Home ইসলাম সঠিক নিয়্যাত ও একনিষ্ঠতাবিহীন ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না

সঠিক নিয়্যাত ও একনিষ্ঠতাবিহীন ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। ইবাদত অর্থ তাঁর আনুগত্য করা। তিনি যা করতে নির্দেশ করেছেন, তা পালন করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। যেমন, তিনি তাঁর একত্ববাদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে বলেছেন, শিরক বা তাঁর সমপর্যায়ের অংশীদার কেউ আছে- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে বলেছেন। শুধু এতটুকু বলেই আল্লাহ তাআলা ক্ষান্ত হননি। তিনি বলেছেন, আমি শিরকের গুনাহ কখনো ক্ষমা করব না খালেস তাওবা ছাড়া। আর এটি আল্লাহ তাআলার সাথে যতগুলো নাফরমানী আছে তার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্যতম। নামায, রোযা আদায় করতে বলেছেন, অন্যায় অশ্লীলতা, চুরি, ডাকাতি, যিনা, মদ্যপান, জুলুম, নির্যাতন ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।

বস্তুতঃ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত পালন করলেই কি সেগুলো মকবুল ইবাদতে গণ্য হবে? মানুষের চলাচলের জন্য কেউ একটি রাস্তা তৈরী করে দিল, একটি পুল নির্মাণ করে দিল, একটি মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ করে দিল। তাতেই কি তার আমলনামায় বেহিসাব সাওয়াব জমা হতে থাকবে? আল্লাহ তাআলা তার প্রতি খুশী হয়ে তার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিবেন? না, ওগুলো মকবুল ইবাদতে গণ্য হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ওগুলোর জন্য তার নিয়্যাত ঠিক হবে। কারণ প্রতিটি কাজেরই ফলাফল নির্ভর করে নিয়্যাতের উপর। আল্লাহ তাআলা নিয়্যাতের উপরই ফলাফল নির্ধারণ করবেন।

মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব হল, সে যে কোন একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজে অগ্রসর হয়। তার উদ্দেশ্য যদি হয় এই আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুশনুদী লাভ, তাহলে সে তার নিয়্যাত অনুযায়ী সাওয়াব ও ফযীলত পাবে। পক্ষান্তরে তার নিয়্যাত যদি সেরূপ না হয়, তাহলে সে সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে কঠিন আযাবেরও সম্মুখীন হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, নামায কায়েম করতে। এখন যদি কোন লোক নামায পড়ে আল্লাহর হুকুম রক্ষা করার জন্য, তাকে খুশী করার জন্য, তাহলে সে সাওয়াব পাবে। আর যদি এই নামায আদায় করে মানুষকে দেখানোর জন্য অথবা কোন হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, তাহলে সে কোন সাওয়াবের অধিকারী তো হবেই না, উপরন্তু আল্লাহর ভীষণ আযাবের সম্মুখীন হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘ওয়ায়েল’ দোযখ এমন নামাযীদের জন্য যারা নামাযের ব্যাপারে গাফেল (উদাসীন), যারা মানুষকে দেখানোর জন্য নামায পড়ে। (সূরা মাঊন- ৪, ৫)।

উপরোক্ত আয়াতে যাদের কথা বলা হয়েছে, তারা হল মুনাফিক। আর মুনাফিকদের জন্য আল্লাহ তাআলা সবেচেয় নিকৃষ্টতম দোযখ রেখে দিয়েছেন।

কাজেই নিয়্যাত সঠিক হতে হবে। নিয়্যাত সঠিক করার জন্য দু’টি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রথমতঃ কাজ করার পূর্বে উদ্দেশ্য স্থির করতে হবে। লক্ষ্যহীন অবস্থায় কোন কাজ করা যাবে না। দ্বিতীয়তঃ উদ্দেশ্য স্থির হওয়ার পর দেখতে হবে, এ কাজে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মতি আছে কি-না। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তাতে সন্তুষ্ট হবেন কি-না।

হযরত ইমাম গাজ্জালী (রাহ্.) একটি উপমা দিয়েছেন। আতর, কেউ যদি শুধুমাত্র সুঘ্রাণের জন্য ব্যবহার করে, তাহলে এতে গুনাহ্ও নেই সাওয়াবও নেই। পক্ষান্তরে কেউ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত, তিনি আতর ব্যবহার করতেন এ নিয়্যাতে ব্যবহার করে, তাহলে বিপুল সাওয়াবের অধিকারী হবে। আবার কেউ যদি আতর ব্যবহার করে নিজের অহংকার প্রকাশ করার জন্য, তাহলে গুনাহ্গার হবে। উপরে তিনটি প্রেক্ষাপটে আতরের সুঘ্রাণ কিন্তু একই ছিল, শুধুমাত্র নিয়্যাতের কারণে এই পার্থক্য।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ক্বিয়ামতের দিন বিচারের জন্য এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে। যিনি শাহাদত বরণ করে ছিলেন। আল্লাহর যেসব নিয়ামত তিনি উপভোগ করেছেন সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করেছ কি? আর শুকরিয়া স্বরূপ কি কি কাজ করেছ? উত্তরে তিনি বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার দ্বীনের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত কুরবান করেছি। জিহাদে শামিল হয়ে তোমার ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করিনি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি আমার জন্য, আমার দ্বীন ইসলামের জন্য জিহাদ করনি। তুমি জিহাদ করেছ নিজের নাম-যশের জন্য, তোমাকে মানুষ বীর বলবে এ জন্য। কাজেই তোমার পুরস্কার আমার কাছে নেই। অতঃপর ফেরেশ্তাগণ তাকে টেনে হেঁচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করবে।

এরপর আনা হবে একজন আলেমকে। তাকে আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করবেন- তুমি কিভাবে আমার শোকর আদায় করেছ? তিনি বলবেন, হে আল্লাহ্! আমি আজীবন আপনার কুরআন এবং আপনার রাসূলের হাদীস নিজে শিক্ষা করেছি এবং মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি। এসবই আপনার সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তোমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষ তোমাকে আলেম বলবে, ক্বারী বলবে, হাফেজ বলবে। মাওলানা সাহেব বলে সম্মান করবে। এসব তুমি দুনিয়াতে পেয়েছ। তুমি আমার ইসলামের জন্য কিছুই করনি। কাজেই আমার নিকট তোমার কোন পুরস্কার নেই। অতঃপর ফেরশ্তাগণ তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবে।

এরপর হাজির করা হবে একজন দানশীল ধনীকে। তাকেও অনুরূপ প্রশ্ন করা হবে। সে উত্তরে বলবে, হে দয়াময়! যেসব ক্ষেত্রে দান করলে তুমি খুশী হও, তোমার রাসূল খুশী হন, সে সব ক্ষেত্রে আমি দান করেছি। এতে উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র তোমার এবং তোমার রাসূলের সন্তুষ্টি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী। তোমার নিয়্যাত ছিল, তোমাকে মানুষ দাতা বলুক, তোমার সুনাম-সুখ্যাতি হোক। সত্যিকারভাবে তুমি আমার জন্য কিছুই করনি। কাজেই আমার নিকট তোমার জন্য কোন পুরস্কার নেই। অতঃপর ফেরেশ্তাগণ তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবে। (মুসলিম শরীফ)।

মূলতঃ আল্লাহ তাআলা বাহ্যিক দিক থেকে বিচার করবেন না। তিনি দেখবেন ভিতর অর্থাৎ অন্তরে কি আছে। কাজেই নিয়্যাত সঠিক হতে হবে। তাহলেই সাওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন মনে করুন, মসজিদে শয়ন করা, রাত্রিযাপন করা নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি কেউ ই’তিক্বাফের নিয়্যাতে রাতযাপন করে, তাহলে সেটি ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়।

সারকথা হল, নিয়্যাতে ইখলাস থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “এবং তাদেরকে নির্দেশই দেওয়া হয়েছে, যেন তারা ইখলাসের সাথে ইবাদত করে।” (সূরা বায়্যিনাত- ৫)।

একই সূরার ২ ও ৩ নং আয়াতে ঘোষিত হয়েছে- “আপনি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন। জেনে রাখুন,  নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহ্রই নিমিত্ত।”

খুলুসিয়্যাত বা নিষ্ঠানুপাতে আল্লাহর নিকট আমল গৃহীত হয়, গণনার মাধ্যমে নয়। কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটির মূল্য অনেক বেশি।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- “আমি ক্বিয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না।” (সূরা আম্বিয়া- ৪৭)। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা দাঁড়ি পাল্লা স্থাপন করবেন। সে দাঁড়ি পাল্লায় আমল ওজন করা হবে। এতেই বোঝা গেল, আমলের সংখ্যা গণনা করা হবে না। দেখা হবে আমলের মধ্যে ওজন কতটুকু আছে। অর্থাৎ খুলুসিয়্যাত কতটুকু আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ইখলাস আমার এক গুপ্ত রহস্য। আমি এটিকে আমার প্রিয় বান্দাদের অন্তরে আমানত রেখেছি।

ইখলাসের অর্থ হল, ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হবে। আর এই বিশ্বাস যদি অন্তরে দৃঢ় থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার আমলকে এমন পবিত্র করে দিবেন যেমন রক্ত এবং গোবরের মধ্য থেকে দুধ আলাদা করা হয়। কোন আমল যদি রিয়া মুক্ত হয় এবং শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য করা হয়, তবেই সেটিকে খালেস আমল বলা যাবে।

কেউ কেউ বলেন, এটিই ইখলাস যে, নিজের ইখলাসও দেখতে পাবে না। যে ব্যক্তি নিজের ইখলাসের মধ্যে ইখলাস দেখতে পাবে, তার ইখলাসের জন্যই ইখলাসের প্রয়োজন। আবার হযরত সাহল (রাহ্.) বলেন, বান্দার যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম উঠাবসা শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়ারই নাম ইখলাস।

হযরত ফুযাইল (রাহ্.)এর মতে মানুষের কারণে আমল ত্যাগ করা রিয়া। আর মানুষের জন্য আমল করা শিরক। আর এ দু’টি অবস্থা থেকে নিরাপদ থাকাই ইখলাস।

সুতরাং যার যার ইবাদত-বন্দেগী ও উত্তম কাজসমূহে ইখলাস যেন যথার্থ ও দৃঢ় থাকে, খুব সযত্নে খেয়াল রাখা জরুরী। যারা সামাজিক ও সেবামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত, সবসময় সতর্ক থাকবেন, আপনাদের মনে যেন জনপ্রিয়তা লাভ, প্রচার পাওয়া, প্রশংসিত হওয়ার মতো বাসনা না আসে। সব সময় আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের রাজি-খুশির বাসনা নিয়েই উত্তম কাজসমূহ করে যাবেন। যারা বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখালেখি ও ওয়াজ-মাহফিলে যুক্ত, সবিনয়ে আবেদন করছি, ফেসবুক ও স্যোশাল মিডিয়ায় এসব উত্তম কাজ নিয়ে বাগাড়ম্বরপূর্ণ পোস্ট দিবেন না। কারণ, আপনারা অনুকরণীয়। সাধারণ মানুষ আপনাদের কাছ থেকে প্রদর্শন সর্বস্ব আচরণ দেখতে চায় না।

আর যারা আদর্শিক ও ইসলামী রাজনীতির সাথে যুক্ত, তাদের মধ্যে এমনও কাউকে কাউকে দেখা যায়, পত্রিকায় কেন ছবি আসল না, উপস্থিতিদের নামের তালিকায় কেন নাম দুই জনের পরে আসল, পত্রিকার নিউজে কেন তার বক্তব্য দেওয়া হল না, এই নিয়ে রীতিমতো রাগারাগি ও দৃষ্টিকটূ বাজে মন্তব্য শুরু করে দেন দায়িত্বশীল সহকর্মীদের বিরুদ্ধে। পত্রিকার নাম ও ছবি আসা নিয়ে যদি আপনি রীতিমতো হুলুস্থুল শুরু করে দেন, তবে আপনার কাছ থেকে সুস্থ, সহনশীল, আদর্শ, আত্মত্যাগী সেবামূলক মানসিকতার সমাজ গড়ার মতো মহান কাজ আঞ্জাম দেওয়ার বাস্তবমুখী আশা করা যায় কিনা, একটু ভাবুন। রাজনৈতিক নেতাদের এমন হীন মানসিকতার আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা প্রকাশ পেলে, তাতে সাধারণ জনগণ হতাশই হয়ে থাকেন।

আল্লাহ আমাদের সকলকে ইখলাসের সাথে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখকঃ মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডটকম এবং কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। ই-মেইল- muftijakir9822@gmail.com