ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ সংখ্যা উপত্যকাটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশের সমান। গত শুক্রবার ইসরাইলের হারেৎজ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। যদিও গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরাইলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৩০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৮১ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪২২ জন আহত হয়েছেন। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি যুদ্ধে মোট নিহতের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৪১২ জনে দাঁড়িয়েছে এবং আহতের সংখ্যা এক ৩৩ হাজার ০৫৪ জনে দাঁড়িয়েছে। ১৮ মার্চ ইসরাইল যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর কমপক্ষে ছয় হাজার ০৮৯ জন নিহত এবং ২১ হাজার ১৩ জন আহত হয়েছে।
এ দিকে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে এক সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত শুক্রবার হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে কঙ্গো-রুয়ান্ডা চুক্তি উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ট্রাম্প এ কথা বলেন বলে জানায় সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
অন্য দিকে হারেৎজে তার প্রতিবেদনে বলছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় সরাসরি নিহত হওয়ার পাশাপাশি বহু মানুষ পরোক্ষ কারণেও প্রাণ হারিয়েছেন, যেমন অনাহার, ঠান্ডা ও রোগে ভুগে। যুদ্ধের কারণে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। হারেৎজের প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের হোলোওয়ে কলেজের অর্থনীতিবিদ ও সহিংস সংঘাতে মৃত্যুর বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষক অধ্যাপক মাইকেল স্পাগাটের একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পত্রিকাটি লিখেছে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুত্যুর সংখ্যা নিয়ে ইসরাইলি মুখপাত্র, সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালীরা সাধারণত তাচ্ছিল্য প্রকাশ বা এগুলো অতিরঞ্জিত বলে দাবি করেন। তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের ক্রমবর্ধমান একটি অংশ বলছেন, এ তালিকাটি শুধু নির্ভরযোগ্যই নয়; বরং বাস্তবতার তুলনায় হয়তো অনেকটাই রক্ষণশীলও।
গবেষণাটিতে গাজার প্রায় ১০ হাজার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে দুই হাজার পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়। এর ভিত্তিতে জানা গেছে, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৭৫ হাজার ২০০ মানুষের সহিংস মৃত্যু হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। জরিপ অনুযায়ী, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই নারী ও ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
এক সপ্তাহেই যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা : সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তান সংঘাত বন্ধে ভূমিকা রাখেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর ইরান-ইসরাইল যুদ্ধেরও ইতি ঘটান তিনি। এবার ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার সংঘাত নিরসনের সুখবর দিলেন ট্রাম্প। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আলজাজিরার খবর অনুসারে, হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে গত শুক্রবার কঙ্গো-রুয়ান্ডা চুক্তি নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, তার বিশ্বাস- গাজায় যুদ্ধবিরতি এখন খুব কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। এ সংঘাত বন্ধে যারা কাজ করছেন, তাদের কয়েকজনের সাথে সদ্যই তার কথা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি বিষয়ে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বলেছে, যুদ্ধ শেষ করার যেকোনো চুক্তির আওতায় গাজায় থাকা অবশিষ্ট বন্দীদের মুক্তি দিতে তারা প্রস্তুত। তবে ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুদ্ধ তখনই শেষ হবে, যখন হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ও বিলুপ্ত করা যাবে। অবশ্য হামাস অস্ত্র সমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সহায়তা ব্যাগে মাদক : গাজা উপত্যকায় যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো মানবিক সহায়তার ব্যাগে মাদক পাওয়া গেছে। সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সির খবর অনুসারে, গত শুক্রবার গাজার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা আটার ব্যাগ খুলে ফিলিস্তিনিরা ‘অক্সিকোডোন’ নামের একটি মাদকদ্রব্য আবিষ্কার করেছে।
এটি একটি শক্তিশালী প্রেসক্রিপশন ব্যথানাশক, যা অপব্যবহারের ক্ষেত্রে তীব্র আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয়, এটাও সম্ভব যে এই বড়িগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ময়দার ভেতর গুঁড়ো করা হয়েছিল বা দ্রবীভূত অবস্থায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি আক্রমণ।’ গাজা কর্তৃপক্ষ এ ঘটনাকে ‘জঘন্য অপরাধ’ বলে অভিহিত করে ইসরাইলকে এর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছে।
তাদের দাবি, ইসরাইলের লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনিদের মাঝে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে দিয়ে সামাজিক কাঠামোকে ভেতর থেকে ধ্বংস করা। সরকারি মিডিয়া অফিস বলেছে, ‘এটি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান ইসরাইলি গণহত্যার একটি অংশ। ইসরাইল মাদককে বেসামরিকদের বিরুদ্ধে নোংরা যুদ্ধে নরম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।’
মার্কিন সহায়তা মানুষ হত্যা করছে : গাজায় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি সহায়তা কার্যক্রমকে প্রকৃতিগতভাবেই অনিরাপদ বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে সোজাসাপ্টা মূল্যায়নে শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটি মানুষ হত্যা করছে।’ ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র চায়, জাতিসঙ্ঘ যেন নতুন বিতর্কিত এই সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে কাজ করে।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
কিন্তু জাতিসঙ্ঘ এতে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং এ বিতরণ পদ্ধতিকে সহায়তার সামরিকীকরণ এবং বাস্তুচ্যুতি জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার অভিযোগ এনেছে। সাংবাদিকদের গুতেরেস বলেন, জাতিসঙ্ঘ-নেতৃত্বাধীন মানবিক প্রচেষ্টা বর্তমানে ‘শ্বাসরুদ্ধ’ অবস্থায় রয়েছে। সহায়তা কর্মীরাও অনাহারে ভুগছেন এবং দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরাইলের সহায়তা প্রবেশ ও বিতরণে সম্মতি ও সহযোগিতা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘মানুষ কেবল নিজেদের ও পরিবারের জন্য খাবারের খোঁজ করতে গিয়ে মারা যাচ্ছে। খাদ্য খোঁজার চেষ্টা কখনোই মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না।’ ‘এখনই সময় গাজায় একটি রাজনৈতিক সাহসিকতার সাথে যুদ্ধবিরতির পথ খুঁজে বের করার।’
১৫ ইসরাইলি সেনা নিহত : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় গত শুক্রবার এবং গত ২ দিনে অন্তত ১৫ জন ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে এ তথ্য। সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, শুক্রবার উত্তর গাজার তুফাহ এলাকায় ইসরাইলি বাহিনীর একটি সাঁজোয়া যানকে লক্ষ্য করে বিস্ফোরক রকেট ছোড়ে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের সামরিক শাখা আল কাসাম ব্রিগেড। এতে ওই সাঁজোয়া যানে থাকা ১৭ ইসরাইলি সেনার মধ্যে ৭ জন নিহত হন এবং আহত হন বাকি ১০ জন।
তুরস্কের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার গাজার প্রধান শহর গাজা সিটি এলাকায় আল কাসামের ব্রিগেডের গুলিতে নিহত হন এক ইসরাইলি সেনা। এ ছাড়া এ সময় বিস্ফোরক রকেট ছুড়ে ইসরাইলি বাহিনীর দু’টি মেরকাভা ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া যান এবং একটি বুলডোজার ধ্বংস করা হয়।
তার আগের দিন বুধবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে আল কাসাম ব্রিগেডের গুলি ও রকেট হামলায় নিহত হন আরো সাত ইসরাইলি সেনা। নিহতদের মধ্যে একজন লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তা ছিলেন।
৮১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা : গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৮১ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪২২ জন আহত হয়েছেন। হাসপাতাল সূত্র আলজাজিরাকে জানায়, শনিবার ভোর থেকে গাজাজুড়ে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসে ১১ জন, মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহে দু’জন, উত্তর গাজার জাবালিয়ায় দু’জন, গাজা শহরের উত্তর-পশ্চিমে একটি এলাকায় একজন, দক্ষিণ গাজার রাফাহের উত্তরে একটি জিএইচএফ সহায়তা কেন্দ্রের কাছে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে একজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
এদিকে নতুন করে ত্রান সরবরাহ বন্ধ করার মাঝেই গাজার মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ছিটমহলে অপুষ্টির কারণে ৬৬ জন শিশু মারা গেছে। ইসরাইলি বাহিনী কর্তৃক ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া, দুর্বল গোষ্ঠী বিশেষ করে শিশু এবং অসুস্থদের জন্য নির্ধারিত খাদ্য এবং পুষ্টিকর সম্পূরক প্রবেশে বাধা” দেয়া এর অন্যতম কারণ। মিডিয়া হাউজ জানায়, এ আচরণ যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ