Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ কাশ্মীর দখলদারিত্বে বৈশ্বিক মেরুকরণ

কাশ্মীর দখলদারিত্বে বৈশ্বিক মেরুকরণ

।। মাসুম খলিলী ।।

ভারতের নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করে দখলদারিত্বের এলাকা হিসাবে মোদি সরকার এটিকে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় এনেছে। আর এ জন্য ভারতকে কতটা মূল্য দিতে হবে এ নিয়ে বেশ হিসাব নিকাশ শুরু হয়েছে দেশটির ভেতরে ও বাইরে। ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় সরকারের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন বিরোধি রাজনৈতিক নেতারা। সমালোচনা হচ্ছে বৈশ্বিক ফোরামগুলোতেও।

পাকিস্তানের আহ্বানে ও চীনের জোরালো সমর্থনে বিষয়টি নিয়ে জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসছে। এর আগে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার জরুরি অধিবেশনে কাশ্মীরে ভারতের একতরফা পদক্ষেপের নিন্দা ও উদ্বেগ জানানো হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে এটি নিয়ে আলোচনার আগে রাশিয়া কাশ্মীরের পদক্ষেপটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করে মোদির নীতিকে কার্যত সমর্থন জানিয়েছে। অন্য দিকে চীন স্পষ্টত সমর্থন জানিয়েছে পাকিস্তানের অবস্থানকে। এ নিয়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় পুরো বিশ্বব্যাপি যে ঝড় উঠতে পারে তার লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ভারতের কাশ্মীর পদক্ষেপের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে এর মধ্যে বিশ্ব মিডিয়ায় কাশ্মীর নিয়ে ভারতের পদক্ষেপের চুল চেরা বিশ্লেষণ এবং এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমেরিকান ফরেন পলিসি সাময়িকীর মতে, সাম্প্রতিক দুটি ঘটনাবলি সম্ভবত মোদি সরকারকে এ সময়ে কাজটি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এর প্রথমটি ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাশ্মীর বিরোধের মধ্যস্থতার প্রস্তাব। দ্বিতীয়টি একটি দ্রুত অগ্রগতিশীল আফগানিস্তান শান্তি প্রক্রিয়া। এটি ইসলামাবাদের বিশেষ সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছিল, যার পরিণামে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এটি তালেবানকে সরকারে একটি বিশিষ্ট ভূমিকায় নিয়ে আসবে যার প্রতিটি উন্নয়ন পাকিস্তানের হাতকেই কার্যত শক্তিশালী করতে পারে। কাশ্মীর নিয়ে নাটকীয় পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে নতুন দিল্লি ইসলামাবাদকে এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও পিছিয়ে রাখতে সক্ষম হবে বলে ভারতের নীতি প্রণেতাদের ধারণা। এর মাধ্যমে বাইরের মধ্যস্থতার প্রতি নয়াদিল্লির সম্পূর্ণ অনাগ্রহের বিষয়ে ওয়াশিংটনের কাছে একটি জোরালো বার্তাও দিতে চাইতে পারে ভারত।

ফরেন পলিসি সাময়িকীর মতে, ঘরোয়া রাজনীতিও মোদির এ কাজের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। সদ্য নির্বাচিত বিজেপি’র প্রথম দিকের পদক্ষেপটি তার মর্যাদা বাড়াবে এবং ভোট ভিত্তির কাছ থেকে বাড়তি সমর্থন যোগাতে পারে। আর এ ধরনের সমর্থন ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থান সঙ্কটকে কাটাতে সরকার যে লড়াই করে যাচ্ছে সে ব্যাপারে সম্ভাব্য হতাশা এবং ক্ষোভকে আড়াল করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, এটি কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, বিজেপি তার পূর্ববর্তী মেয়াদের পর তার সমর্থক ঘাঁটি থেকে সমর্থন আকৃষ্ট করার জন্য আরও একটি নিশ্চিত উপায় হিসাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নতুন কৌশল বের করেছে। এটি প্রতিশ্রুত আর্থিক সংস্কারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যর্থ সংগ্রামের পরে হাজির করা হয়েছে।

ফরেন পলিসি মনে করছে, ধারা ৩৭০ বাতিল করা হবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ভারত একতরফাভাবে এই অত্যন্ত বিতর্কিত অঞ্চলের মর্যাদা পরিবর্তন করছে, যা বিশ্বের সর্বাধিক সামরিকীকরণের স্থানের একটি। নয়াদিল্লি এটি বুঝতে পেরেছে এর জন্য মূল্য দিতে হবে। এ কারণেই এটি ঘোষণার আগে একটি কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও গ্রহণ করে রেখেছিল। 
অনেক কাশ্মীরির জন্য, অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর ব্যবহারিক অর্থের চেয়ে প্রতীকী গুরুত্ব বেশি ছিল। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘকালীন দমন-পীড়নে স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটির গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছিল। নিরাপত্তা কর্মীদের কাছ থেকে নিয়মিত দমন পীড়নের শিকার হবার পাশাপাশি অনেক কাশ্মীরি তাদের মত প্রকাশ এবং চলাচলের উপর প্রতিদিনের বিধিনিষেধের মুখোমুখি হন। তবুও, অনেক কাশ্মীরি মুসলমান, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রভাবশালী দল এবং ভারতীয় দখলদারিত্বের শিকার ভুক্তভোগীদের জন্য অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করা একটি দুঃস্বপ্নের দৃশ্য। কারণ এটি তাদের এমন একটি ভারতীয় রাষ্ট্রের আরও নিকটে নিয়ে আসে যাতে তারা অব্যাহত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হবে। তাদের বেশিরভাগই এখন ভারতীয় শাসনমুক্ত থাকতে চান বলে ফরেন পলিসি উল্লেখ করেছে।

ফরেন পলিসির এই মূল্যায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কতটা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ রয়েছে তা নিয়ে যে কেউ বিতর্ক তুলতে পারেন। তবে যারা নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্ট এর মতো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্রের কাশ্মীর নিয়ে লেখাগুলো পড়বেন তারা বুঝতে পারবেন মোদির পদক্ষেপকে আমেরিকান ডিপ স্টেট ইতিবাচকভাবে নেয়নি। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ট্রাম্প প্রশাসন ভারত পাকিস্তান পরস্পরের সাথে আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান করার কথা বলেছে। ট্রাম্প বার বার এই ইস্যু নিয়ে মধ্যস্থতার কথা বললেও চীন রাশিয়ার মতো সুষ্পষ্ট অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র নাও নিতে পারে। ওয়াশিংটনের জন্য এখন একদিকে শান্তিপূর্ণভাবে আফগান সংকটের সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন। অন্য দিকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিক্রির জন্য ভারতকে বৈরি না করার বিষয়টিও দেশটির সামনে রয়েছে।

বিশ্ব শক্তি সমূহের মধ্যে এখন চীন ও রাশিয়া যে কোন আন্তর্জাতিক সংকটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ। অতি সম্প্রতি ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুব্রাহ্মণিয়াম জয়শঙ্কর চীন সফর করেন। যদিও কাশ্মীর পদক্ষেপের আগেই এই সফরের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অনেকে এই সফরকে জরুরি হিসাবে বিবেচনা করেন এবং এটিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশির সদ্য সমাপ্ত চীন সফরের সাথে সংযুক্ত করছেন।

ভারত একতরফাভাবে যে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনকে বাতিল করে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে পরিবর্তন করে এই ইস্যুতে চীনের প্রভাবশালী সরকারি পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসে চীনা অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নয়াদিল্লির ঘোষণায় চীন ও ভারতের মধ্যে বিরোধের অঞ্চলটিকেও উত্তপ্ত করা হয়েছে, ফলে এর চেইন প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান ঘোষণা করেছে যে, তারা ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করবে এবং বাণিজ্য সম্পর্ক এর মধ্যে স্থগিত করেছে। কাশ্মীর ইস্যু অত্যন্ত জটিল এবং ভারতের এই পদক্ষেপ চীনের স্বার্থকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে বলেছে যে ভারতের পদক্ষেপ “অগ্রহণযোগ্য”।’

গ্লোবাল টাইমস বলেছে, ‘নয়াদিল্লি সীমান্ত ইস্যুতে খুবই বেপরোয়া। দেশটি একতরফা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতির উপর প্রভাব পড়ে এমন স্থিতাবস্থা ভঙ্গ করে। এর পদক্ষেপগুলি আশেপাশের দেশগুলির স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ জানায়, তবে তারা চায় যে এই দেশগুলি উস্কানিমূলক আচরণকে হজম করবে এবং ভারতের তৈরি করা নতুন ব্যবস্থাকে মেনে নেবে।’

কমিউনিস্ট পার্টির এই মুখপাত্র বলেছে, ‘জাতিসত্তা বা ধর্মের ভিত্তিতে কার্যকর একটি স্বশাসিত অঞ্চলকে কেন্দ্রিয় শাসিত অঞ্চলে পরিবর্তন করা সকল দেশেই অত্যন্ত সংবেদনশীল। কাশ্মীর এমন একটি বিতর্কিত অঞ্চল, যেখানে বিংশ শতাব্দীতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি বিশাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পাকিস্তান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভারতের পদক্ষেপে প্রভাবিত হয়েছে। পাকিস্তান যদি শক্তিশালী পাল্টা ব্যবস্থা না নেয় তবে তা হবে অকল্পনীয়।’

পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে, ‘পাকিস্তান ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মুসলমানদের বিরোধিতার প্রকৃত একটি পরিণতি এখানে আসতে পারে। মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে ভারতের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করলে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা ভারতের ব্যবস্থার পক্ষে কঠিন হবে। আমরা দেখতে পাই না যে, এই অঞ্চলটি পুরোপুরি দখল করার মতো ভারতের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সংস্থান রয়েছে।’

নয়াদিল্লির অনেক বেশি মাত্রায় আত্মবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে গ্লোবাল টাইমস বলেছে, ‘ভারতের ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে মোদী প্রশাসনের ক্ষমতা এবং মর্যাদা সংহত হয়েছে বলে তারা মনে করছে। তাদের ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যও ভারতের সাথে থাকতে পারে। ভারতও এমন মনে করে যে চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ব্যস্ত, তাই সীমান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য এটি এখন ভাল সময়। তবে এটি কোনও বড় শক্তির জন্য সঠিক কৌশল নয়। ভারতের উপরে উঠতে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ প্রয়োজন। এমনকি ভারত যদি তার ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও একতরফাবাদকে সফল করে তোলে তবে তা নতুন বিদ্বেষকে জাগিয়ে তুলবে। দক্ষিণ এশিয়ায় একতরফাবাদ নিয়ে খেলা ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা মোটেই বাহুল্য নয়।’

গ্লোবাল টাইমস বলেছে, ‘পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং এর রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থানীয় বাহিনীর উপর শিথিল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ভারতের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে প্রতিবেশী দেশটিকে ছোট করার চেষ্টা না করা। ভারতের এই বিশ্বাস থাকে পারে যে, আগের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সহজ করার প্রচেষ্টা দেশীয় ইসলামী উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা চালিত সহিংস হামলার কারণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং তাই তারা একটি পূর্ণ মাত্রার কঠোর নীতি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত যে, উত্তেজনাপূর্ণ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কেবল একটি সংবেদনশীল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।’

গ্লোবাল টাইমস’র সম্পাদকীয়ের অনুসিদ্ধান্ত বক্তব্য হলো, ‘আঞ্চলিক, জাতিগত এবং ধর্মীয় বিরোধগুলি কাশ্মীরে এখন ঘণিভূত। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল নয়। জাতিসংঘ কাশ্মীরের মর্যাদার বিষয়ে প্রস্তাব পাস করেছিল। অঞ্চলটির প্রকৃতি পরিবর্তন করতে ভারতের বলপূর্বক পদক্ষেপটি সহজেই এগিয়ে যেতে পারার সম্ভাবনা নেই। নয়াদিল্লির একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতি নতুন ও পুরাতন ঘৃণা সামনে দেশটিকে কঠিন ফাঁদে ফেলবে। নয়াদিল্লি যদি তার বেপরোয়া কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলিকে সমর্থন করার জন্য জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে তবে একটি অত্যন্ত মন্দ স্ফুলিঙ্গের সুচনা হবে। ভারতকে ক্রমবর্ধমানভাবে উগ্রবাদী হতে হবে। আর একটি অতি জাতীয়তাবাদী ভারতের কোনও ভবিষ্যত নেই। এশিয়ার সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক প্যাটার্ন এ জাতীয় ভারতকে গ্রহণ করবে না। যুক্তিসঙ্গত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ প্রধান শক্তি হলে তাতে ভারতের ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হবে।’
কাশ্মীরের সাথে বাংলাদেশের ভাগ্যের যে যোগসূত্র রয়েছে সেটি অনেকেই সামনে আনতে চান না। ‘কাশ্মীর ইস্যু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’- বাংলাদেশেও এই প্রচার জোরে সোরে চালানো হচ্ছে। এ নিয়ে বিশ্লেষক ফরহাদ মজহারের বক্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তার মতে, ফিলিস্তিন যেমন আন্তর্জাতিক ইস্যু, কাশ্মীরও তাই। কারণ, কাশ্মীর কখনই ভারত কিম্বা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত ছিল না।

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ থাকার অর্থই হচ্ছে কাশ্মীর ভারতীয় সংবিধানের অধীনস্থ কোন ভূখণ্ড বা রাজ্য নয়। তার স্বাধীন রাজনৈতিক অস্তিত্বের স্বীকৃতি ৩৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই অনুচ্ছেদ বাতিল করার অর্থ হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের পররাজ্য দখল ও আগ্রাসন। আজ যদি ভারত একতরফা হিন্দুত্ববাদী সিদ্ধান্তে কাশ্মীর দখল করে নিতে পারে, কাল তারা দুর্বল বাংলাদেশ গ্রাস করে নিতে পারবে আঙ্গুলে তুড়ি মেরে। যারা দাবি করে ‘কাশ্মীর ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়’ তারা ভারতীয় আগ্রাসনের আগাম বাহিনী বা দখলদার হয়েই একথা বলে। কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বললেও বাংলাদেশের জনগণকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘কাশ্মীর কখনই ভারতের ছিল না। অতএব এই দিক থেকেও কাশ্মীর কখনই ভারতের ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’ নয়। এই উপমহাদেশ নানান জাতিগোষ্ঠি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষায় সমৃদ্ধ। নানান জনগোষ্ঠি ও রাজ্যে স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে ঐক্য ও সম্প্রীতির ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং উপমহাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ চায় অন্যদের নির্মূল করে হিন্দু, হিন্দি ও হিন্দুস্তানের ‘রাম রাজ্য’ কায়েম করতে। হিন্দুত্ববাদ মূলত ভারত ভাঙবার রাজনীতি, গোলকায়নের কালে সবাইকে নিয়ে নতুন করে গড়বার দূরদর্শিতা নয়। এর সঙ্গে সাধারণ হিন্দুর স্বার্থ জড়িত নাই, জড়িত কর্পোরেট স্বার্থ যারা ভারতকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিতে তৎপর।

ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাদ দেবার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশ ব্যাপী আরেকটি বড় তুফানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আসামে নাগরিকপঞ্জির কারণে ৪০ লাখ লোক বাদ দেওয়া ও তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবার কথাও আছে। সংবিধান ও আইনকে হাতিয়ার বানিয়ে একদিকে জম্মু ও কাশ্মিরের ভূখণ্ড দখল, অন্যদিকে নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করে বিপুল জনগোষ্ঠিকে রাষ্ট্রহীন করবার হিন্দুত্ববাদী নীতি একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের জনগণ যদি অত্যাসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে চায় তাহলে অবিলম্বে কাশ্মিরি জনগনের লড়াই এবং মানবিক, নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার বঞ্চিত ভারতীয়দের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। উপমহাদেশকে ‘সবকে সাথ’ নিয়ে সামনে আগাতে হলে সকল নাগরিক, মানবিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার কায়েমের জন্য হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই অনিবার্য হয়ে উঠেছে।’

ইতিহাস বলে, হিন্দুত্ববাদীরা কাশ্মীর দখল করে নিয়ে হজম করতে পারবে সেটা অতীতে সম্ভব হয় নি, আগামিতেও সম্ভব নয়। এ কারণে ফরহাদ মজহার প্রশ্ন তুলেছেন, নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে কলোনিয়াল ইংরেজের আঁকা সীমানা ভেঙেচুরে উপমহাদেশ নতুনভাবে পুনর্গঠনের বীজ হিন্দুত্ববাদীরাই রোপন করল কিনা? নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরের আলোচনায় নতুন করে এর আন্তর্জাতিকীকরণ শুরু হলো। রাশিয়া ভারতে তার বড় অঙ্কের সমরাস্ত্র বিক্রির স্বার্থে সেখানে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করতে পারে। তবে মস্কো যে মোদি সরকারের দ্বিধাগ্রস্ততা নিয়ে খুশি নয় সেটি স্পষ্ট পাকিস্তানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণের উদ্যোগে। সব মিলিয়ে রশিকে বেশি পাকিয়ে শক্ত করতে গেলে যেরকমভাবে তা ছিন্ন হয়ে যায় সেরকম একটি অবস্থার সম্মুখিন দিল্লি কাশ্মীর নিয়ে হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। 

লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ই-মেইল: mrkmmb@gmail.com