Home ওপিনিয়ন প্রশ্ন তোলা ও উত্তর খোঁজার চেষ্টাকে কেন টার্গেট করা হয়

প্রশ্ন তোলা ও উত্তর খোঁজার চেষ্টাকে কেন টার্গেট করা হয়

।। আলতাফ পারভেজ ।।

যার যার সামাজিক পরিসরে দেশ-বিদেশ নিয়ে ভাবনা, মতামত বিনিময় এবং তার অনুশীলনই রাজনীতি। দুনিয়ায় কেউই এই রাজনীতির বাইরে নেই। তারই একটা রূপ ‘ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি।’

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি নিয়ন্ত্রণের একটা অভিলাষ ধাপে ধাপে এগোচ্ছে। আরও এগোবে।

বুয়েটকে বাংলাদেশের অগ্রসর বিদ্যাপীঠ গণ্য করার রেওয়াজ আছে। বুয়েটের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনে ধীরে ধীরে দেশভাবনা বন্ধের আয়োজন চলবে।

ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের চর্চা নিষিদ্ধ করতে অজুহাত হিসেবে টেনে আনা হচ্ছে সন্ত্রাসী ঘটনাকে। গণতন্ত্রের চর্চাকে সন্ত্রাসের পোশাক পরিয়ে জবাই দিতে চাওয়া হচ্ছে আসলে মানবিক ভাবনা-চিন্তা-চর্চার স্বাভাবিকতাকে। আরও স্পষ্ট করে বললে তরুণ-তরুণীদের প্রশ্ন তোলা ও উত্তর খোঁজার চেষ্টাকে টার্গেট করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা আবরার হত্যার আগে-পরে শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল, প্রতিবাদ জানাচ্ছিলো। বিপুল সামাজিক সংহতিও পায় সেই প্রতিবাদ। ঐ সামাজিক সমর্থন এখন অস্ত্র হিসেবে নিপীড়নবিরোধীদের স্তব্ধ করার কাজে লাগছে! বেশ কৌশলী প্রচেষ্টা এটা—যখন দেখা যাচ্ছে, তরুণ-তরুণীদের খাঁচায় পোরার কাজে আবরার হত্যার মতো ঘটনাবলীকে ঢাল হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।

এরকম আয়োজনের কারণটি পরিষ্কার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় আকারের খাঁচায় রূপান্তরের কাঠামোগত ‘কাজ’টি রাজনৈতিক-অর্থনীতির জন্য খুব জরুরি। ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি বন্ধের আয়োজন তাই এ কালে একটি অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প না হয়ে পারে না এবং তাই হয়েছে।

তরুণদের গণতন্ত্রের চর্চা বন্ধের কাজটি প্রয়োজন মূলত সকল ক্ষমতাবানদের জন্য। কর্তৃত্বশালীদের জন্য।

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন- ‘ছাত্ররা উপলক্ষ্য, দীর্ঘমেয়াদে লক্ষ্য কিন্তু সবাই’

সমাজের পরতে পরতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যে ভরকেন্দ্রগুলো আছে- সেগুলো বিশ্বজুড়েই তরুণ-তরুণীদের সামনে ন্যায্যতা নিয়ে থাকতে পারছে না আর। তরুণরা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের জায়গাগুলোর অন্যায্যতা ও অযৌক্তিকতা চিনে ফেলছে। দুর্নীতিকে শনাক্ত করছে। সেগুলো চ্যালেঞ্জ করছে, কথা বলছে, গান করছে, কবিতা লিখছে, গ্রাফিথি আঁকছে, প্রশ্ন তুলছে, উত্তর খুঁজছে এবং গণতন্ত্র চাইছে- যে গণতন্ত্র সকলকে মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়। কিন্তু অনেকের জন্য এ পরিস্থিতি মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়া কষ্টকর। ফলে এসব আটকানো চাই। সন্ত্রাসের আবরণে আটকানোর কাজটা সহজ হয়।

পাশের দেশ ভারতে একই কাজ করতে চাওয়া হচ্ছে- প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ‘এন্টি-ন্যাশনাল’ মোহর দিয়ে। পাকিস্তানেও কোথাও কোথাও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ গালি দিয়ে।

বহু আগে থেকে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের ইউনিয়ন নির্বাচন বন্ধ একই অভিযোগে। ‘ইউনিয়ন থাকলে সন্ত্রাস হয়, মারামারি হয়’- এই যুক্তিতে ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসির ঐ রূপটি অকার্যকর করে রাখা আছে। আসল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মতামত গঠনের প্রক্রিয়া বন্ধ করা, সমাজের নীচ থেকে নেতৃত্ব তৈরির পথ রুদ্ধ করা এবং বিশেষভাবে শিক্ষাখাতের বিশাল তহবিলটির উপর প্রশ্নহীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

এভাবে উপনিবেশিক আমলেও যা হয়নি– স্বাধীনতার আমলে তাই সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দেশভাবনাকে গড়ে ‘অপরাধ’ ও ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে সাব্যস্ত করা যাচ্ছে। কিন্তু আড়ালে থাকছে শিক্ষাঙ্গন ও জ্ঞান-অর্থনীতির প্রকৃত প্রতিপক্ষরা। [চলবে]

– আলতাফ পারভেজ, সাংবাদিক ও গবেষক।

আরও পড়ুন-

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অনেক সময় কৌতুক মিশ্রিত হয়েও আসে