Home ইসলাম বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ

বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ

।। মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী ।।

দশম হিজরী সনের ২৫ যিক্বাদাহ, সোমবার। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কার পথে রওনা হলেন। সঙ্গে সাহাবায়ে কিরামের বিশাল কাফেলা। প্রায় সোয়া লক্ষ লোকের সমাবেশ। মদীনা থেকে দুই মাইল দূরে ‘যুল হুলাইফা’ নামক স্থানে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ্বের ইহরাম বাঁধেন।

৪ যিলহজ্ব, শনিবার। রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় এসে পৌঁছেন এবং সর্বপ্রথম উমরাহ আদায় করেন। সাহাবায়ে কেরামগণও নবীজির সাথে উমরা আদায় করেন। অতপর ৯ যিলহজ্ব পর্যন্ত মক্কায় অপেক্ষা করতে থাকেন।

৯ যিলহজ্ব, শুক্রবার। রাসূলুল্লাহ (সা.) সকল সাহাবাকে নিয়ে আরাফার ময়দানে ‘জাবালে রহমত’-এর সন্নিকটে অবস্থান নেন। পবিত্র হজ্বের জন্যে মুসলমানদের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক বিশাল সমাবেশ। যাতে প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতি ছিল।

এখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। এই ভাষণের ভাষা, শব্দ ও বক্তব্য সবটাই ছিল ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী। এটা ছিল সর্বশেষ নবীর সর্বশেষ পয়গাম। এত মানুষের সমাগম ছিল যে, কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) ভাষণ দেওয়ার জন্যে স্বীয় উষ্ট্রীর (আযবায়ের) পিঠে সাওয়ার হয়ে একটি উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন। সাহাবায়ে কেরাম শুধু সামনের দিকে দেখছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর জ্যোতির্ময় চেহারা মুবারক ছাড়া আর কোন কিছুই তাদের দৃষ্টির সামনে নেই।

চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। সমবেত সবাই হজ্বের প্রধান রোকন পালন অর্থাৎ আরাফার ময়দানে অবস্থানরত অবস্থায়। উপস্থিত সোয়া লক্ষ সাহাবায়ে কেরামসহ ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মুসলমান আসবে সকলকে উদ্দেশ্য করে যে ভাষণ দান করেছিলেন, তা-ই ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। এই ভাষণদানের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন। দশম হিজরীর ৮ যিলহজ্ব ভাষণ দেন এবং একাদশ হিজরীর রবীউল আউয়ালের প্রথমার্ধে তিনি ওফাত গ্রহণ করেন।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ভাষণ শুরু করলেন। তিনি প্রথমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের পর সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইরশাদ করলেন- হে মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দ! আজ আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো। আমি তোমাদের জন্যে কিছু জরুরী কথা বলব। আমার মনে হচ্ছে, এরপর হজ্ব অনুষ্ঠানে যোগদান করা আমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।

* শুনে রাখো, মূর্খতার যুগের সকল কু-সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এবং সকল প্রকার অনাচার আজ রহিত ও বাতিল হয়ে গেল।

* জাহেলী যুগের রক্তের বদলা বা প্রতিশোধ আজ হতে মুছে দেওয়া হল। জাহেলী যুগের সর্বপ্রকার সুদ আজ হতে বাতিল। আমি সর্বপ্রথম ঘোষণা করছি, আমার স্বগোত্রের প্রাপ্য সর্বপ্রকার সুদ ও রক্তের প্রতিশোধের দাবী আজ হতে রহিত হয়ে গেল।

* একজনের অপরাধে অন্যকে দণ্ড দেওয়া যাবে না। অত:পর পিতার অপরাধের জন্যে পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্যে পিতাকে দায়ী করা চলবে না।

* যদি কোন নাক কাটা ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমীর করে দেওয়া হয় এবং সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদেরকে পরিচালনা করতে থাকে, তাহলে তোমরা সর্বোতভাবে তার অনুগত হয়ে থাকবে। তার আদেশ মান্য করে চলবে।

* সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।

* আর শুনে রাখো, আজ থেকে এক মুসলমানের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু, রক্ত- ক্বিয়ামত পর্যন্ত অন্য মুসলমানের জন্যে হারাম করে দেওয়া হল। আজকের এই হজ্ব দিবস যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমাপূর্ণ এবং মক্কার এই হেরেম যেমন পবিত্র, প্রত্যেক মুসলমানের ধন-সম্পদ, মান-সম্ভ্রম ও রক্তের ফোঁটা তোমাদের প্রতি সেরূপ মহান, অনুরূপ পবিত্র। উল্লিখিত বিষয়গুলোর পবিত্রতাহানী করা যেমন তোমরা প্রত্যেকেই অবশ্য পরিত্যক্ত ও হারাম বলে বিশ্বাস করে থাকো, কোন মুসলমানের সম্পত্তির, সম্মানের এবং তার প্রাণের ক্ষতিসাধন করাও তোমাদের প্রতি হারাম, সেরূপ মহাপাপ।

* জেনে রাখো, নিশ্চয়ই এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, আর সকল মুসলমানকে নিয়েই এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ।

* হে লোক সকল! সাবধান! কোন মুসলমান ভাইয়ের সম্পদ তার অনুমতি ছাড়া ভক্ষণ বা ব্যবহার করা হারাম। আর আমার ওফাতের পর আবার তোমরা কাফির হয়ে যেয়ো না। একজন আরেক জনকে অত্যাচার ও হত্যা করো না।

* চারটি কথা বিশেষভাবে স্মরণ রেখো, ১. শিরক করবে না। ২. অন্যায়ভাবে নর হত্যা করবে না। ৩. পরসম্পদ আত্মসাৎ করবে না এবং ৪. ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না।

* হে বন্ধুগণ! সাবধান, কোন মানুষের উপর যুলুম, অত্যাচার করো না। কারো অসম্মতিতে তার সামান্য সম্পদেও হাত দিবে না।

* আমি বিদায় বেলায় তোমাদের কাছে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। এগুলো দৃঢ়তার সাথে ধরে রাখলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। সেগুলো হচ্ছে- ১. আল্লাহর কিতাব, ২. আমার সুন্নাহ বা আদর্শ।

* হে মুসলমানগণ! শুনে রাখো, আমার পর আর কোন নবী বা রাসূল আসবে না। আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করো। এ বছরের পর তোমরা হয়তো আর আমার সাক্ষাত পাবে না। ইলম উঠে যাওয়ার পূর্বে আমার নিকট হতে শিখে নাও।

* হে লোক সকল! শয়তান নিরাশ হয়েছে। সে আর কখনো তোমাদের দেশে (আরবে) পূজা পাবে না। কিন্তু সাবধান! অনেক বিষয় তোমরা ক্ষুদ্র বলে মনে করে থাকো, অথচ শয়তান তার মধ্য দিয়ে প্রায়শঃ তোমাদের সর্বনাশ করে থাকে। সেগুলো সম্বন্ধে খুব সতর্ক থাকবে।

* অত:পর হে লোক সকল! নারীদের প্রতি কখনো নির্মম ব্যবহার করো না। নিশ্চয় তোমরা তাদেরকে আল্লাহর যমীনে গ্রহণ করেছো। তোমাদের সহধর্মিনীগণের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তাদেরও তোমাদের প্রতি একইরূপ অধিকার রয়েছে। একে অপরকে নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করবে। স্মরণ রাখবে, এই অবলাদের একমাত্র ‘বল’ তোমরাই। এই নিঃসহায়দের একমাত্র ভরসা তোমরাই।

* আর তোমাদের দাস-দাসী! তারা নিঃসহায়, নিরাশ্রয়। সাবধান! এদের নির্যাতন করো না। এদের মনে ব্যথা দিয়ো না। শুনে রাখো, তোমরা যা খাবে তাদেরও তা-ই খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তা-ই পরাবে।

* যে ব্যক্তি নিজের বংশের পরিবর্তে নিজেকে অন্য বংশের বলে প্রচার করে, তার উপর আল্লাহর এবং ফেরেশতাগণের ও সমগ্র মানব জাতির অনন্ত: অভিসম্পাত।

* আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব কুরআন রেখে যাচ্ছি। তোমরা যতদিন এই কিতাব অবলম্বন করে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না।

* হে মুসলমান ভ্রাতৃমণ্ডলী! তোমাদের নিকট কোন ব্যক্তির আমানত গচ্ছিত থাকলে, তা যেন যথাযথভাবে আদায় করে দেয়া হয়।

* হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক। তোমাদের পিতা-মাতা এক। তোমাদের সকলেই আদম (আ.)এর সন্তান। আর হযরত আদম (আ.) হলেন মাটির সৃষ্টি। সুতরাং এক দেশের লোকের উপর অন্য দেশের মানুষের কোন পার্থক্য বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হল, তাক্বওয়া বা আল্লাহ ভীতি।

* তোমাদের মধ্যে যে যত বেশী আল্লাহ্কে ভয় করবে, আল্লাহর নিকট সে ততবেশী সম্মানী ও শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে।

* অত:পর রাসূলুল্লাহ (সা.) আকাশ পানে মুখ তুলে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ্! আমি কি তোমার বাণী পৌঁছে দিতে পেরেছি? যে বাণী তোমার বান্দাদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আমাকে প্রেরণ করেছিলে। অত:পর সকলের দিকে লক্ষ্য করে বললেন- আমি কি ঠিকঠাক মতো নিজের কর্তব্য সম্পাদন করেছি? তখন উপস্থিত সোয়া লক্ষ সাহাবী এক বাক্যে বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, আপনি আল্লাহর বাণী আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। নিজ কর্তব্য পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পাদন করেছেন।

* সাহাবায়ে কিরামের স্বতঃস্ফূর্ত এই স্বীকারোক্তি শুনে খুশীতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। তিনি শূন্যে দু’হাত তুলে আল্লাহ্কে সাক্ষী রেখে বললেন, হে প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! তুমি নিজেই সাক্ষী থাকো। এভাবে তিন বার বলেন। অত:পর নবীজির বুক আবেগে ফুলে উঠে, চক্ষুদ্বয় থেকে অনবরত অশ্রু ঝরতে থাকে।

* তারপর উপস্থিত সাহাবাগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা যারা এখানে উপস্থিত আছ, তোমাদের দায়িত্ব হল, আমার এই কথাগুলো যারা উপস্থিত নেই, তাদের নিকট পৌঁছে দেওয়া। হয়তো অনুপস্থিতদের অনেক লোক এর দ্বারা আরো বেশী উপকৃত হবে।

* এই বলে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ শেষ করতেই হযরত জিব্রাঈল আমীন (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নতুন পয়গাম নিয়ে হাজির হন। আল্লাহর বাণী, ইরশাদ হল- “আজ আমি তোমাদের ধর্ম (ইসলাম)কে পূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের জন্যে আপন নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর একমাত্র ইসলামকেই ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়েদাহ, আয়াত নং- ৩)।

ভাষণ শেষে এই পয়গাম ইরশাদ হওয়ায় হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনতার দিকে মুখ ফিরিয়ে করুণ ও গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, বিদায়, বন্ধুগণ বিদায়! এই বলে ভাষণ সমাপ্ত করেন।

সচেতন সাহাবায়ে কেরাম কিন্তু সেদিনই বুঝতে পেরেছিলেন, আল্লাহর হাবীব আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়তো আর বেশী দিন আমাদের মাঝে থাকবেন না। তাঁর বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। অজানা এই বিদায় বিয়োগে মূহ্যমান হলেন সকলে। এরপর হজ্বের অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় চলে আসেন। এ সফরে রাসূলুল্লাহ (সা.) মোট ১০ দিন মক্কায় অবস্থান করেছিলেন।

লেখক: বিশিষ্ট আলেমে-দ্বীন, ইসলামী রাজনীতিবিদ, দায়ী এবং পরিচালক- ‘আল-ইহসান মাদরাসা ঢাকা’, বেনারাশী পল্লী, ১০নং সেকশন, মিরপুর-১০, ঢাকা।

ঈদ-উল-ফিতরের ফাযায়েল ও মাসায়েল