Home জাতীয় মিরপুর বেনারশী পল্লীর ‘আল-ইহসান মাদ্রাসা’র দোয়া মাহফিলে আল্লামা কাসেমী যা বলেছেন

মিরপুর বেনারশী পল্লীর ‘আল-ইহসান মাদ্রাসা’র দোয়া মাহফিলে আল্লামা কাসেমী যা বলেছেন

উম্মাহ প্রতিবেদক: গত (১ জুন) সোমবার ঢাকার মিরপুর-১০ বেনারশী পল্লীতে অবস্থিত ‘আল-ইহসান মাদরাসা-ঢাকা’র নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে পৃথক পৃথক দিক-নির্দেশনামূলক বয়ান পেশ করেন রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক পীরে কামেল শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। বয়ান শেষে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদেরকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির লেখাপড়ার উন্নতি এবং দেশ ও জাতির শান্তি ও বরকতের জন্য বিশেষ দোয়া-মুনাজাত পরিচালনা করেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন আল-ইহসান মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, জামিয়া ইসলামিয়া খাদেমুল ইসলাম এর পরিচালক মাওলানা শহীদুল্লাহ কাসেমী, পলাশ নগর আনোয়ারুল উলূম মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা আব্দুস সালাম, বাউনিয়াবাদ দারুল হাবীব মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার মুহাম্মদ সেলিম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শহীদুল আলম বিশ্বাস, জামে বায়তুল সালাত কমপ্লেক্সের পেশ ইমাম মাওলানা বরকত উল্লাহ, মনিপুর বায়তুল আমান জামে মসজিদের খতীব মাওলানা মোশাররফ হোসাইন এবং আল-ইহসান মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মাওলানা হাফিজ উল্লাহ, মাওলানা আরিফুর রহমান, হাফেজ আরিফুল ইসলাম, মাওলানা নূরুজ্জামান, হাফেজ মাওলানা মাওলানা আশরাফ আলী, হাফেজ রহমত উল্লাহ, মাওলানা কারী হাফিজুর রহমান, হাফেজ শফিকুল ইসলাম, মাস্টার আনসার আলী, মাস্টার রায়হান আহমদ প্রমুখ।

সকাল ৭টা থেকে বয়ান শুরু হয়। জামিয়ার আসাতিযায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে ছাত্র গড়ার কলাকৌশল বর্ণনা করে আল্লামা কাসেমী গুরুত্বপূর্ণ নসীহত পেশ করেন। শুরুতেই তিনি বলেন, উম্মুল আমরায তথা সর্ব রোগের মূল হচ্ছে কিবির তথা অহংকার। হুব্বে জাহ্ ও হুব্বে মাল অহংকারের বড় দুটি শাখা। দিলের বড় দুটি রোগ। দিলে কিবির তথা অহংকার নিয়ে ছাত্র গড়া যায় না। ছাত্র গড়তে হলে দিল থেকে রোগ দুটি দূর করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, তালীমের পাশাপাশি তরবিয়তেরও গুরুত্ব দিতে হবে। তরবিয়ত বলা হয়, হযরত হযরত রাসূলে কারীম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম যে ফিকির নিয়ে মেহনত করেছেন ছাত্রদের দিলের মাঝে ওই ফিকির তৈরি করে দেয়া। তালীম হাসিল হয় কিতাব মোতালায়া দ্বারা আর তরবিয়ত হাসিল হয় আকাবির-আসলাফের তরয-তরিকার মোযাকারা ও অনুসরণের দ্বারা। ক্লাশে ছাত্রদের সামনে মাঝে মাঝে আকাবির-আসলাফের তাযকিরা করা চাই।

তিনি বলেন, ছাত্ররা নবীজী (সা.) র মেহমান। তাদের আদর-যত্ন করে পড়াতে হবে। হযরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রাহ.) একবার খোলা আকাশের নিচে সবক পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেলো। ছাত্ররা যে যার মতো তেপায়ী-কিতাব নিয়ে ছুটে ঘরে চলে গেলো। হযরত গাঙ্গুহী (রাহ.) শরীর থেকে চাদর খুলে মাটিতে বিছিয়ে দিলেন। ছাত্রদের জুতাগুলো চাদরে রাখলেন। এবার চাদরের চারকোণ গোল করে কাঁধে করে তা বহন করে ঘরে নিয়ে গেলেন। ছাত্ররা লজ্জিত হয়ে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে হযরত বললেন, “ভাই তোমরা তো আল্লাহর রাসূলের মেহমান। আমি তোমাদের জুতাগুলো হেফাজত করেছি”। আল্লাহু আকবার!

আল্লামা কাসেমী আরো বলেন, প্রথম সবক ছাত্রদের থেকে আদায় করা ছাড়া দ্বিতীয় সবক দিবেন না। ছাত্রদের মারধর করবে না। স্নেহ-সোহাগ দিয়ে পড়াবেন। সমিতি বানানোর ফিকির করবেন না, ছাত্র গড়ার ফিকির করবেন। ছাত্রদের বেশি বেশি সময় দিবেন।

তরীক্বায়ে তালীম প্রসঙ্গে আল্লামা কাসেমী বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্রদের তিন কাজ এবং উস্তাদগণের দুই কাজ। ছাত্ররা ইবারত বিশুদ্ধ পড়বে। ইবারতের সঠিক অনুবাদ করবে। ইবারতের সঠিক মতলব তথা ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করবে। উস্তাদগণের দুই কাজ হল- সবক আদায় করার সময় ‘উহু’ আর ‘হুম’ বলবে। ছাত্ররা ইবারতে ভুল করলে, অনুবাদে ভুল বললে এবং মতলব তথা ব্যাখ্যায় ভুল করলে উস্তাদ শুধু ‘উহু’ বলবেন। ছাত্র কী ভুল করেছেন সেটা ধরিয়ে দিবেন না। ছাত্র পুনরায় বুঝে শুনে যখন শুদ্ধটা বলবেন, তখন উস্তাদ ‘হুম’ বলবেন। ছাত্র ভুল বললে ‘উহু, ছাত্র শুদ্ধ বললে ‘হুম’ বলাই উস্তাদের কাজ।

উস্তাদদের উদ্দেশ্যে বয়ান শেষে ছাত্রদেরকে জমায়েত করা হয়। এরপর আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ইলমে নুবুওয়াতের গুরুত্ব ও মাহাত্য এবং ছাত্রদের করণীয় বিষয়ের উপর গুরুত্বপূর্ণ নসীহত পেশ করেন। তিনি বলেন, ছাত্রদেরকে ইলমের আজমত তথা বড়ত্ব বুঝতে হবে এবং করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। ছাত্রদের করণীয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে সবসময় গুরুত্ব দিতে হবে। যথা- এক নম্বরে ছাত্রদেরকে এই নিয়্যাত করতে হবে যে, ইলমে দ্বীন অর্জন করব আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য। দ্বিতীয়ত: ছাত্রদেরকে নিয়্যাত করতে হবে যে, আমি যা শিখব, সে মোতাবেক আমল করব। তৃতীয়ত: নিয়্যাত করতে হবে- আমি যা অর্জন করব তা নিজের একার জন্য নয়, বরং সারা বিশ্ববাসীর উপকার ও কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যেই অর্জন করব। আমার অর্জিত জ্ঞান সাধ্যমতো বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রসার করে যাব। চতুর্থত: ছাত্রগণ নিয়্যাত করবে যে, আল্লাহ পাক যদি আমাকে লিখনী শক্তি বা লেখার যোগ্যতা দেন, আমার অর্জিত এই ইলমকে লেখার মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রচার করতে সাধ্যমতো কাজ করে যাব। ছাত্রদেরকে এই চারটি নিয়্যাত করতে হবে।

আল্লামা কাসেমী বলেন, ইলম হাসেল করতে হলে একাগ্রতা ও মনোযোগ অপরিহার্য। ছাত্র জীবনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। উস্তাদগণের ইজ্জত-ইহতেরাম বজায় রেখে চলতে হবে।

তিনি বলেন, দরস যেন এমন না হয় যে, উস্তাদগণ শুধু বলেই যাবেন, আর ছাত্ররা কান সুখ করবেন। এভাবে দরস হলে ভাল আলেম তৈরি হবে না। এ কারণেই আজকাল ফারেগ অনেক আলেম দেখা যায়, কিন্তু খুঁজতে গেলে যোগ্য আলেম পাওয়া যায় না। মেহনত না করলে যোগ্য আলেম হবে কী করে? তাই ছাত্রদেকে মেহনত করতে হবে। রাত-দিন কুতুববিনীর মেহনত করতে হবে।

পাঠ্য ও পঠন সম্পর্কে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী আরো বলেন, উর্দূ কায়দা থেকে কাফিয়া জামাত পর্যন্ত হল দরসে নিজামী সিলেবাসের ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন যেই ছাত্রের মজবুত হবে, যে ছাত্র শুরু থেকে কাফিয়া জামাত পর্যন্ত ভালভাবে কিতাব আয়ত্ব করতে পারবে, সে ছাত্র সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। এই ফাউন্ডেশন যদি দুর্বল হয়, তাহলে সে ছাত্র সামনে আগাতে পারবে না, মানে ভাল করতে পারবে না, ভাল আলেম হবে না। সুতরাং যে কোন মূল্যে ফাউন্ডেশন মজবুত করতে হবে। সুতরাং শুরু থেকেই এই ফিকির করতে হবে যে, যাতে ফাউন্ডেশন মজবুত হয়।

ছাত্রদের আমলের প্রসঙ্গে আল্লামা কাসেমী বলেন, ছাত্রদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায তাকবীরে ঊলার সাথে জামাতে আদায় করতে হবে। ছাত্র হাফেজ হলে প্রতিদিন পবিত্র কুরআনের তিন পারা এবং হাফেজ না হলে এক পারা তিলাওয়াত করতে হবে। শেষ রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ পড়তে হবে। তাহাজ্জুদ শেষে আল্লাহ পাকের কাছে কান্নাকাটি করবে। নিজের জন্য, দেশের জন্য, সমাজের জন্য এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সফলতা ও অগ্রগতির জন্য দোয়া করবে।

উস্তাদ ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে পৃথক পৃথকভাবে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা বয়ান শেষে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সকলকে নিয়ে বিশেষ দোয়া-মুনাজাত পরিচালনা করেন। দোয়ায় তিনি প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি, কামিয়াবী, পড়ার সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশের জন্য দোয়া করেন। দেশে ও জাতির উন্নতি, শান্তি ও বরকতের জন্য দোয়া করেন। উম্মতে মুসলিমাহ’র জন্য দোয়া করেন। এরপর আল-ইহসান মাদরাসা-ঢাকা’র শিক্ষক ও অতিথিবৃন্দের সাথে একসাথে সকালের নাস্তা করেন।

নাস্তা শেষে আল-ইহসান মাদ্রাসা-ঢাকা’র পরিচালক মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী এবং অন্যান্য শিক্ষক ও ছাত্ররা আল্লামা কাসেমীকে আন্তরিক বিদায় জানান।

বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ