Home সম্পাদকীয় সামাজিক অশান্তি এবং নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় বাড়ছেই

সামাজিক অশান্তি এবং নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় বাড়ছেই

।। আবুল কাসেম হায়দার ।।

আজ সমাজে কী চলেছে? প্রতিদিন শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে। শিক্ষক, পেশাজীবী সকল শ্রেণির মানুষ প্রায় সময় দেখা যাচ্ছে ধর্ষণে জড়িত। ইদানীং মাদরাসার অধ্যক্ষ, শিক্ষককেও দেখা যাচ্ছে ধর্ষণে জড়িত হতে। কলেজ, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণকেও যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো খারাপ কাজে নিয়োজিত হতে দেখা যাচ্ছে। ধর্ষণের এই চিত্র আজকাল বেশি বেশি প্রকাশ পাচ্ছে।

অনেকে বলেন, ধর্ষণ পূর্বেও ছিল। তখন নারী সমাজ প্রতিবাদ করতো না, তাই প্রকাশও পেতো না। এখন নারী সমাজ শিক্ষিত, প্রতিবাদ করতে শিখেছে। তাদের সাহস হয়েছে। তাই ঘটনা খবর হয়ে প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে। অনেকে বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি রয়েছে। তা ঐ সকল দেশে তেমন প্রকাশ পায় না। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকাশ বেশি। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতেও যৌন হয়রানি, ধর্ষণের ঘটনা বেশ ঘটছে। প্রকাশও পাচ্ছে। নারী জাতিকে স্রষ্টা অনেক বেশি সম্মান, মান-মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমরা কি সেই সম্মান রক্ষা করে চলতে পারছি? পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে নারীকে সম্মান অধিকার দিয়ে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ উন্নত দেশসমূহে এখন নই। শুধু অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে নারী এখনও অবহেলিত।

এক সময় আমাদের দেশে নারীদের এসিড মেরে আহত করার বেশ প্রচলন হয়েছিল। প্রতিদিন যুবকগণ কিছু কিছু নারীকে যৌন হয়রানি করত। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে তখন এসিড মেরে উক্ত নারীকে আহত করতো। এখন বেশ কম দেখা যায় এসিড নিক্ষেপ। কেন এসিড নিক্ষেপ কমল? কী কারণ রয়েছে এর পিছনে? সমাজ বিজ্ঞানীগণ এখনও এই বিষয়ে গবেষণা প্রকাশ করেন নাই। নিশ্চয় এসিড নিক্ষেপ কমে যাওয়ার পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এখনও আমাদের সমাজে অনিয়ম, অন্যায়, আইন অমান্য, ঘুষ, দুর্নীতি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিন অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্যের নানা খবর আসছে। বর্তমান সরকারও এই সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। দুর্নীতি দমন কমিশনও এই সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সক্রিয়। বেশ কিছু মামলা হয়েছে। অনেক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। নতুন নতুন অনুসন্ধান চলেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। পত্র পত্রিকায়ও প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারও বেশ কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে বলে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি তেমন হচ্ছে না। কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হলো।

পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, বাংলাদেশি বিপুল সংখ্যক ধনী ব্যক্তি সুইস ব্যাংকে প্রচুর অর্থ জমা রেখেছেন। সুইস ব্যাংকে অর্থ কীভাবে জমা হয়েছে তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। শুধু যে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে তা নাও হতে পারে। এই অর্থ বিদেশে উপার্জিত অর্থ থেকে জমাও হতে পারে।

এসব ঘটনার কারণ এবং এর থেকে উত্তোরণ: আমরা এগিয়ে চলেছি। আমাদের চরম উন্নতি হচ্ছে বলে আমাদের রাষ্ট্রীয় ঘোষণা রয়েছে। রাষ্ট্র এগিয়ে চলেছে। কিন্তু জনগণ তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে যেন বার বার হোচট খাচ্ছে। এরই পাশাপাশি দেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন কারণে বাড়ছে অস্থিরতা, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা, বাড়ছে হতাহতের ঘটনা।

খবরের কাগজ উল্টালেই চোখে পড়ছে ধর্ষণ, আত্মহত্যা, খুন, শিশুনির্যাতন, সন্ত্রাস, মাদক, মারামারি আর হানাহানির খবর। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে ক্রমান্বয়ে সরে পড়া, ভোগবাদি আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার বিকাশ এবং সর্বস্তরে নীতি-নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া, আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের অনুপস্থিতি এবং উন্মুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা।

বাড়ছে পারিবারিক কলহ: পরিবার আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম মূলভিত্তি। এ সময়টায় বিভিন্ন কারণে পারিবারিক কলহের ঘটনা বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে পরিবারের এক সদস্যের হাতে আরেক সদস্যের খুন হওয়ার ঘটনা। স্বামী-স্ত্রীর কলহের জেরে প্রাণ দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের। পারিবারিক কলহের কারণে পরিবারের সবাই একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। মানুষ এখন শুধু ঘরের বাইরেই নয়, তার আপনজনদের কাছেও নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ বিভাগের তথ্যানুযায়ী বছরে মোট হত্যাকান্ডের প্রায় ৪০ শতাংশ সংঘটিত হচ্ছে পারিবারিক কলহের কারণে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অভাব-অনটন, অর্থের প্রতি প্রবল দুর্বলতা, চাওয়া পাওয়ার অসঙ্গতির কারণে দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, অন্য দেশের সংস্কৃতির আগ্রাসন, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা, বিষন্নতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে সামাজিক অশান্তি বাড়ছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। আর এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে। মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল জানান, সমাজে কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেন না। মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। বেশিরভাগ সময়ে সে পরিবেশ তার কাছের মানুষরাই তৈরি করে দেয়। কখনও কখনও সমাজে মানুষদের আচরণ, অসহযোগিতার কারণে পরিবারে, সমাজে দ্ব›দ্ব সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণা বা মনোকষ্টে ভোগলে এসব হতে পারে। এজন্য কাউন্সিলিং দরকার। পাশাপাশি প্রত্যেককে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।

একাকিত্ব থেকে অশান্তি: একাকিত্ব মানসিক বিষন্নতা সৃষ্টির অনেক বড় একটা কারণ। অনেক সংসারেই স্বামীরা বুঝতে পারেন না তার কাজের ব্যস্ততার কারণে স্ত্রীকে একদম সময় দেয়া হচ্ছে না। এজন্য অফিসে গেলে মাঝে মাঝে স্ত্রীকে ফোন দিতে হবে। মাঝে মাঝে কি করছে না করছে সেটির খোঁজ নিতে হবে। অফিস থেকে আসতে দেরি হলে বাসায় জানাতে হবে। নিজের ব্যস্ততার বিষয়টি স্ত্রীকে বোঝাতে হবে। আবার স্ত্রীকেও স্বামীর ব্যস্ততা বুঝতে হবে। ব্যস্ততার মাঝেও সপ্তাহে অন্তত একটা দিন স্ত্রীকে নিয়ে বিনোদনের জন্য পার্ক বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। কোনো কারণে স্ত্রী যদি বুঝতে পারে তার স্বামী তাকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন না। তাহলে তাদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টিই হবে। একাকিত্বের ফাঁদে পড়ে মেয়েরা অনৈতিক কোনো সম্পর্ক বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

দাম্পত্য জীবনে অতৃপ্তি: বিয়ে বা সাংসারিক জীবনে কোনোভাবেই যৌনতাকে বাদ দেয়া যাবে না। বরং যৌনতাকে ঘিরেই দাম্পত্য জীবনে গতি আসে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো সংসারে অভাব-অনটন থাকলে যতটা অশান্তি হবে তার চেয়ে ভয়াবহ অশান্তি হবে যদি কোনো দম্পতির যৌন জীবন সুখের না হয়। পরকীয়া বা বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে আদিম কারণ শারীরিক চাহিদা অপূর্ণ থাকা। মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি, হতাশা বা দূরত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ হল শারীরিক চাহিদা অপূর্ণ থাকা।

প্রেমের নামে ছলনা: সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসা ছিল। লাইলি-মজনু বা শিরি-ফরহাদের গল্পের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে এসব ভালোবাসাবাসির সংজ্ঞা বদলে গেছে। বহুপ্রেমে জড়াচ্ছেন অনেকেই। তরুণ-তরুণীদের একটা বড় অংশ একাধিক প্রেমে আসক্ত। আর বর্তমানে প্রেম মানেই অবাধে যৌন মেলামেশা। এই অবাধ যৌনাচার পরবর্তী সংসার জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কোনো কারণে স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হলে কিংবা শারীরিকভাবে সন্তুষ্ট হতে না পারলে পুরনো সঙ্গীদের শরণাপন্ন হন। অনেকে আবার অভ্যাগতভাবেই এসব অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ হন। কিন্তু এই বহুগামিতার ফলাফল আসলে ভালো নয়।

নগরগুলোতে লিভ টুগেদার বাড়ছে: বর্তমানে একটি পরিচিত শব্দ লিভ টুগেদার। দু’জন অবিবাহিত নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী না হয়েও একসঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে থাকাটাই লিভ টুগেদার। এ ধরনের সংস্কৃতি মূলত বাইরের দেশেই প্রচলিত। সা¤প্রতিক সময়ে রাজধানীতেও এই ধরনের অনৈতিক সম্পর্কে জড়াচ্ছেন অনেকেই। বিশেষ করে, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও আগ্রহী হয়ে উঠছে এ ধরনের সম্পর্কে। এতে করে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাচেলরদের বাড়িভাড়া না পাওয়া, অর্থ সংকট এবং জৈবিক চাহিদার কারণে এ ধরনের অনৈতিক কাজে উৎসাহী হচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা। ঢাকায় সা¤প্রতিক সময়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের লিভ টুগেদার। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের অন্ধ আবেগ ও অনুকরণের পাশাপাশি জৈবিক চাহিদার কারণে তারা লিভ টুগেদার করছেন। আবার ঘন ঘন বিচ্ছেদও ঘটছে। সহসা আলাদা হয়ে যাচ্ছেন তারা। ঘটছে খুনের মতো অপরাধ। আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ।

ধর্মের মৌলিক শিক্ষা থেকে দূরে: আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ধর্মের মূল শিক্ষা আমরা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। সকল ধর্মের মূল শিক্ষা মূল্যবোধ, নৈতিকতা, মানবতা ও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। কিন্তু এই সকল আমাদের মধ্যে চর্চা কমে গিয়েছে। তাই আজ প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত চর্চা। যা বলি, যা শুনি, তা নিজের জীবনে অনুসরণ করতে হবে। সত্যকে সত্য বলতে হবে। ভালোকে ভালো বলতে হবে। না-কে না বলতে হবে। প্রত্যেক ধর্মের সঠিক শিক্ষা চর্চা ও ধারণ করলে মানুষের মুক্তি আসবে। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল ধর্মই মানুষকে মানুষ হতে বলে। সকল ধর্ম সৎ হতে বলে। সকল ধর্মই সত্য কথা বলতে বলে। সকল ধর্মের মূল শিক্ষা- অন্যায়, অবিচার দুর্নীতি ও সকল অনিয়ম থেকে নিজকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। আজ এইটির বড় প্রয়োজন।

লেখক: সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট