Home ওপিনিয়ন ‘রাজনীতিমুক্ত’ শিক্ষাঙ্গনগুলোর মান বেড়েছে কী?

‘রাজনীতিমুক্ত’ শিক্ষাঙ্গনগুলোর মান বেড়েছে কী?

।। আলতাফ পারভেজ ।।

পুরো সমাজ থেকে, বিশ্ব থেকেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আবার সেগুলো, নিজে এক-একটা খুদে ‘রাষ্ট্র’ও বটে। ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি নিষিদ্ধের সাথে দেশ গঠনমূলক রাজনীতি নিষিদ্ধের ফারাক ও দূরত্ব তাই সামান্য। এটা মানবসত্তার বিরুদ্ধে সরাসরি এক আঘাত মাত্র। সেই আঘাত নয়াদিল্লীতে যেমন, তেহরানে যেমন, পেশোয়ার এবং ঢাকায়ও তেমন।

যে সমাজে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান রাজনীতির খবরদারিত্বে রয়েছে– যেখানে ব্যক্তির জীবনের সবকিছু, এমনকি তার খাবার, পোশাক, সংস্কৃতিতেও লেপটে থাকে রাজনীতি–যেখানে পাঠ্যবইয়ের গল্প-কবিতা নিয়েও গভীর রাজনীতি চলে, বিবাদ হয়– সেখানে কেবল বেছে বেছে তরুণদের রাজনীতিমুক্ত জীবন যাপন করতে হবে কেন?
কারণ, তার প্রতিবন্ধিত্বের বিপরীতেই কেবল গুটিকয়েকের কন্ঠ– উচ্চকন্ঠ হয়ে উঠতে পারে। এটা একটা বোবাযুদ্ধ। নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির কালে এটা এক শ্রেণীযুদ্ধও বটে। বুয়েটের বার্তা তাই ভালোভাবেই আমলে নিতে হবে সকলকে।

আগামীতে আবরারের মতো কেউ খুন হলে–আশা করা যায়, বুয়েট পরিবার নিশ্চুপ থাকবে। ‘রাজনীতি’ করতে যাবেন না তাঁরা। সেই কপটতা বড্ড বেমানান লাগবে। কিন্তু সকল ক্যাম্পাসে নিপীড়ন, নির্যাতন, খুনের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করবেন কী সবাই?

ইদানিং দেখা যাচ্ছে, ‘শিক্ষার পরিবেশের স্বার্থে’ ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসিকে ‘অপরাধতুল্য’ বলে ন্যায্যতা দেয়া হচ্ছে। অনেক ‘বুদ্ধিজীবী’ এরকম দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ‘উন্নত শিক্ষা’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’ পরিবেশের স্বার্থে সকল বিদ্যাপীঠকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ করার সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। হ্যা, ‘সিস্টেম’-এর জন্য ‘শান্তি’ খুব দরকার।

প্রথম পর্ব পড়ুন- ‘প্রশ্ন তোলা ও উত্তর খোঁজার চেষ্টাকে কেন টার্গেট করা হয়’

কিন্তু ‘উন্নত শিক্ষা’র সঙ্গে তথাকথিত ‘রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন’-এর কোনই সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন দেখা যায়নি, ডাকসু-রাকসু-ইকসু না থাকায় ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক সূচক এগিয়েছে কিংবা সেসব জায়গায় শিক্ষার্থীদের পেটানো, টেন্ডারবাজি কিংবা হলদখল কমেছে। বরং প্রবল রাজনৈতিক কলরব ধারণ করেই জেএনইউ কিংবা যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বৈশ্বিক মানদন্ডে বহু ধাপ এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ-ভারতের সামান্য দূরত্বের মাঝে আমরা এই ভিন্ন দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।

দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ‘ছাত্র রাজনীতি’ বন্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এরূপ নিয়ন্ত্রণের নামে আসলে যা রুদ্ধ– তাহলো ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের চর্চা। কিন্তু সেখানকার শিক্ষার পরিবেশ ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ নয়– এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে উন্নত এমনটি দেখা যাচ্ছে না। গবেষণায়, জ্ঞানচর্চা, আবিষ্কারে– সেসব প্রতিষ্ঠান এগিয়েছে এমন শোনা যায় না। হ্যাঁ, কোথাও কোথাও ‘কবরের শান্তি’ বিরাজ করছে। কারণ, চরম বিপন্নতার মাঝেও সেখানে শিক্ষার্থীরা কথা বলতে পারে না। এরকম ‘কবরের শান্তি’ এবং ‘শিক্ষার উন্নত পরিবেশ’– নিশ্চিতভাবেই আলাদা কিছু। যেমন আলাদা কিছু কারা প্রাচীরের দুই দিকের পরিসর।

বাস্তবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্ঞানচর্চার ভয়হীন পরিবেশের জন্য দরকার গণতন্ত্র তাড়ানো নয়– বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সত্যিকারের স্বশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেই স্বশাসনের আকাঙ্খাই ছিল মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের স্বপ্নের জায়গা। কিন্তু কৌশলে সেই স্বশাসনের আকাঙ্খাকে আজ রূপান্তর করে নেয়া হয়েছে গুটিকয়েক সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর শাসনে।

‘স্বায়ত্তশাসন’ ও ‘গুটিকয়েকের শাসন’ মোটেই এক বিষয় নয়। স্বায়ত্তশাসনের নামে কোন ‘কর্তৃপক্ষ’ শিক্ষার্থীদের বলা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে ছিনতাই করতে পারে না। বাংলাদেশ সংবিধান অন্তত সেটা সমর্থন করে না। [পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য]

– আলতাফ পারভেজ, সাংবাদিক ও গবেষক।

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন- ‘ছাত্ররা উপলক্ষ্য, দীর্ঘমেয়াদে লক্ষ্য কিন্তু সবাই’