Home ইসলাম সুদৃঢ় ঈমান-আমল এবং দ্বীনের দাওয়াত উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ কাজ

সুদৃঢ় ঈমান-আমল এবং দ্বীনের দাওয়াত উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ কাজ

।। আলহাজ্ব সৈয়্দ জহির উদ্দীন ।।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আকাশরাজির ও ভূ-মণ্ডলীর মধ্যে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার কোনটিই উদ্দেশ্যহীন নয়। তবে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর তা হলো, মানুষ পৃথিবীতে তার খিলাফত ক্বায়েম করবে। তথা আল্লাহর যমীনে একমাত্র আল্লাহই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবেন। আর তাই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। অনন্তর আল্লাহ্ তাআলা তাঁর ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক নবী-রাসূলকে আসমানী কিতাব তথা তাঁর বিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই মানুষের ময়দানে দাওয়াত দিয়েছেন দ্বীন-ইসলামের।

আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একই কালেমার দাওয়াত দিয়েছেন। উল্লেখ্য, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ ১৩ বছর শাশ্বত কালেমার দাওয়াত ও দ্বীনের এক জবরদস্ত মেহনত করে আরবের গাফেল অন্তরকে পরিবর্তন করে মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ইন্তিকালের পর আর কোন নবী বা রাসূলের আবির্ভাব ঘটবে না বিধায় এই কালেমার দাওয়াতের যিম্মাদারী দেওয়া হয়েছে আমাদের উপর, অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদীর উপর।

বলা হচ্ছে, “তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি যাদেরকে সমগ্র মানব কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ন্যায় কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজ হতে মানুষকে ফিরাবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।”

বস্তুতঃ ‘আমরে বিল মা’রূফ’ অর্থাৎ ভাল কাজের হুকুম দান ও ‘নাহী আনিল মুনকার’ অর্থাৎ মন্দ কাজের নিষেধ করা উম্মতে মুহাম্মদীর বিশেষ এক দায়িত্ব। এর অনুকূলে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর পবিত্র কালামে একাধিক আয়াতে আমাদেরকে অবহিত করেছেন।

ইরশাদ হচ্ছে, “তোমাদের মধ্যে এমন এক জামাআত থাকা প্রয়োজন যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে।”

আবার বলা হচ্ছে, “হে নবী! আপনি বলে দিন, আমার একটাই মাত্র রাস্তা- আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকা। আর যারা আমাকে অনুসরণ করবে তাদেরও এই কাজ।”

“সুন্দর কথা, নসীহত ও হিকমতের সাথে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান কর।”

“ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে উত্তম কথা কি হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকে এবং স্বয়ং নেক আমল করে এবং বলে আমি মুসলমানদের মধ্যে একজন।”

উল্লিখিত আয়াত দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের প্রত্যেককেই মানুষকে হিদায়ের পথে, আল্লাহর দিকে আহ্বান করতে হবে, অর্থাৎ দাওয়াত দিতে হবে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয়, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধারণা, আমরা তো নামায, রোযা, যিকর-আযকার প্রভৃতি আমলই করছি, আমাদের দাওয়াতের জন্য ঘর ছাড়তে হবে কেন? একান্তই যারা এসব করে না অথবা শক্ত-সামর্থ সম্পশালী, তারাই শুধু এ কাজ আঞ্জাম দিলেই চলবে।

তবে সবচেয়ে বেশী দুঃখজনক যেটা সেটা হলো, আমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছেন যারা কিনা দাওয়াতী কাজের ধারে কাছে তো নেই-ই, উপরন্তু দাওয়াত ও তাবলীগ সম্পর্কে ব্যাঙ্গোক্তি বা উদ্ভট মন্তব্য করে থাকেন। বলা হয়, তাবলীগ জামাআত ৬ উসূল পেল কোথায়? আবার বলা হয়, দীর্ঘ দিন ধরে তো দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ চলছে, তবুও মানুষ সংশোধন হচ্ছে না কেন? এমনও বলা হয়, ওরা কাজ পায় না, শুধু একই কথা (ছয় উসূলের কথা) বার বার বলে মানুষের বিরক্তি সৃষ্টি করে।

আসলে যারা এ ধরনের মন্তব্য করেন, তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই করেন। আমি সেই সব ভাইদের জ্ঞাতার্থে বলছি, আসলে বারবার একই কথা বলার মাহাত্ম এই যে, একই কথা তথা আল্লাহর রড়ত্ব, আযমত, ভয় ও মুহাব্বতের কথা, দ্বীন-ইসলামের কথা বারবার শুনতে শুনতে ও বলতে বলতে তা এক সময় হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে এবং দাগ কাটে। আধুনিক পৃথিবীর রূপ রস আর চাকচিক্যের মোহে পড়ে তার স্রষ্টা ও সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব ভোলা মন ক্ষণিকের জন্য হলেও জাগরূক হয়, সত্য-মিথ্যা চিনতে পারে। এভাবে প্রতিনিয়ত শোনা ও বলার মাঝে কোন এক সময় সে আল্লাহমুখী হয়ে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হন।

আর দীর্ঘদিন ধরে দাওয়াতের ক্ষেত্রে বলা যায়, তাদের দাওয়াত বৃথা যায় না। কেননা, মানুষের প্রতিটি কথাই ইথারের সাথে ভেসে বেড়ায়। তাদের শাশ্বত দাওয়াতও স্ব-স্থানে কেউ গ্রহণ করুক, বা না করুক, তা ইথারের সাথে ভাসতে ভাসতে পৃথিবীর কোন এক জনপদে গিয়ে কার্যকর হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, এই লাগাতার দাওয়াতের কারণেই পাশ্চাত্যের বহু দেশে আজ লক্ষ লক্ষ বিধর্মী মুবারক কালেমা কবুল করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করছে।

উল্লেখ্য, হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণ করলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে হজ্বের দাওয়াত দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহ্! জনপদ তো এখান থেকে অনেক দূরে। আমার আওয়াজ কীভাবে সেখানে পৌঁছবে? প্রত্যুত্তরে তাঁকে বলা হয়েছিল, তোমার কাজ দাওয়াত দেওয়া আর তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। স্মর্তব্য, তিনি হজ্বের দাওয়াত দিলে সেই দাওয়াত জড় জগতের সীমা অতিক্রম করে রূহের জগতে পৌঁছেছিল।

আসলে এ সম্পর্কে কোন অনুভূতি ও বোধশক্তি না থাকার কারণে আমরা কিছু সংখ্যক মানুষ নামায, রোযা, যিকর-আযকার প্রভৃতি নিয়ে মগ্ন থাকছি। অথচ আমাদের ছেলে-মেয়ে, ভাই-ভগ্নী, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব প্রতিনিয়ত দ্বীনহীন গাফেল যিন্দেগী কাটাচ্ছে এবং প্রতি পদক্ষেপে জাহান্নামের দিকে এগুচ্ছে, তা কি একবারও ভেবে দেখেছি কখনও। এরা নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত তো দূরের কথা, পবিত্র কালেমাও জানে না এবং শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না, তার হাজারো দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। ঈমান কি জিনিস, ঈমান কিভাবে আসে আবার যায়, তাও কোনদিন শুনেনি বা জানে না; এমন লোকও বিরল নয়।

কেন আজ আমাদের এ অবস্থা? এ অবস্থার জন্য দায়ী কে? আমাদের মধ্যে কিসের অভাব? সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের আজ ঈমানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমরা আজ কালেমার মেহনত ও দ্বীনের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আসলে আমরা নিজেদের ঈমান-ইয়াক্বীনের অবস্থা কি, তা একবারও পরখ করে দেখছি না। পৃথিবীতে প্রায় শোয়া শ’ কোটি মুসলমান থাকা সত্ত্বেও কেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, কেন আজ আমরা বিধর্মীদের হাতে পদে পদে মার খাচ্ছি? আল্লাহ্ তাআলার সহায্য, মদদ, রহমত ও বরকত থেকে কেন আমরা আজ বঞ্চিত?

কাজেই আর দেরী নয়। এ মুহূর্ত থেকেই প্রত্যেককেই সাধ্যমতো বেশি বেশি আমল করার পাশাপাশি ঈমানের মেহনত ও মুবারক দাওয়াতের কাজেও সময় খরচ করি। কেননা, দ্বীনের মেহনত করার জন্য আমাদেরকে দুনিয়াতে শ্রেষ্ঠ উম্মত করে পাঠানো হয়েছে। মুসলমান ক্বিয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা সকল মানুষের যিম্মাদার। সে নিজে নেক আমল করবে এবং অন্যদেরকে নেক আমলের জন্য আহ্বান করবে।

এক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, দুনিয়াতে প্রতিটি জিনিসের মেহনতের প্রয়োজন। বিনা মেহনতে কোন কিছুরই সফলতা আশা করা যায় না। ঈমানও একজনের এমনি এমনিই আসবে না। ঈমানেরও এক জবরদস্ত মেহনতের প্রয়োজন। কাজেই প্রত্যেকেরই ঈমানের মেহনত করে ঈমানকে মজবুত করা আবশ্যক। আর এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, দুর্বল ঈমান নিয়ে দ্বীন যিন্দা করা সম্ভব নয়। কেননা, শাশ্বত ঈমানের আলোকে ও চেতনায় গাফেল অন্তরকে জাগ্রত করা সম্ভব। আর তাই নিজেকে দৃঢ় ঈমানের অধিকারী হতে হবে এবং আমলের পূর্ণ পাবন্দ হতে হবে।

বস্তুতঃ ঈমানকে দৃঢ় করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে নিজের ভেতরে ঈমানের প্রতি এক্বীন ও আমল গড়ে তোলার পাশাপাশি কালেমার লাগাতার দাওয়াত ও দ্বীনের মেহনত করে শত বছরের নিকশ কালো জাহিলিয়্যাতের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীর বুকে হেরার রৌশনী প্রজ্জ্বলিত করে শান্তির হাওয়া বয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদেরও শাশ্বত ঈমান, আমল ও দাওয়াতের লাগাতার মেহনত করে গাফেল অন্তরকে জাগ্রত করতে হবে।

উল্লেখ্য, দুনিয়াতে শাশ্বত কালেমার মেহনত না করে হাশরের মাঠে উম্মত হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। আর তাই নবীজির শাফাআত পাওয়াও দুস্কর হয়ে পড়বে। আর তাঁর শাফাআত ছাড়া মহান আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়াও মুশকিল হয়ে পড়বে।

আল্লাহ্ তাআলা আমাদের প্রত্যেককেই দাওয়াতের মেহনত কি, তা বুঝবার ও আমল করবার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডটকম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।