Home জাতীয় আরজাবাদ মাদ্রাসার অভিভাবক সম্মেলনে আল্লামা আরশাদ মাদানী যা বলেছেন…

আরজাবাদ মাদ্রাসার অভিভাবক সম্মেলনে আল্লামা আরশাদ মাদানী যা বলেছেন…

উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলনের বীর মুজাহিদ, শাইখুল আরব ওয়াল আযম, শাইখুল ইসলাম আওলাদে রাসূল হযরতুল আল্লামা সাইয়িদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)এর সুযোগ্য সাহেবজাদা, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রবীণ মুহাদ্দিস, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি আল্লামা সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানী ৫ দিনের বাংলাদেশ সফরের তৃতীয় দিন গতকাল (৯ নভেম্বর) শনিবার দুপুরে জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদ্রাসার ছাত্র অভিভাবক ও শুভাকাঙ্ক্ষী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়েছেন।

জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়ার সভাপতিত্বে মাদ্রাসা মিলনায়তনে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে গুরুত্বপূর্ণ উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার শাইখুল হাদীস প্রবীণ আলেমে-দ্বীন আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক।

আরো বক্তব্য রাখেন, জামিয়া আরজাবাদের শাইখুল হাদিস ও প্রধান মুফতি আল্লামা তাজুল ইসলাম, শিক্ষা সচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, সিনিয়র উস্তাদ মাওলানা কামাল উদ্দিন, মাওলানা এমদাদুল হক, মাওলানা শুয়াইব এবং বায়তুল সালাম মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আহমাদুল হক প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন মাওলানা সাইফুদ্দীন ইউসুফ ফাহিম।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে সঠিক তরবিয়ত অর্জন করা জরুরি। আর সেটা একমাত্র কওমি মাদরাসায় শিক্ষা দেওয়া হয়।সঠিক তরবিয়ত না থাকলে জ্ঞান অর্জনের দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়না বরং ক্ষতির শিকার হয়। যার কারনে আজ আমাদের সমাজে চরম অশান্তির বিরাজ করছে। আর এর একমাত্র কারন হচ্ছে সঠিক তরবিয়ত না থাকা।

তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও ইসলামী শিক্ষার বিরোধীতা কেউ করে না। ইসলামী শিক্ষার যে বিরোধীতা করে না তার প্রমাণ দেখুন- আলীগড়, বানারশ, দিল্লী’সহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী সাবজেক্ট আছে। বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটিসমূহে ইসলামী সাবজেক্ট আছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইসলামী সাবজেক্টে পড়ানো হয়। এতে বুঝা যায়, ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ কেউই বিরোধীতা করে না। অথচ দেখা যায়, এরাই আবার কওমী মাদ্রাসার বিরোধীতা করেন বেশ জোরালোভাবেই।অনেকেই কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করতে নানা ষড়যন্ত্র ও উঠেপড়ে লেগে আছেন। এর কারণ হচ্ছে, কাওমি মাদ্রাসাসমূহে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি তারবিয়ত তথা বাস্তব জীবনে অনুশীলন করানো হয়।

তিনি বলেন, তারবিয়াত তথা অনুশীলনের কারণে কওমি মাদ্রাসা পড়ুয়া আলেমদের মধ্যে আলাদা বিশেষত্ব তৈরি হয়।তাঁদের চলাফেরা, কথাবার্তা, আচরণ, লেনদেন এবং নীতি-আদর্শের জায়গায় এক একজন ইসলামের আদর্শবান মডেল হিসেবে সমাজে উপস্থাপিত হন। তাঁরা যে সৎ, নীতিবান, শান্তিপ্রিয় ও আদর্শবান মুসলমান, তাদেরকে দেখলেই সকলে সহজে বুঝতে ও উপলব্ধিতে নিতে পারেন।ইউরোপ, আমেরিকার যেখানেই তারা থাকুক না কেন, তাঁদেরকে সকলে চিনে ফেলেন যে তারা মুসলমান এবং তাঁরা সৎ, নীতিবান ও শান্তিপ্রিয় মানুষ।

আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, অপরদিকে জেনারেল প্রতিষ্ঠানে ইসলাম পড়ুয়ারা শুধু একাডিম জ্ঞান অর্জন করেন, কিন্তু এর পাশাপাশি তারবিয়াতি শিক্ষা অর্জন করতে পারেন না। যে কারণে তারা অনেক বিখ্যাত ইসলামী স্কলার হতে পারলেও তাদেরকে বাহ্যিকভাবে দেখে সেটা বুঝার উপায় নেই। তারা ইসলামের একাডিম জ্ঞান অর্জন করলেও বাস্তব জীবনে এর প্রশিক্ষণ নিতে পারেন না। যে কারণে তাদের চলাফেরা ও আচরণে ইসলাম পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় না। তারা ইসলামের আদর্শিক মডেল হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না। তাদেরকে দেখলে কেউ বুঝবে না যে, তাঁরা মুসলমান, না অন্য কোন ধর্মাবলম্বী।

তিনি বলেন, ইসলামের বাইরের সকল শক্তি ইসলামী শিক্ষাকে ভয় পায় না, বরং ইসলামের আদর্শকে ভয় পায়। কারণ, ইসলামের এই আদর্শ যদি জগতের সামনে ফুটে ওঠে, তাহলে পুঁজিবাদ, সম্রাজ্যবাদ ও কমিউনিজমের সকল ধোঁকা, প্রতারণা ও মানবাধিকারের বুলি সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠবে এবং ইসলাম অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে গিয়ে বিজয়ী হবে। এতে তাদের লুণ্ঠনের সকল কলাকৌশল ও পলিসি ধুলিস্মাৎ হয়ে ভেসে যাবে।

আল্লামা আরশাদ মাদানী উপস্থিত অভিভাকদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের সন্তানদেরকে এসব কওমি মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তারা যেন ইসলামের একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি পূর্ণ অনুশীলনটাও যেন এখান থেকে অর্জন করে নিয়ে বাস্তব জীবনকে সেভাবে গড়ে নিতে পারে। কিন্তু ছাত্রদের এই অনুশীলন কাজে সফলতার জন্য আপনাদের মধ্যেও ইসলামের অনুশীলন থাকতে হবে।পরিবারের মধ্যে যদি ইসলামের পরিপূর্ণ চর্চা হয় এবং ঘর থেকে মাদ্রাসায় এসেও যদি তারা এই অনুশীলন পায়, তাহলেই তারা ভালভাবে ইসলামের অনুশীলন ধারণ করতে আদর্শবান মুসলমান রূপে গড়ে উঠতে পারবে। কিন্তু পিতা-মাতা, ঘরের অন্যান্য সদস্য ও বাসা-বাড়িতে ইসলামের অনুশীলন যদি না থাকে, তাহলে সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়িয়ে পূর্ণ দ্বীনিদার রূপে গড়ে তোলা কঠিন।

এ পর্যায়ে আল্লামা আরশাদ মাদানী নিজের জীবনের একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, লন্ডনে এক পাকিস্তানীর সাথে আমার পরিচয় ছিল। তিনি তার সন্তানকে সাধারণ স্কুলের ক্লাস শেষে বিকেলে একজন হাফেজ সাহেবের কাছে কুরআন পড়াতে নিয়ে যেতেন। প্রতিদিন হাফেজ সাহেবের কাছে কয়েক ঘণ্টা কুরআন পড়তে পড়তে এক পর্যায়ে তার ছেলে পরিপূর্ণ হাফেজে কুরআন হলেন।কিন্তু এই হাফেজ কুরআন ছেলেটাই আরো বড় হওয়ার পর এক পর্যায়ে দেখা যায়, সে খ্রীস্টান হয়ে গেল।

আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, উক্ত ঘটনা আমাকে বলার পর আমি সেই পাকিস্তানীকে বললাম, তার সেই পুত্রকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু তিনি জানালেন, সে খ্রীস্টান হয়ে যাওয়ার পর যাজকদের মিশনারী স্কুলে পড়াশোনা করছেন এবং কোন মুসলমানের সাথে সাক্ষাত দেয় না, এমনকি পরিবারের আমাদের কারো সাথেই যোগাযোগ করে না। তখন আমি তার কোন বন্ধুকে হলেও আমার কাছে ডেকে পাঠাতে বললাম। তারপর ওই ছেলের এক বন্ধুকে আনা হলে তখন আমি তাকে বললাম, ওই খ্রীস্টান ছেলের সাথে দেখা করে জানতে চাও যে, সে কেন খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করল।

তখন ওই বন্ধু ছেলেটা সেই খ্রীস্টান পুত্রকে ফোন দিয়ে সাক্ষাত চাইল। উত্তরে সে জানাল, আমি ধর্মবিষয়ক কোন কথা হলে সাক্ষাত করতে পারবো না। সেই বন্ধু ধর্মবিষয়ে কথা হবে না বলে আশ্বস্ত করলে দেখা করতে রাজি হয়। দেখা করার পর নানা বিষয়ে কথা বলে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলে কৌশলে সেই বন্ধু ছেলেটি তার কাছে খ্রীস্টান কেন হল, কারণ জানতে চাইল।সে উত্তরে জানাল, আমার পিতা আমাকে স্কুলের পড়া শেষে হুজুরের কাছে নিয়ে গিয়ে ইসলামী শিক্ষা দিতেন এবং এক পর্যায়ে কুরআনে হাফেজও বানালেন। সব সময় আমাকে নামায-কালাম ও ইসলাম মেনে চলতে বলতেন। আমি সেভাবেই চলা শুরু করলাম। কিন্তু বছরের পর বছর যায়, আমার বাবা আমাকে ইসলাম মেনে চলতে বলেন, অথচ তাকে আমি কোন একদিনও নামায পড়তে দেখিনি। তারপর আমি ভাবলাম, যে ধর্মে সন্তানের জন্য ধর্মীয় অনুশাসন আছে, মাতা-পিতাদের জন্য নাই, সেই ধর্ম আমি চাই না।

এরপর আল্লামা আরশাদ মাদানী ‍উপস্থিত অভিভাকদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাদের ছেলে মাদ্রাসায় দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি তারবিয়াতী শিক্ষাও পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলল। কিন্তু মাদ্রাসার ছুটিতে সপ্তাহে বা মাস অন্তর বাসায় এসে দেখল পিতা-মাতা নামায পড়ে না ঠিক মতো, ঘরে গান-বাদ্য চলছে, মা-বোনরা বেপর্দায় চলে, তখন সেই ছেলে মাদ্রাসায় এক সপ্তাহ বা এক মাস থেকে ইসলামের যে অনুশীলন করেছে, সেটা বাসায় আসার পর একদিনেই নষ্ট হয়ে যাবে।তাই আপনাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে যে, সন্তানকে মাদ্রাসায় দিলেই আলেম ও আদর্শবান হয়ে গড়ে উঠবে না। এ জন্য বাসার মধ্যেও দ্বীনি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে এবং বাসার সকল সদস্যদের মধ্যেও দ্বীনের চর্চা থাকতে হবে। সকলে নামাযের পাবন্দ হতে হবে। পর্দা করতে হবে। সৎ ও আদর্শবান হয়ে সকলকে চলতে হবে।হালাল-হারাম বিবেচনা করে চলতে হবে এবং আখেরাতের ধ্যান-খেয়ালের আলোচনা করতে হবে।বিষয়টা আপনারা গুরুত্বের সাথে খেয়াল করবেন এবং সে মতে আমল করবেন।

বয়ান শেষে আল্লামা আরশাদ মাদানী বিশেষ দোয়া-মুনাজাত পরিচালনা করেন। এরপর তাঁর সম্মানে জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া’র ভোজসভায় যোগ দেন এবং দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন। খাবার ও সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম শেষে বিকেলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরজাবাদ মাদ্রাসা থেকে তিনি মাদানী নগর মাদ্রাসার সম্মেলনে যোগ দিতে রওনা হন।