।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।
আজকাল দৈনিক খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই যে সংবাদটি প্রথমেই নজরে পড়ে তা হলো, সন্ত্রাস, নারী ধর্ষণ, যৌতুকের শিকার, নারী নির্যাতন প্রভৃতি। দিন যতই যাচ্ছে, ততই এ সকল অপকীর্তি যেন আরো বেড়েই চলেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, যেন আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের সেই অন্ধকার যুগের বর্বরতাকেও বর্তমান ঘটনা ম্লান করে দিয়েছে।
আমার আজকের প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় যৌতুক নিয়ে। কাজেই যৌতুকের লোমহর্ষক চিত্রটিই শুধু আমার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
বাংলাদেশ আজ যৌতুকের অভিশাপে জর্জরিত। ক্রমাগতঃ এর ভাইরাস সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরের দিকে তাকালে দেখা যায় অগণিত নারী আজ যৌতুকের শিকার। যৌতুকের কারণে নারীর স্বপ্নিল হৃদয়ের নীড় বাঁধার স্বপ্নসাধ না মিটতেই ফিরে আসছে মা-বাবার কুঁড়ে ঘরে। কেউবা প্রাণ হারাচ্ছে নির্দয়, পাশণ্ড, যৌতুক লোভী স্বামীর হাতে নির্মমভাবে। আবার হাজারো মা-বাবা তাদের আদরের যৌবনা মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারছে না, যৌতুকের দাবী মেটাতে না পেরে। ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত তারা মানসিক নির্যাতনে ভুগছে।
আজ বাংলাদেশের বিত্তবান ব্যক্তির কন্যাটিকে যেমন মোটা অংকের যৌতুক দিয়ে পাত্রস্থ করতে হচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে দীনহীন ব্যক্তিটির কন্যাটিকেও কিছু না কিছু যৌতুক দিয়েই পাত্রস্থ করতে হয়। আর যাদের পিতা-মাতা আদৌ যৌতুকের টাকা জোটাতে পারেন না, তারা মানসিক ও দৈহিকভাবে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, পদে পদে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হচ্ছেন। আবার কখনো বা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে না পেরে নারী নিজেই আত্মহননের মাধ্যমে এ সুন্দর পৃথিবীর মায়া-মমতা ত্যাগ করে নিজের চিরমুক্তির পথ বেছে নিচ্ছেন। যদিও তাতে ক্ষতিটা আরো সীমাহীন হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, যৌতুকের কারণে নারী প্রতিনিয়ত নির্যাতিতা হচ্ছে অথবা আত্মহত্যার মত নিকৃষ্ট ও বেদনাদায়ক পথ বেছে নিচ্ছে, সেই যৌতুক সম্পর্কে ইসলাম কি বলে? পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বিবাহে নারী বা তার অভিভাবকের কাছ থেকে নগদ অর্থ বা বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র দাবী করে আদায় করা হারাম।
আর হাদীসে এসেছে, হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যদি কোন ব্যক্তি ফেরত না দেওয়ার নিয়্যাতে কোন অর্থ প্রাপ্তির লোভে কোন নারীকে বিবাহ করে, তবে ঐ ব্যক্তি একজন যিনাকারী। যে ব্যক্তি না দেওয়ার নিয়্যাতে ঋণ গ্রহণ করে তবে ঐ ব্যক্তি চোর।
আর এই মহাসত্য বাণীটি কোন পাত্র পক্ষের মুরুব্বীর যে অজানা, তাও নয়। তবুও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে পাত্রী পক্ষের কাছ থেকে যৌতুক আদায় করা হয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সুকৌশলে (তাদের মতে জায়েয করে নিয়ে) তা আদায় করা হয়। প্রথমেই বলা হয়, পাত্র পক্ষের কোন দাবী দাওয়া নেই। তবে পাত্রী পক্ষ যদি স্ব-ইচ্ছায় কিছু পাত্রকে দেয়, তাতে কোন আপত্তি নেই। আর এ ক্ষেত্রে বিয়ে হওয়া না হওয়া নির্ভর করে খুশী হয়ে পাত্রকে কিছু প্রদানের উপর। অর্থাৎ মোটা অংকের কিছু খুশী হয়ে দিলে সে বিয়ে হয়, নচেত হয় না।
কিন্তু ইসলাম তা বলে না। ইসলামের কথা, পাত্র তথা স্বামী বিবাহ করার সময় স্ত্রীকে যথোপযুক্ত মোহরানা প্রদান করবে। আর ইসলাম সেই মোহরানা আদায় করাকে ফরয বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আল্লাহর এ হুকুমটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় না। যদিও পাত্রীপক্ষের অনুরোধে একটা মোহরানা নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রায়ই অধিকাংশ বিবাহ অনুষ্ঠানে মোহরানার একটা অংশ আদায় করা হলেও মোহরানার মোটা অঙ্ক অদেয় থাকে। আর যে অঙ্ক আদায় করা হয়ে থাকে, তা নির্ধারিত অঙ্কের একটা নগণ্য অংশ মাত্র। মূল কথা, বিবাহ অনুষ্ঠানের শুরুতেই সুকৌশলে স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কেননা, কাজী সাহেব বিবাহ আসরে আনুষ্ঠানিক যে ঘোষণা দেন, তা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কোন দিন আদায় হয় না। আর পাত্রীও জানেন, তার নির্ধারিত মোহরানা আদৌ কোন দিন তার হস্তগত হবে না। নিঃসন্দেহে যা সূরা নিসার ১৯ নং আয়াতের হুকুমের পরিপন্থী অর্থাৎ হারাম কাজ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলামের বিধিবিধানকে উপেক্ষা করেই হোক অথবা ব্রাহ্মণ্যবাদী অনৈসলামী রীতিনীতির অনুসরণেই হোক, আমাদের দেশে অহরহ এই হারাম কাজটি ঘটে চলেছে। অথচ ইসলামে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, একজন প্রকৃত মুসলমান তখনই বিবাহ করতে পারেন, যখন তিনি স্ত্রীর মোহরানা আদায়ের সমর্থ অর্জন করবেন অথবা ভবিষ্যতে তা আদায় করার ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। সাথে সাথে স্ত্রীর ভরণপোষণ চালানোর সামর্থও থাকতে হবে। শুধু কি তাই? বরং বিবাহের পর তাকে ছোটখাটো একটা ওলিমা অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহনের সমর্থও থাকতে হবে। স্মর্তব্য, বিবাহে ওলিমা অনুষ্ঠান করা সুন্নাত। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বিবাহের পর ওলিমা অনুষ্ঠান করেছেন এবং ওলিমা অনুষ্ঠানের জন্য তাকিদ দিয়েছেন।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের সমাজে বিবাহ অনুষ্ঠানের যে চিত্রটি দেখা যায়, তা তার বিপরীত। এখানে পাত্রীর পিতা কর্তৃক বড় ধরনের ভোজের অনুষ্ঠান করতে হয়। কেননা, বরযাত্রীর বিশাল একটা দলকে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার উপর একরকম জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বুকের উপর চেপে বসা পাথর উৎপাটনের জন্য যৌতুক ও নগদ মোটা অংকের অর্থ প্রদানের শর্তের সাথে বরযাত্রীকেও সম্মানজনক ভোজ দানের শর্তটি মেনে নিতে বাধ্য হন।
ইদানিং আমাদের সমাজে বরযাত্রীর ক্ষেত্রে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর তা হলো- বরযাত্রীর সিংহভাগই মহিলা বরযাত্রী, যার মধ্যে নানি-দাদিরাও শামিল থাকেন। যাদেরকে সামলাতে পাত্রীপক্ষ রীতিমত হিমশিম খেয়ে যান। মূলতঃ এতে করে পাত্রীর পিতা চরম নির্যাতনের শিকার হন। অথচ ইসলামের বিবাহ অনুষ্ঠানে এত দিনের আদর-সোহাগে লালিত পালিত কন্যাটিকে পাত্রস্থ করা ছাড়া কন্যার পিতার একটা শিকি মুদ্রাও ব্যয় করার কথা নয়। কেননা, আপন তাগিদেই একজন পুরুষ একজন নারীকে বধূ রূপে গ্রহণ করে থাকেন। আর তাই ইসলাম স্বামীর উপর বিবাহ অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয়ভার অর্পন করেছে।
তাহলে কি আমরা এখন ধরে নিতে পারি না যে, ইসলামী বিধিবিধানকে উপেক্ষা করে যারা যৌতুক আদায় করে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কুমারী কন্যাকে বিয়ে করতে চান বা করছেন, তাদের আদতে পুরুষত্ব নেই। কথাটা শুনতে একটু কটূ মনে হলেও আমি তাদেরকে পুরুষত্বহীনই বলবো। আর এই জন্য যে, বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণ পোষণ চালাবার মত সমর্থ নেই জন্যই তারা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছ থেকে যৌতুক দাবী করেন। পৌরুষদীপ্ত বর কখনো পাত্রীর পিতার কাছ থেকে অর্থ নিতে পারে না। পৌরুষদীপ্ত বর অবশ্যই পাত্রীর পিতার কাছ থেকে অর্থ তথা যৌতুক নিতে ঘৃণাবোধ করে থাকবে।
আমাদের করণীয়ঃ এতক্ষণ আমাদের নাতিদীর্ঘ আলোচনায় বর্তমান সমাজের যৌতুক প্রবণতার একটি চিত্র দুঃখজনকভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। আসলে আমাদের সমাজ জীবনের এই দূর্গতির মূল কারণই হলো- আল্লাহর শাশ্বত বিধান লংঘনের পরিণতি। আমরা এক আল্লাহর বান্দা এবং সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবীজির উম্মত। দ্বীনের যিম্মাদার ও মেহনতকারী এ বোধ বিশ্বাস আর নেই। আমরা পবিত্র কুরআন তথা ইসলামের মূল আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। যে কুরআন সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম নির্ণয়ের পথ দেখায়, সেই কুরআন পড়েও আমরা আজ হালাল-হারাম নির্ণয় করতে অক্ষম। আজ আমরা কাফির-মুশরিকদের পথ অনুসরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এই যে যৌতুক প্রথা, এটা কোত্থেকে এলো? বাংলাদেশের কয়জন পুরুষ জানেন যে, স্ত্রীকে প্রদত্ত মোহরানা আদায় করা স্বামীর জন্য ফরয? আর কেনেই বা জানেন না যে, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার নিকট থেকে যৌতুক আদায় করা হারাম? তবুও কেন এই প্রবণতা? আসলে পারিপার্শিক বিধর্মীদের ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছি আমরা নির্লজ্জ ও হতাশাজনভাবে।
কিন্তু এর কি কোন সমাধান নেই? এভাবেই কি পবিত্র বিবাহ বন্ধন ক্ষেত্রে হারাম কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত সম্পাদিত হতে থাকবে? আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত লঙ্ঘিত হবে? আর নিরীহ নারীকে যৌতুকের নির্যাতন সইতে হবে? আর কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা কন্যাকে পাত্রস্থ করতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হবে পরের দুয়ারে দুয়ারে? কোন পথ বা উপায়ই কি নেই আমাদের সামনে? আমরা কিছুই করতে পারি না তাদের জন্য? আদম সন্তানের এ চরম দুর্গতি দেখে কি আমরা নিশ্চুপ থাকবো?
বলা হচ্ছে, আইন দ্বারা এটাকে বন্ধ করা হবে। যৌতুক বিরোধী আইন তো সংসদে পাশ করা হয়েছে। তবুও যৌতুক বন্ধ হচ্ছে না কেন? সরকার বন্ধ করতে পারছে না কেন? শুধু আইন পাশ করলেই তো আর হয় না, তার সঠিক প্রয়োগের প্রয়োজন। আর প্রয়োগ করবেই বা কীভাবে? যদি না মানুষ সচেতন হয়। আর তাই আইন পাশ হবার পরও গোপন আঁতাতে পাত্রপক্ষ ও পাত্রী পক্ষের মধ্যে এই জঘন্য কাজটির আদান প্রদান অব্যাহত আছে।
তাই বলছিলাম, আইন বস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা। আর এই গণসচেতনতা আসতে পারে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। কাজেই প্রত্যেকেরই আজ আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে ইসলামকে সঠিকভাবে জানতে হবে। ইসলামী বই পুস্তক বেশী বেশী পড়তে হবে। সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম নির্ণয়কারী তথা কুরআনের চর্চা ব্যাপকভাবে চালু করতে হবে। শুধু তোতাপাখীর মত পড়লেও চলবে না, বরং অর্থ বুঝে এবং আমলের নিয়্যাতে পড়তে হবে। হক্কানী উলামায়ে কেরামের সংস্পর্শে থাকতে হবে। কোন কিছু না বুঝলে তাঁদের কাছ থেকে বুঝে নিতে হবে।
নিঃসন্দেহে আমাদের শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের ক্ষমতা অপরিসীম। কাজেই আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে গণসচেতনতা দরকার, সেটি সৃষ্টি করতে দায়িত্বশীল আলেমদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি মসজিদের শ্রদ্ধেয় ইমাম সাহেবগণ ও বিবাহ-শাদী সম্পাদনকারী কাজী সাহবেদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা, তারা সর্বস্তরের জনগণের খেদমতে ঘনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত। আর ইমাম সাহেবরা প্রতিটি মুসল্লীর সাথে সম্পৃক্ত। তাদের প্রতিটি আহ্বান দ্রুত ক্রিয়াশীল। আর এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, প্রতিটি মুসল্লীই তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন এবং তাদের কথা মেনে চলেন।
কাজেই, তাদের পক্ষেই বেশী সম্ভব জনগণের মধ্যে প্রকৃত দ্বীনি সচেতনতা সৃষ্টি করা। তারাই পারেন নারীকে যৌতুকের শিকার হতে উদ্ধার করতে। তারাই পারেন অগণিত নারীকে আত্মহত্যা ও দুর্দশার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। আর তারাই পারেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করতে। আসলে এ মুহূর্তে এটি তাদের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
– আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা এবং প্রকাশক- উম্মাহ ২৪ডটকম।