Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন সৎ ও খোদাভীরুদের সাহচর্যে থাকার উপকারিতা

সৎ ও খোদাভীরুদের সাহচর্যে থাকার উপকারিতা

।। মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী ।।

মানব সমাজে জ্ঞানী-সচ্চরিত্রবান এবং খোদাভীরু ব্যক্তিকেই সাধারণতঃ সৎ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমন আদর্শ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকের সংসর্গ লাভ করা বাস্তবিকই সৌভাগ্যের পরিচায়ক। কেননা সৎ ও সুধীজনের সংসর্গে মানুষ ধন্য হয় এবং তাঁর থেকে উত্তম চরিত্র, উন্নত মানের শিক্ষা আর সদুপদেশ লাভে উপকৃত হয় ও স্বীয় সৎ-যিন্দেগী গঠনে ব্রতী হয়। কেননা, মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে তাঁর কুদরতে এরূপ অনুকরণ-অনুসরণ জ্ঞান দান করেছেন, যদ্বারা সে যা দেখে ও যা শুনে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। তবে এক্ষেত্রেও বিবেকবান মানুষকে তার বুদ্ধি-বিবেচনা এবং সম্যক জ্ঞান খাটিয়ে সত্য-অসত্য, ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভ এবং মঙ্গল-অমঙ্গলের তারতম্য করে সৎ ও জ্ঞানী জন থেকেই তার কল্যাণমুখী জ্ঞান ও শিক্ষা গ্রহণ করবে।

এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ কুরআনের বর্ণনা নিম্নরূপ

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে ঈমানদারগণ! (চলা-ফেরা ও সকল কাজে) তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং (যারা দ্বীন ধর্মের ব্যাপারে অটল এরূপ) সত্যবাদীদের সংসর্গ গ্রহণ কর।” (সূরা তাওবাহ)।

এস্থলে সত্যবাদীদের সংগে থাকা এবং সত্যবাদীদের সংসর্গ গ্রহণ করার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা সত্যবাদীদের সাহচর্য এবং তাদের অনুরূপ আমলের মাধ্যমে তাক্ওয়া (খোদাভীতি) অর্জন কর। পক্ষান্তরে মিথ্যাবাদী ও নাফরমানদের সাহচর্য ত্যাগ করার প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কুরআন মাজীদে সত্যবাদীদের কথা দ্বারা মূলতঃ আলেম ও সালিহীন (সৎকর্মশীল)দের প্রকৃত পরিচয়ই দেয়া হচ্ছে। যারা সত্যিকার ইলমে দ্বীন জেনে ও বুঝে ঐসব জ্ঞানী বা আলেম একান্ত সৎ ও সত্যবাদীতার সাথে ভিতরে ও বাইরে এক সমান এবং নিয়্যাত ও ইচ্ছায় এবং কথায় ও কাজে সমান সত্য।

একারণেই আল্লাহ তায়ালা সর্বসাধারণ ঈমানদারদেরকে কথায়-কাজে এবং আখলাক-চরিত্রে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর বলার পরপরই সত্যবাদীদের তথা আলেমদের সংশ্রব ও সংসর্গের উপর জোর দিয়েছেন। এর দ্বারা সচ্চরিত্র, সৎজ্ঞান এবং সৎকার্য-কলাপের শিক্ষান্বেষীদেরকে একান্ত জোরালোভাবেই নির্দেশ প্রদান করতঃ দ্বীনি সত্য-জ্ঞান শিক্ষার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।

সৎব্যক্তিদের সংসর্গ সম্পর্কে হাদীসের বর্ণনা

(১) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “তোমরা যাদের সংসর্গ গ্রহণ কর এদের মধ্যে সৎ ও উত্তম ঐ ব্যক্তি যাকে দেখামাত্র আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। যার কথাবার্তা ও উপদেশসমূহে তোমাদের জন্য ইলমে দ্বীন (ধর্মীয় জ্ঞান) শিক্ষার সম্পূরক ও পরিবর্ধক হয় এবং যার আমল ও কার্য-কলাপ তোমাদের পরকাল স্মরণ করিয়ে দেয়।” (আবু ইয়ালা)।

(২) হযরত লুকমান হাকীম স্বীয় পুত্রকে বলেছিলেন, বৎস! তুমি আলেম-উলামা ও সত্যিকার জ্ঞানীদের সংসর্গ গ্রহণ কর। কেননা, এদের (জ্ঞানীদের) থেকে তুমি প্রকৃত জ্ঞানের কথা জানতে পারবে ও শিখতে পারবে। ফলে বৃষ্টির মুশলধার পানিতে যেরূপ মৃতপ্রায় শুষ্ক যমী তরতাযা হয়ে উর্বর শক্তি লাভ করে, তদ্রূপ জ্ঞানীদের সংসর্গ লাভে তোমার অন্তরেও প্রকৃত জ্ঞানের আলো সৃষ্টি হবে। (তবরানী)।

(৩) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “ঐ ব্যক্তির জন্য আমার মুহাব্বত একান্ত জরুরী হয়ে পড়বে যারা সততার সাথে নিঃস্বার্থভাবে পরস্পর মায়া-মুহাব্বত স্থাপন করে এবং সত্য ও সঠিক জ্ঞানাহরণের উদ্দেশ্যে যারা একে অন্যের সাথে উঠাবসা করে।” (মুয়াত্তা মালেক ও ইবনে হাব্বান)।

(৪) জ্ঞানী ও অজ্ঞানের সংসর্গ গ্রহণ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “জ্ঞানী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যেমন আতর ও সুগন্ধি বিক্রেতার তুল্য হিসেবে তুমি যদি তার কাছ থেকে আতর ক্রয় নাও কর তবুও তার কাছে বসলে পর সুগন্ধিতে মোহিত হবে। আর অজ্ঞানের দৃষ্টান্ত যেমন, কর্মকার তুল্য হিসেবে তুমি যদি তার থেকে কোন কিছু নাও আন, তবুও তার জ্বালানো অগ্নির ধোঁয়ায় তোমার বিরক্তি ও কষ্টবোধ হবে। অথবা অগ্নি স্ফূলিঙ্গে তোমার কাপড়ও পুড়ে যেতে পারে।” (বুখারী ও মুসলিম)।

(৫) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় সহচর (সাহাবা)বৃন্দকে সম্বোধন করে বলেছিলেন- আমি তোমাদের এমন উপদেশ দিচ্ছি যা দ্বীন শিক্ষার পথে একান্ত সহায়ক এবং যদ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতে তোমরা উপকৃত হতে পার। আর তা এই যে, তোমরা আহলে ইলম বা সত্যিকার জ্ঞানীদের সংসর্গ গ্রহণ কর। দ্বিতীয়তঃ একাকী থাকলে আল্লাহ স্মরণ থেকে উদাসীন থেকনা এবং তৃতীয় কথা হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে (মু’মিনদের সাথে) মুহাব্বত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে (কাফির-মুশরিকদের সাথে) শত্রুতা পোষণ কর।” (বাইহাক্বী)।

(৬) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “প্রকৃত আলেম, ও সঠিক ঈমানদারদের ব্যতীত অন্য কারো সংসর্গ গ্রহণ করো না।” (জামে’ তিরমিযী, আবুদাঊদ ও দারমী)।

(৭) পক্ষান্তরে আল্লাহর নবী এও বলেছেন যে, তোমরা (কথায়, কাজে ও আমল-আক্বায়েদে) আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব স্থাপনকারী মুশরিকীনদের সংসর্গে যেয়ো না এবং তাদের সংশ্রবে থেক না, এমনকি তাদের মিল-মজলিশে যেয়ে বসনা। কেননা, যে তাদের সংসর্গ গ্রহণ করলো (মনে করে নিও) সে তাদেরই একজন। (জামে’ তিরমিযী)।

(৮) মশহূর সাহাবী ও ইমামুল ফুক্বাহা হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে মাসঊদ (রাযি.) বলেছেন- “যারা নিজেদেরকে সর্বদা জ্ঞানপূর্ণ সততার সাথে চলতে আগ্রহী মনে করে, তারা যেন যারা এজগৎ ছেড়ে গেছেন এরূপ জ্ঞানীদের কথা স্মরণ করে এবং তাঁদের আদর্শ চরিত্র ও নেক আমলের অনুসরণ করে। কেননা, এসব ব্যাপারে জীবিতদের পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে, কিন্তু চরিত্রবান ও আমলদার মৃত ব্যক্তিদের তা অসম্ভব। বিশেষতঃ সত্যের মানদণ্ড হিসেবে বিনা দ্বিধায় যাঁদের অনুসরণ আজীবনের মহাদর্শ ও গ্রহণযোগ্য, তাঁরা হচ্ছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.)। আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের পরও যাদের আমল আখলাক এবং স্বভাব-চরিত্র খাঁটি ও নির্ভেজাল, এমন ব্যক্তির সংসর্গ ও সাহচর্য গ্রহণ কর।” (জামঊল ফাওয়ায়েদ সৌজন্যে হায়াতুল মুসলিমীন)।

এর কারণ এই যে, অপরাধী যেমন ক্ষমা প্রাপ্তির আশা নিয়ে যায় উদার ও মহৎ ব্যক্তির নিকট এবং ক্ষুধার্ত-অসহায় ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিগণ যায় বিত্তশালী ধনীদের নিকট এবং সাহায্য-সহায়তা লাভ করে। তেমনিভাবেই সর্বসাধারণ মানুষের জন্যও প্রকৃত জ্ঞানীদের সংসর্গ লাভে তাদের থেকে জ্ঞান ও উপদেশ লাভে নিজেদেরকে ধন্য হবার সুযোগ মিলে। ফলে মানুষ সৎসংগ লাভে সৎ ও জ্ঞানীতে পরিণত হয়। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়-

সৎ-সংসর্গ লাভে সৎ হয় লোক,
অসতের সংগীদের আজীবন দুখ।
সৎ আর সাধুতার মহৎ গুণেতে,
মানুষ ফেরেশ্তা হতে শ্রেষ্ঠ এ জগতে।

সচ্চরিত্র ও সৎ-স্বভাব মানুষের অমূল্য সম্পদ এবং উন্নত আদর্শের চাবিকাঠি। তাই এর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেবল সৎ-স্বভাবকে দাঁড়ির এক পাল্লায় স্থাপন করে মানুষের গুণগত অন্যান্য সমূদয় বস্তু অপর এক পাল্লায় স্থাপন করলে সৎ-স্বভাবই অধিক ভারী হবে। এক ব্যক্তির প্রশ্ন ছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! ধর্ম কি বস্তু? এর জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,  সৎ-স্বভাব। অপর এক ব্যক্তির প্রশ্ন ছিল, কোন্ বস্তু সর্বোত্তম? এর জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,  সৎ-স্বভাব। অনুরূপ আর এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,  সৎকর্ম করবে। এবং প্রফুল্লতা ও সৎ-স্বভাবের সাথে মানুষের সাথে মেলামেশা করবে।

একদা কতিপয় লোক সম্যক অবগতি লাভ ও জানার উদ্দেশ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যা দান করেছেন তন্মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট কি? এর জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বল্লেন সৎ-স্বভাব। কেননা, বরফ যেমন সূর্যের উত্তাপে গলে যায়, ঠিক তেমনিভাবে সৎ-স্বভাবও মানুষের দোষত্রুটি এবং পাপসমূহ নষ্ট করে ফেলে। জেনে রাখো! মানুষের পুণ্যকর্ম (নেক আমল) এবং ঈমানদারীর সাথে সৎ-স্বভাব তাকে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত করে দেয়। আর এ দুনিয়াতে সৎ-স্বভাবের দ্বারাই মানুষ সা-য়িমুদ্দাহার ও ক্বা-য়িমুল্ লাইল (দিবাভাগে রোযা পালন এবং সারা রাত্র ব্যাপী আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী) এর মর্যাদা লাভ করতে পারে।

আর এক সময় কতিপয় লোক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে আরয করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অমুক স্ত্রীলোক নামায-রোযাতে খুবই পাবন্দ, কিন্তু তার স্বভাব-মেযাজ এত খারাপ যে, সে নিতান্ত অশ্লীল ও কর্কশ বাক্যে প্রতিবেশীদেরকে অহরহ কষ্ট দিচ্ছে। এতদশ্রবণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,  এই মহিলার স্থান দোযখ। পরন্তু আল্লাহর রাসূল এ ব্যাপারে আরও বলেছেন, জেনে রাখো! সিরকা যেমন মধুকে বিনষ্ট করে, কু-স্বভাব এবং বদ-মিযাজও মানুষের ইবাদত-বন্দেগীকে বিনষ্ট করে ফেলে। (কিমিয়ায়ে সাআদাত)।

সচ্চরিত্র ও সৎ-স্বভাব গঠনে আল্লাহ ওয়ালাদের ভূমিকা

(১) হযরত ফুযাইল ইবনে আয়ায বলেছেন- কু-স্বভাবী ও বদ-মিযাজী থেকে আমি স্বভয়ে দূরে থাকি, যদিও সে জনসমাজে আলেম নামে পরিচিত হয়।

(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে মুবারক (রাযি.)-এর সাথে এক কু-স্বভাব ব্যক্তি সফর সংগী হবার পরও তার কু-স্বভাব পরিবর্তন ছাড়াই সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতদ দর্শনে হযরত ইব্নে মুবারক আক্ষেপ করতঃ ঐ ব্যক্তির জন্য রোদন করতে থাকেন।

(৩) হযরত শায়েখ কাত্তানী (রাহ্.) বলেছেন- সৎ-স্বভাবের অধিকারী ব্যক্তি সূফী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং আহলে ইলম বলে গণ্য।

(৪) হযরত ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুআয (রাহ্.) বলেছেন- মানুষের মধ্যকার কু-স্বভাব এতবড় গুনাহ (পাপ) যে, এর শোধরানোর জন্য কোন ইবাদত-বন্দেগীই সুফল দান করতে পারে না, আর এর বিপরিত সৎ-স্বভাব এতবড় সম্পদপূর্ণ ইবাদত যে, কোন গুনাহ্ই এর ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না।

সৎ-স্বভাব ও সচ্চরিত্র অর্জন সম্পর্কে জ্ঞানীগণ বলেছেন, মানব হৃদয়ের সমূদয় ইচ্ছা বা শক্তিসমূহ মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করা যতে পারে। যথা- (১) জ্ঞান ও অনুকরণ শক্তি (২) ক্রোধ বা শাসন ক্ষমতা (৩) কামশক্তি ও লোভ-লালসা (৪) এই তিনটি শক্তিকে মধ্য পন্থায় অর্থাৎ সমীচিন ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখার বিচার শক্তি ধৈর্য ও সংযমে।

সর্বপ্রথমে এস্থলে জ্ঞানকে এজন্য প্রাধান্য দেয়া হলো যে মানব জীবনে এ শক্তি পূর্ণভাবে বিকাশ প্রাপ্ত ও স্ফূটিত হলে লোকের কথোপকথনের মধ্যে কোন্টি সত্য, কোনটি মিথ্যা উপলব্ধি করা যায়। তদ্রূপ কাজ-কর্মের মধ্যে কোন্টি ভাল, কোন্টি মন্দ তারতম্য করা যায়। অনুরূপ ধর্ম-বিশ্বাসের মধ্যে কোন্টি সত্য ও সঠিক এবং কোন্টি অসত্য ও অঠিক বা মেকী তা নিরূপণ করা যায়। বস্তুতঃ এই জ্ঞানশক্তি উত্তম ও উপযুক্ত রূপে হলেই মানব হৃদয় জ্ঞানের উৎসতে পরিণত হয় এবং তখনই ইহা মানুষের পক্ষে পরম সৌভাগ্যের বিষয় বলে পরিগণিত হয়। এরই সমর্থনে মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক যাকে হিকমাত বা সঠিক ধর্ম জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে, তাকেই প্রচুর কল্যাণ দান করা হলো।

আর জ্ঞান উন্মেষ শক্তির সাথে সাথে মানুষের মধ্যে বাস্তবে অনুকরণ-অনুসরণ শক্তি বলেই সে সত্য বলে যা দেখে ও শুনে, সহজেই তা উপলব্ধি ও গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। একারণে মেধাবী ছাত্ররা জ্ঞানী ও আদর্শ শিক্ষক-এর সংসর্গে থেকে সৎ-সততা এবং চরিত্র নিষ্ঠার যে শিক্ষা পায় একান্ত আগ্রহ চিত্তে তা গ্রহণ করতঃ সৎ ও আদর্শ জীবন গঠনে ব্রতী হয়ে দেশ ও সমাজের কল্যাণ সাধনে তৎপর হয়।

মানুষের শরীরে উত্তাপ শক্তির বহিঃপ্রকাশের প্রতিফলনে তার মধ্যে রাগ-গোস্বা এবং ক্রোধ বলে শক্তি-সামর্থ এবং ধন-জনের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে অন্যের উপর দাপট ও শাসন চালাতে তৎপর হয়। আর প্রায় এধরনের মানুষেরাই কামশক্তি এবং লোভ-লালসার শিকার হয়ে মানব জীবনকে কলংকিত করে।

এস্থলে মানুষের ক্রোধ বা শাসন ক্ষমতা যতক্ষণ ধর্মজ্ঞান বলে শরীয়তের আজ্ঞাবহ থাকে এবং আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আইন ও নীতির বাধ্য থাকে, তখনই একে উত্তম বলা যায়। তদ্রূপ কাম শক্তি বা লোভ-লালসাকেও যখন ধর্মজ্ঞান এবং শরীয়তের নির্দেশ মুতাবেক দাবিয়ে আয়ত্বে আনা যায়, তখন এতেও মানুষের সৎ-স্বভাব ও সচ্চরিত্র গঠনে কোন রকম বাঁধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার সংশয় থাকে না। ফলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, একমাত্র জ্ঞান শক্তির বলেই সত্যতা ও ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উঁচুকে-নীচু, নীচুকে-উঁচু এবং গর্বকে খর্ব করতঃ তাওহীদের সাম্যের প্রতিফলনের দ্বারা সকল ভেদ-বৈষম্য চুরমার করতঃ বরাবর ও সামঞ্জস্যপর্ণ করে দেয়। বস্তুতঃ এর মূলে যখন ধর্ম ও প্রকৃত জ্ঞান-বুদ্ধি কার্যকর থাকে তখনই সৎ ও সত্যতার নিরিখে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে।

সৎ-স্বভাব অর্জনের উপায়

(১) জন্মগতভাবে প্রাপ্ত আল্লাহ প্রদত্ত স্বাভাবিক উপায়। এক্ষেত্রে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আপন দয়া ও মেহেরবানীর বদৌলতে মানব সৃষ্টির সময়ই সৎ-স্বভাবের মূল উপাদানগুলো তার অন্তরে স্থাপন করে দিয়েছেন।

(২) যত্ন ও পরিশ্রম সাধ্য উপায়। কু-প্রবৃত্তির সাথে লড়াই করে ও সত্যের অনুকরণে একান্ত আগ্রহী হয়ে যত্ন ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে সর্বদা সৎ-কর্মে নিয়োজিত রাখলে ক্রমশঃ সৎ-কর্মের অভ্যাস মানব হৃদয়ে অকপটে স্থান লাভ করবে।

(৩) সৎ-সংসর্গ। সৎ-স্বভাব সম্পন্ন জ্ঞানী ও আদর্শ চরিত্রবান ব্যক্তির সংসর্গ লাভ সৎ ও চরিত্রবান রূপে গড়ে উঠার প্রথম সোপান। কেননা, সৎ-স্বভাবের অধিকারী জ্ঞানী ব্যক্তির সংসর্গে থাকলে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এবং অজ্ঞাতসারেও তাঁদের বাস্তব জ্ঞান প্রসূত সদগুণ সংসর্গীদের অন্তরে অবশ্যই স্থান লাভ করবে।

সৎ-সংসর্গের উপকারিতা

মানব সমাজে নিষ্কলুষ চরিত্র সম্পন্ন আদর্শবান গুণী-জ্ঞানী জনই সৎ বলে আখ্যায়িত ও বরিত হন। এরূপ সৎ-জ্ঞানী-গুণী জনের সংসর্গ লাভে মানুষ বহু অজানাকে জানতে পারে, নিজের মন্দ স্বভাব পরিহার করে সৎ-স্বভাব ও সৎ-জ্ঞান জানার ও গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে এবং ক্রমান্বয়ে নিজেও সৎ হতে সক্ষম হয়। আর এরই সাথে সাথে নিজের মধ্যে যেসব কু-প্রবৃত্তি ও দোষত্রুটি ছিল এর অসারতা ও কুফল সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতঃ এর তদারক ও সংশোধনে ব্রতী হয়। ফলে সে (সৎ-সংসর্গ গ্রহণকারী ব্যক্তি)ও একজন সৎ এবং আদর্শ জ্ঞানী-গুণী বলে পরিচিত ও পরিগণিত হয়।

এর জাজ্জ্বল্য দৃষ্টান্ত যেমন, কোন মূর্খ লোক একজন শিক্ষিতের সংসর্গ লাভেই শিক্ষিত হয়, একজন সাধারণ শিক্ষিত লোক প্রকৌশলীর সংসর্গ ব্যতীত প্রকৌশলী হতে পারেনা, একজন বিএসসি ডিগ্রী প্রাপ্ত লোক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সংসর্গ ছাড়া ডাক্তার-কবিরাজ ও হাকীম হতে পারেনা। তদ্রূপই ইসলামী জ্ঞান শাস্ত্রের একজন আরবী শিক্ষার্থী যেমন কোন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস-মুফাচ্ছির ও ফক্বীহ বা মুফ্তীর সংসর্গ বিনে হাদীস, তাফ্সীর এবং ইলমে ফিক্বাহ এর জ্ঞানী হতে পারেনা, তেমনি ভাবেই একজন অপরাপর শিক্ষিত লোকও কোন সৎ ও উপযুক্ত আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন মনীষীর সংসর্গ ব্যতীত অনুরূপ সৎ ও সত্য পীর বা শায়েখ হবার দাবী করতে পারে না।

অতএব, মু’মিন মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য এই যে, জাগতিক বৈষয়িক জ্ঞানে হোক, ইলমে দ্বীনের জ্ঞানে হোক, আর আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় হোক, প্রকৃত সত্য ও সততার মানদণ্ডে পরখ ও যাচাই করতঃ সৎ ও খোদাভীরুদের সংসর্গ গ্রহণ করা একান্ত অপরিহার্য।

লেখকঃ ফাযেলে দারুল উলূম দেওবন্দ (দাওরা ও ইফতা), মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, উপদেষ্টা সম্পাদক- উম্মাহ ২৪ ডট কম এবং কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব- জামিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

‘আদর্শ পরিবার ও সমাজ গঠনে পিতা-মাতার ভূমিকা’ – মুফতী মুনির হোসাইন কাসেমী