বিকল্প জীবন নিশ্চিত করা যেতে পারে। গণিকাবৃত্তির সামাজিক ও ব্যক্তিগত ক্ষতিকর দিক বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।
রাষ্ট্রের উচিত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গণিকাবৃত্তি নির্মূলের উদ্দেশ্যে একটি মানবিক, নৈতিক ও টেকসই রূপরেখা প্রণয়ন করা। পেশা হিসেবে স্বীকৃতি নয়, বরং পুনর্বাসনের মাধ্যমে এই পেশা ধীরে ধীরে সমাজ থেকে নির্মূল করাই হবে সত্যিকার ‘সংস্কার’।
লেখক : আইন গবেষক।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ