Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ পরকালীন জীবনে সুদখোরের ভয়াবহ পরিণতি

পরকালীন জীবনে সুদখোরের ভয়াবহ পরিণতি

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

সুপ্রিয় পাঠক, সুদ বিষয়ে এর আগের লেখায় সুদের পার্থিব জীবনের ক্ষতি বা কুফলের কিঞ্চিৎ চিত্র তুলে ধরা হলো। বক্ষমান নিবন্ধে পরকালীন জীবনে সুদখোরের পরিণাম কি হবে, তার সংক্ষিপ্ত আলাচনা করার প্রায়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।

আলোচনার মাঝে হলেও সুদ কি তা জানা প্রয়োজন। সুদ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- “যে ঋণ কোন মুনাফা টানে, তাই রিবা”। অর্থাৎ কাউকে ঋণ দিয়ে তার মাধ্যমে মুনাফা গ্রহণ করাই সুদ বা রিবা। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন)।

সুদ সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে- “অভিধানে রিবা শব্দের অর্থ অতিরিক্ত। আয়াতে রিবা বলতে প্রত্যেক এমন অতিরিক্ত পরিমানকে বোঝান হয়েছে, যার বিপরীতে কোন বিনিময় নেই।

আরো বলা হয়েছে, রিবা দু’ রকম হয়ে থাকে; ক্রয় বিক্রয়ের রিবা ও ঋণের রিবা। জাহেলিয়াত যুগের আরবে দ্বিতীয় প্রকার রিবাই প্রচলিত ও সুবিদিত ছিল। তারা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কাউকে অর্থ প্রদান করত এবং প্রতি মাসে তার মুনাফা আদায় করত। নির্দিষ্ট মেয়াদে আদায় না হলে সুদের পরিমান বাড়িয়ে দেওয়ার শর্তে মেয়াদও বাড়িয়ে দিত। জাহেলিয়াত যুগের সেই রিবাই কুরআন মজিদে হারাম করা হয়েছে।

আরো বলা হয়েছে- এ  এমন ঋণ, যা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে, এ শর্তে দেওয়া হয় যে, খাতক তাকে মূল ধন থেকে কিছু বেশী পরিমান অর্থ দেবে। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন)।

উপরোক্ত বক্তব্য থেকে বুঝা গেল, যে কাউকে ঋণ দেওয়ার পর নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে যে অতিরিক্ত মুনাফা গ্রহণ করা হয়, তাই সুদ।

আল্লাহ্ তাআলা এই সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। সুদ হারাম ঘোষণার পাশাপাশি সুদখোরের পরিণাম কি হবে, তাও বলে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ক্রয়-বিক্রয় হলো বৈধ আর সুদ হারাম। (সুরা বাক্বারা)। অতএব, সুদ যে হারাম, তা স্পষ্টই প্রমাণিত হল।

আল্লাহ্ তাআলা সুদকে হারাম করেই ক্ষাš হননি, তিনি সুদ গ্রহণ করতেও নিষেধ করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না, আর আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার। (আলে ইমরান)।

আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, “যারা সুদ খায়, তারা ক্বিয়ামতে দণ্ডায়মান হবে, যেভাবে দণ্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে ক্রয়-বিক্রয়ও তো সুদ নেওয়ারই মত। অথচ আল্লাহ্ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে তার ব্যাপারে সে আল্লহ্র উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুণরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে। আল্লাহ্ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ্ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে। (সুরা বাক্বারা)।

আল্লাহ্ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, ইহুদীদের এসব বড় অপরাধের কারণে আমি অনেক পবিত্র বস্তু যা তাদের জন্য হালাল ছিল তাদের উপর হারাম করে দিয়েছি এবং তা এ কারণে যে, তারা অনেক মানুষের সু-পথপ্রাপ্তির পথে অšরায় হয়ে যেতো এবং তা এ কারণে যে, তারা সুদ গ্রহণ করত। অথচ তাদেরকে সুদ গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, তারা মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতো। আমি তাদের মধ্যে যারা কাফির তাদের জন্যে যšণাদায়ক শাস্তি তৈরী করে রেখেছি। (সূরা নিসা)।

আল্লাহ্ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয়কর এবং সুদের যে সম¯ বকেয়া আছে তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। (সূরা বাক্বারা)।

আল্লাহ্ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, ঐ দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না। (সূরা বাক্বারা)।

সুদখোরের পরিণাম সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হলো, সাতটি মারাÍক বিষয় থেকে বেঁচে থাক। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা.)! সেগুলো কি? তিনি বললেন- ১. আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করা। ২. যাদু করা। ৩. কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা। ৪. সুদ খাওয়া। ৫. এতীমের মাল খাওয়া। ৬. জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা। এবং ৭. কোন সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা। (বুখারী শরীফ)।

তিনি আরো ইরশাদ করেন, চার ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা সিদ্ধাš নিয়েছেন যে, তাদেরকে বেহেশ্তে প্রবেশ করাবেন না এবং জান্নাতের নেয়ামতের স্বাদ গ্রহণ করতে দেবেন না। এ চার ব্যক্তি হল, ১. মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি। ২. সুদ খোর। ৩. অন্যায়ভাবে এতীমের মাল ভক্ষণকারী এবং ৪. পিতা-মাতার অবাধ্যতাকারী।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এক দিরহাম সুদ খাওয়া সত্তর বার ব্যভিচার করার চাইতে বড় গুনাহ্। কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে, হারাম মাল দ্বারা যে মাংস গঠিত হয়, তার জন্যে আগুনই যোগ্য। তিনি আরো ইরশাদ করেন, মিরাজের রাত্রে যখন আমরা সপ্তম আকাশে পৌঁছলাম, তখন আমি উপরে বজ্র ও বিদ্যুৎ দেখলাম। এরপর আমরা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে দিয়ে গেলাম, যাদের পেট একেকটি ঘরের ন্যয় ফোলা ও বিস্তৃত ছিল। তাদের উদর সাপ দ্বারা ভর্তি ছিল। সর্পগুলো বাইরে থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। আমি জিবরাঈল (আ.)কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সুদখোর।

তিনি আরো বলেন, মিরাজের রাতে একটি রক্তের নদী দেখলাম, নদীর মধ্যে এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান, অপর এক ব্যক্তি নদীর কিনারে দণ্ডায়মান।  নদীস্থিত ব্যক্তি যখন নদী থেকে উপরে উঠতে চায় তখন কিনারের ব্যক্তি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরের আঘাত খেয়ে সে আবার পূর্বের জায়গায় চলে যায়। অতঃপর সে আবার তীরে উঠার চেষ্টা করে। কিনারের ব্যক্তি আবার তার সাথে একই ব্যবহার করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি স্বীয় সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি একি ব্যাপার দেখছি? তিনি বললেন, রক্তের নদীতে বন্দী ব্যক্তি সুদখোর। সে স্বীয় কার্যের শাস্তি ভোগ করছে। (বুখারী শরীফ)।

সুদ সম্পর্কে উল্লিখিত কুরআনের বাণী এবং মহানবী (সা.)এর হাদীস থেকে জানা যায় যে, সুদ হারাম; এতে কোন সন্দেহ নেই এবং সুদের কুফল ইহজগতে ও পরজগতে অত্যন্ত মারাত্মক ও ভয়াবহ। সুদখোর অনেক সম্পদের মালিক ও আরাম-আয়েশ, ভোগ বিলাসের সাজ-সরঞ্জামের অধিকারী হলেও প্রকৃত শান্তিময় জীবন তার ভাগ্যে জোটে না। তাছাড়া সমাজে সে সুদখোর হিসেবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। পরকালীন জীবনে কাঠোর শস্তি তো আছেই। সুদের ঋণ গ্রহীতা সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও পরিণামে সে সব হারিয়ে আরো দরিদ্র ও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। পরজীবনে তাকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে।

আমাদের সমাজে অনেক লোক আছে, যারা সুদের কুফলটা জানা সত্ত্বেও সুদ খায়। অনেকে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রোযা রাখে, অন্যান্য ইবাদত বন্দেগীও করে। অথচ সুদী কাজ কারবার করে। তারা যে কত বড় গোনাহের কাজ করছে, তা একবারো ভেবে দেখে না। অনেকে বলে, সুদী কাজ কারবারের বিকল্প কোন পথ নেই; এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এটা তাদের মনগড়া অজুহাত। মনগড়া খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে হারাম খাওয়ার সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলাম মানব জাতির কল্যাণের ধর্ম। ইসলাম লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে লেনদেনের বিধান দিয়েছে। ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে, দিয়েছে ইসলামী অর্থনীতি ও দান-খয়রাতের উত্তম ব্যবস্থা। আল্লাহ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। (সূরা বাক্বারা)।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সুদের কুফল থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন। আমীন॥

লেখকঃ মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডটকম এবং কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
ই-মেইল- muftijakir9822@gmail.com

আরও পড়ুন- ‘সুদের কুফল ও ক্ষতিকর প্রভাব’