Home জাতীয় দাবির আড়ালে ফ্যাসিবাদের তান্ডব

দাবির আড়ালে ফ্যাসিবাদের তান্ডব

ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সংসদীয় আসন সীমানা পুনর্বিন্যাসের দাবির আড়ালে থানা ও সরকারি অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা এখন পুরো দেশজুড়ে আলোচনা সরব রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, আন্দোলনের মাঝে ফ্যাসিবাদের অনুপ্রবেশের কারনে ভাঙ্গায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে।

কেউ কেউ মনে করছেন, বৈধ আন্দোলনকে পেছনে ফেলা দেয়ার জন্য একটি কুচক্রী মহল আন্দোলনকারীদের পেছনে থেকে ভাঙ্গার শান্তিপ্রিয় জনতার ওপর দোষ চাপিয়ে, তারা জনতার কাতারে এসে ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল। আর এ পর্দার আড়ালে কলকাঠি নাড়ানো মহলটিই ভাঙ্গার সকল সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী বলে সুশীল সমাজ মনে করেন। বোদ্ধা ও শিক্ষিত মহল মনে করেন, আল্লাহ তাআলা ভাঙ্গাবাসীসহ সকল প্রশাসনকে অল্পতে বাঁচিয়েছেন। এখানেও যে গোপালগঞ্জের মত ঘটনা জন্ম হতো না এ কথাটা তা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই।

৩০০ আসন বিশিষ্ট বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। এর মধ্যে একটি আসন কমানো বা বাড়ানোর এখতিয়ার কারোরই নেই। জনসংখ্যার হার অনুযায়ী এ সমস্ত আসন বিন্যাস হয়ে থাকে। প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনার ভোটারের সংখ্যা আনুপাতিক হারে সংসদীয় আসন পুনর্নির্ধারণ করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ফরিদপুর ভাঙ্গার সংসদীয় আসন সংশোধন করা হয়েছে। যা যুক্তিযুক্ত বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনার মনে করেন।

এ সীমানা নির্ধারণকে মানতে পারছেন না ফরিদপুর-৪ আসনের ভোটাররা। তারা তাদের পুরোনো আসন সীমানার দাবিতে গত এক সপ্তাহ যাবৎ আন্দোলন করে আসছেন। গত সাত দিনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাঝে হঠাৎ করে গত সোমবার বেলা ১২টায় ভাঙ্গার এ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতার রূপ নেয়।

এ আন্দোলনের মধ্য থেকে কেউ কেউ থানা, হাইওয়ে পুলিশ বক্স, নির্বাচন অফিস, অফিসার ক্লাবসহ, সরকারি পাঁচটি গাড়ি, কিছু পাবলিক গাড়িসহ, বেশকিছু মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে।
অপরদিকে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়সহ একতলা থেকে পুরো অফিসের প্রত্যেকটি কক্ষে সরকারি সম্পদ ভাঙচুরের তা-বলীলা চালায় তারা। এসময় বিক্ষুব্ধদের কাছে ইউএনও প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে অফিস ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বিষয়টি গণমাধ্যমে ইউএনওর সিএ নিশ্চিত করেন।

এ সহিংসতার ঘটনায় এবং সরকারি সম্পদ নষ্ট করার প্রতিবাদে এবং হামলাকারীদের চিহ্নিত করে আটকের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার ভাঙ্গার রাজপথে মিছিল করেন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। মিছিলকারীরা পতিত সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সেøাগান দেন।

অপরদিকে, একই দিনে দুপুরের পর, ফরিদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাড. সৈয়দ মোদারেস আলী ইছা ভাঙ্গা এলাকা পরিদর্শন শেষে এক পথসভায় বলেন, গত ’২৪ এর আন্দোলনে বিএনপি সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন আমাদের ব্যানারের পিছনে থেকে পতিত সরকারের ফ্যাসিবাদরা ভাঙ্গার অধিকাংশ সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।

তিনি আরো বলেন, ভাঙ্গা-৪ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেব নির্বাচন করতে ইচ্ছুক মো. শহীদুল ইসলাম বাবুল খান (কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সম্পাদক) তিনি উচ্চ আদালতে ভাঙ্গা থেকে আলগি ইউনিয়ন ও হামিরদি ইউনিয়ন দুটি কেটে সালথায় যোগ করার বিরুদ্ধে একটি রিট করেন। যার শুনানি আগামী ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এ পর্যন্ত ভাঙ্গার আন্দোলন বন্ধ থাকবে। ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হলে সবার জন্যই মঙ্গল। অন্যথায় আন্দোলন আবার চলবে।

এর আগে গত রোববার ফরিদপুরে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে ও পুরোনো সীমানা বহালের দাবিতে আয়োজিত মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। তার পরদিন সোমবার দুপুরে আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে ভাঙ্গা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এ সময় সাংবাদিকদের ওপরও চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। তাদের মুঠোফোন কেড়ে নেয়া হয় এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করা হয়। এ সময় পাঁচ সাংবাদিক আহত হন। কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয় ভাঙ্গার মাইটিভির সাংবাদিক মো. সরোয়ার হোসেনকে। তখনই সাংবাদিকরা প্রাণভয়ে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শীরা ইনকিলাবকে জানান, সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা সোয়া ১টার মধ্যে ভাঙ্গা উপজেলা ঘিরে ওই হামলার ঘটনা ঘটে।

তবে এ বিষয়ে ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কোন বক্তব্য দেননি।

ঘটনার সময়ের প্রতক্ষদর্শীরা ইনকিলাবকে জানান, ঘটনার আগে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের আলগী ইউনিয়নের সোয়াদী এলাকা থেকে শুরু হওয়া ‘লং মার্চ টু ভাঙ্গা’ দুপুর ১২টার মধ্যে গোলচত্বর এলাকায় এসে পৌঁছায়। এ সময় ২২/২৫ বছরের কতিপয় বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠি দেখা গেছে। অনেকের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র। একজনের হাতে অবৈধ অস্ত্রও দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ওই সময় ভাঙ্গা গোলচত্বরসহ আশপাশের এলাকা হাজারো মানুষ নিয়ন্ত্রণ নেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অল্পসংখ্যক পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলে তাদের ধাওয়া করে বিক্ষোভকারীরা। পরে পুলিশ সদস্যরা ভাঙ্গা মডেল মসজিদে আশ্রয় নেন। ১০/১৫ মিনিট পর তারা ধাওয়া খেয়ে থানায় চলে যান।

আরও পড়তে পারেন-

অপরদিকে, একই ঘটনার দিন কাফনের কাপড় পরে আন্দোলনকারীরা আটকে দেয় দুটি ট্রেন। তারাও এসে ভাঙ্গার আন্দোলনে অংশ নেয়।
এদিকে গত সোমবার ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে ভাঙ্গা হাসপাতাল মোড়ে আগুন ধরিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বিক্ষুব্ধরা। এসময় সাধারণ মানুষ দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকেন। তেমনি ঢাকা-খুলনা ও ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ যাত্রীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে। এ বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য ভাঙ্গা সার্কেল, থানার ওসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে চাইলে তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলতে একেবারেই নারাজ প্রশাসন।

ইনকিলাবের সাথে কথা হয় শিবচর দত্তপাড়া এক মসজিদের ইমাম আতিকুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, আমার বাড়ি হামিরদি ইউনিয়নের শেষ অংশে। আমি একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই। আমরা আমাদের দুটি ইউনিয়নকে পুনরায় ভাঙ্গার সাথে যোগ করার জন্য যৌক্তিক আন্দোলন করছি। দাবি মেনে না নেয়া হলো সরকারের সদয় বিবেচনা। সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কে বা কারা এই ন্যাক্কারজনক ধ্বংসকা- চালিয়েছে এদেরকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাই।

ইনকিলাবের সাথে কথা হয় ভাঙ্গার তরুণ সমাজ সেবক এস এম জাহিদ শিকদারের। তিনি বলেন, আমিও ভাঙ্গার বাসিন্দা আমার দেখায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যেমন কোন দোষ দিচ্ছি না, তেমনি ভাঙ্গার আন্দোলনকারীদেরও কোন দোষ দিচ্ছি না। বিনা উস্কানিতে একটি উচ্ছৃঙ্খল মহলের কতিপয় অস্ত্রধারী বিপদগামী যুবকরা একত্রিত হয়ে আন্দোলনকারীদের বাদ দিয়েই তারা ভাঙ্গার সরকারি বহু স্থাপনায় পুলিশের ৫/৬টি গাড়ি, কিছু পাবলিক গাড়ি, বেশ কিছু মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি সাধন করছেন। এটা আমরা কোন মতোই আশা করিনি। তিনি আরো বলেন, ভাঙ্গার শান্তিপ্রিয় মানুষের পক্ষে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তার অফিসের তালা ভেঙ্গে এক তলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত অধিকাংশ কক্ষের আসবাবপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছে উচ্ছৃঙ্খল হামলাকারীরা।

অপরদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঙ্গা দক্ষিণপাড়া হাসপাতাল এলাকার একটি ক্লিনিকের মালিক ইনকিলাবকে জানান, আমি নিজে চোখে দেখেছি যারা পুলিশের ওপর হামলা করেছে, যারা ভাঙ্গার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ভেঙ্গেছে, পুলিশকে ইটপাটকেল মেরে আহত করছে। এদের মধ্যে আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি ছিল কম। বেশির ভাগই ছিল বহিরাগত এবং অস্ত্রধারী। বেশিরভাগের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র।

ইনকিলাবের সাথে কথা হয় উপজেলা নির্বাহীর অফিস সংলগ্ন এলাকার তথা বাইশাখালীর একজন হোটেল ব্যাবসীর সাথে। তিনি বলেন, ধারালো এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহকারে কয়েকশ’ যুবক যাদের বয়স ২২/৩০ বছরের মধ্যে, এরা গত সোমবার দুপুর আনুমানিক ১২টা হবে, দৌড়ে এসে ইউএনও অফিসের নিচে যতগুলো গাড়ি ছিল সব ভেঙ্গেচুরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৮০/৯০ জন যুবক ইউএনওর অফিসের তালা ভেঙ্গে উপরে ব্যাপক লুটপাট ও ভাঙচুর চালায়। পাশে বসে শব্দ পেয়ে এগিয়ে দেখি, যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তবে এদের মধ্যে ভাঙ্গার আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি ছিল নগন্য। কতিপয় আন্দোলনকারী সাথে ছিল কিন্তু ওরা ভাঙচুর লুটপাট করেনি। আন্দোলনের নামে কেউ হামলা করবে এটাও তারা বুঝে উঠতে পারেননি।

ভাঙ্গার সিনিয়র সাংবাদিক মো. মামুনুর রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, ভাঙ্গার আলগি ও হামিরদি ইউনিয়নের ভূমি রক্ষার জন্য ভাঙ্গাবাসী এক হয়ে যৌক্তিক আন্দোলন করছেন। এরা তো কখনো সহিংসতা করেননি। ভাঙ্গার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ও কোন পক্ষপাতমূলক আচার-আচরণ আমি দেখিনি। তবে হঠাৎ ভাঙ্গার শান্তির শহরটাকে কারা উত্তপ্ত করে দিলো, এরা কারা? এদের পিছনের উদ্দেশ্য কি? এটাও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে খুঁজে বের করার অনুরোধ করছি। পাশাপাশি নিরীহ এবং নির্দোষ কাউকে হয়রানি না করারও অনুরোধ করছি।

হাফিজুল নামের এক দিনমজুর বলেন, আমরা তো চেয়েছি সরকার আমাদের ইউনিয়ন দুটি আবার যাতে আমাগের মধ্যে আইনা দেয়। আমরা তো এই জ্বালাও পোড়াও ভাঙ্গাচোরা ক্ষতি চাইনি। কি হলো, এটা করলো কারা? আমাদের বদনাম হয়ে গেল।

এদিকে, ভাঙ্গার সাধারণ আন্দোলনকারীরা গতকাল মঙ্গলবার একটি বিশেষ ঘোষণা দিয়েছেন। তারা ফরিদপুর জেলা প্রশাসককে একটি ঘোষণাপত্র জমা দেন। তাতে আন্দোলনকারীরা নিরীহ কাউকে যেন হয়রানি করা না করার জন্য জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে অনুরোধ করেন। পরে জেলা প্রশাসক আন্তরিকতার সাথে সেটি বিবেচনায় রাখবেন বলে সকলকে জানান। এ সময় জেলা প্রশাসক ও সকলের কাছে অনুরোধ করেন আন্দোলন শিথিল করতে। তাদের দাবির বিষয়টি সরকারকে জানিয়েছেন শুনে ক্ষুব্ধ মানুষ আশ্বস্ত হন।

পরে জেলা প্রশাসকের আশ্বাসে ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে মানুষের ভোগান্তি যাতে না হয়, এজন্য দুপুর ১২টার পর থেকে রাস্তা ছেড়ে দেন আন্দোলনকারীরা। আজ বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত কোন অবরোধ থাকবে না। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি কাউকে হয়রানি করার চেষ্টা করে সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও জানান তারা।

এদিকে আগামী রোববার জেলা প্রশাসকের আশ্বাসে তাদের ৫ দফা ন্যায্য দাবি যদি মেনে নেয়া না হয় তারা আবার লাগাতার আন্দোলনে নামবে বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। পরবর্তীতে তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা। সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করে সকলকে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনকারী সমন্বয়ক কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে সোমবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ ও থানায় হামলা-ভাঙচুরের সময় লাইভ সম্প্রচারে কাজে থাকা স্থানীয় সাংবাদিক সরোয়ার হোসেনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। এছাড়াও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সদস্য পাঁচ সাংবাদিকও আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ইনকিলাবকে জানান, ঘটনার দিন দুপুর ১টার দিকে আন্দোলনকারীরা প্রথমে ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে হলরুমসহ বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর করে। একই সঙ্গে ভাঙ্গা থানায়ও হামলা চালানো হয়। এ সময় ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা আটকা পড়েন। হামলাকারীরা থানায় রাখা পুলিশের গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তবে আধা ঘণ্টারও কম সময় ওই তা-ব চালানোর পর তারা দ্রুত সরে যায়।

প্রসঙ্গত, ফরিদপুর-৪ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের গেজেট বাতিলের দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ রোববার থেকে তিন দিনের সকাল-সন্ধ্যা মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার অবরোধের ২য় দিন ছিল গত সোমবার। ওই দিন সকাল পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। উপজেলা পরিষদ এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবরোধে যোগ দিতে আহ্বান জানানো হয়।

আলগি ইউনিয়নের স্থানীয় দোকানী দোকানদার মোঃ নান্নু মোল্লা জানান, সোমবার সকাল ১১টার দিকে ভাঙ্গার আলগীতে হঠাৎ বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিলে ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কে সম্পূর্ণ যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ১২টার দিকে অবরোধকারীরা ভাঙ্গা থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা প্রতিহত করে। এরপর আরো বৃহৎ আকারে অবরোধে যোগ দেয়ার জন্য মাইকিং করা হয়।

অপরদিকে হামিরদি ইউনিয়নের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সকাল থেকে ঢাকা-খুলনা ও ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকলেও কোনো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবে দুপুর থেকে পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে যায়। এ সময় মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, আনসার ও সাজোয়া যান মোতায়েন করা হয়।

ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রকিবুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান, যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু যা ঘটে গেল তা আমরা ভাবতেও পারিনি।
ভাঙ্গার এ সহিংসতার ঘটনার আলোকে গত সোমবার রাতে ভাঙ্গা পরিদর্শনে আসেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরকালে বলেন, যারা ফ্যাসিস্ট তাদের আমরা আইনের আওতায় আনবো। কেউ আইনের উর্ধ্বে নন। তিনি ভাঙ্গাবাসীকে আশ্বস্ত করেন, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ভাইরাল ভিডিও দেখে আসল দুষ্কৃতকারীদের আটক করা হবে। নিরীহ এবং নির্দোষ কেউ হয়রানি হবেন না।

আন্দোলনকারীদের হামলায় ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদ, ইউএনও অফিসসহ অন্তত ২০টি অফিস ও দুটি থানায় হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত অফিস-আদালত পরিদর্শন করেছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক।

এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেছেন, ‘যারা ফ্যাসিস্ট, তাদের আমরা অবশ্যই আইনের আওতায় আনবোই। এরই মধ্যে আমি তাদের গ্রেফতার করতে নির্দেশ দিয়েছি।’

রেজাউল করিম মল্লিক আরো বলেন, ‘জনগণের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যা যা করণীয় আমরা সব ব্যবস্থা নেব। যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে আছি, সেক্ষেত্রে আমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন এখানকার যারা নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, এ বিষয়ে আমাকে অবগত করেছেন। আমি তাদের নির্দেশ দিয়েছি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যা যা করার সবকিছুর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার।’

এর আগে উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত অফিসগুলো পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন তিনি। পরিদর্শন শেষে ভাঙ্গা উপজেলার অফিসারদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক করেন।
এ সময় ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি সিদ্দিকুর রহমান, ফরিদপুর জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান মোল্লা, জেলা পুলিশ সুপার এম এ জলিল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ভাঙ্গা সার্কেল) আসিফ ইকবাল, ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ভাঙ্গার এ সহিংসতার ঘটনায়, পাশ্ববর্তী জেলা মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, জাজিরা উপজেলায় ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, মাদারীপুর ইনকিলাবের স্টাফ রিপোর্টার আবুল হাসান সোহেল, গোপালগঞ্জের জেলা সংবাদদাতা জয়ন্ত কুমার, জাজিরা উপজেলা সংবাদদাতা মাহবুবর রহমান শিপন জানান, গত টানা ৭/৮ দিনের আন্দোলনের ফলে উল্লেখিত জেলা ও উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ ছিল। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে ২১ জেলার সাথে প্রতি দিনের ব্যাবসা বান্ধব পরিবেশ। ফলে বিভিন্ন সবজি এবং কাঁচামালের মূল্যও ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।

পাশাপাশি, বৃহত্তর ফরিদপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তথা ঢাকা-চট্টগ্রাম, খুলনা-যশোর যাওয়ার প্রধান প্রবেশপথই হলো ভাঙ্গা মহাসড়কের মোড়, তথা ভাঙ্গা বিশ্বরোড মোড়। এক কথায় এই ভাঙ্গা বিশ্বরোড মোড়টিই হলো ২১ জেলার নাভী। সংবাদদাতারা আরো জানান, গত ৭/৮ দিনের চলমান আন্দোলন দূর পাল্লার পরিবহন যাত্রীদের তথা নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু-কিশোরদের কষ্টের কান্না আমরা সকলে প্রত্যক্ষ করেছি। ভাঙ্গার সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, জাজিরার বিভিন্ন দলের নেতারা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভাঙ্গার পুরো উপজেলা, উপশহর, গ্রাম-গঞ্জ ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

এ ঘটনার পর ভাঙ্গার কমপক্ষে ১০/১১ পয়েন্টে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছেন। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসারসহ যৌথবাহিনী ব্যাপক টহল জোরদার করেছেন। সব জায়গা নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা রয়েছে। তবে জানা গেছে, ভাঙ্গার আলগি ও হামিরদি ইউনিয়ন দুটিকে ভাঙ্গা-৪ আসনে রাখার জন্য জনতার পক্ষে হাইকোর্ট রিট করেছেন মো. শহীদুল ইসলাম বাবুল খান।

উম্মাহ২৪ডটকম:আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।