Home ইসলাম পর্দা আল্লাহর বিধান: যারা পর্দার বিরোধিতা করে তারা আল্লাহর নাফরমান

পর্দা আল্লাহর বিধান: যারা পর্দার বিরোধিতা করে তারা আল্লাহর নাফরমান

।। শায়খুল হাদীস মাওলানা তাজুল ইসলাম আশরাফী ।।

আল্লাহ তায়ালা মানব সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। এটা আসমানী কিতাব পবিত্র কুরআন ঘোষিত হয়েছে। এ জন্য পৃথিবীতে মানবের বংশ বিস্তারের প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের কারণে নর এবং নারী সৃষ্টি করা হয়েছে। নর এবং নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মানব বংশ বিস্তার করবে।

আল্লাহ তায়ালা অপূর্ব কৌশলে নর এবং নারী উভয়ের মধ্যে একটা আকর্ষণী শক্তি দিয়েছেন। তা না দিলে, সৃষ্টি প্রক্রিয়া অকার্যকর হতো না। চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ হবার গুণ রয়েছে। এটাই সঠিক যে, নর আকৃষ্ট হয় নারীর প্রতি। আর, নারীও আকৃষ্টা হয় নরের প্রতি। তথাপি এটাই সত্যি যে, নারীর প্রতি নরই অধিক আকর্ষণবোধ করে। মানসিক ভাবে নরই নারীর প্রতি অধিক দুর্বল, তা প্রমাণিত। হযরত আদম (আ.) বিবি হওয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই তিনি বিবি হাওয়ার অনুরোধে নিষিদ্ধ গন্ধম ভক্ষণ করেছিলেন। এটা শুধু আদি মানবের বেলাতেই ঘটেছিল, তাই নয়, আজও এরূপ ঘটতে দেখা যায়।

নর-নারীর অবাধ মেলামেশা অহিতকর বলেই নারীর জন্য পর্দাকে ফরয করা হয়েছে। নির্দিষ্ট কয়েকজন আত্মীয় পুরুষ ব্যতীত অন্যান্য পুরুষের সঙ্গে নারীর দেখা সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তা আল্লাহর কিতাব পবিত্র কুরআনের বিধান। রাসূল (সা.)এর প্রতি আল্লাহর অহী- “মুমিনা নারীগণকে বলুন, তাহারা যেন তাহাদের আপন দৃষ্টি সংযত রাখে, আপন লজ্জাস্থান রক্ষা করিয়া চলে, প্রকাশ না করে তাহাদের বেশ-ভুষা এবং অলংকার, ততটুকু ভিন্ন; যতটুকু সাধারণতঃ এমনি প্রকাশ পায় এবং আপন চাদর আপন গলা ও বুকের উপর জড়াইয়া দেয় এবং প্রকাশ না করে তাহাদের সাজ-পোষাক তাহাদের স্বামী কিংবা পিতা কিংবা শ্বশুর কিংবা নিজের পুত্র কিংবা স্বামীর পুত্র কিংবা সহোদর ভাই কিংবা ভাইয়ের পুত্র কিংবা ভাগিনা অথবা কাম প্রবৃত্তিহীন গোলাম অথবা সেই সকল শিশু, যাহারা নারীর গোপন বিষয় সম্পর্কে জানে না ইহাদের নিকট ব্যতিত এবং নারীরা যেন তাহাদের পা জোরে না ফেলে, যাহা দ্বারা জানা যায়, যাহা তাহারা গোপন রাখে সাজ-পোষাকে। (সূরা নূর- ৩১ আয়াত)।

কুরআন পাকে আরও বলা হয়েছে, হে নবীর বিবিগণ! তোমরা অন্য সাধারণ নারীর মত নও, যদি তোমরা পরহেযগার হও, তবে মধুর আলাপ করিও না (পর পুরুষের সাথে), তাহা হইলে যাহাদের অন্তরে রোগ আছে, তোমাদের প্রতি লোভ করিবে এবং তোমরা ভালভাবে কথা বলিও। আর, তোমরা শান্তভাবে নিজেদের ঘরে থাকিও; পূর্বের মূর্খতার যুগের ন্যয় সাজ-পোষাক করিয়া ঘুরিওনা। (সূরা আহযাব- ৩২-৩৩ আয়াত)।

আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত আছেন। তিনি জানেন, তারা যা মনের মধ্যে গোপন রাখে, তাও। নারীদের সৌন্দর্য এবং মধুর বাক্য পুরুষের অন্তরে রোগের সৃষ্টি করে। সেই রোগ হলো নারীদেহ সম্ভোগের স্পৃহা। হিন্দুপূরাণে জানা যায়, নারীদের সৌন্দর্য্য দেখে মুনীদেরও ধ্যানভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের দেবরাজ ইন্দ্র ও অহল্যার রূপে আকৃষ্ট হয়ে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে ছিলেন।

কুরআন পাকেও হারুত মারুত ফেরেস্তাদ্বয়ের উল্লেখ রয়েছে। তারাও দুনিয়ায় এসে স্থির থাকতে পারেননি। আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা.)কে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, হে নবী! তুমি নিজের বিবিদিগকে ও কন্যাদিগকে এবং মু’মিনগণের নারীদিগকে বল, যেন তাহারা নিজেদের চাদর সকল মাথার নীচে কিছুটা টানিয়া লয়। ইহাতে তাহাদিগকে চিনিতে সুবিধা হইবে। ফলে তাহারা উত্যক্ত হইবে না। (সূরা আহযাব- ৫৯ আয়াত)।

কবি নজরুল ইসলাম তার কবিতায় নর-নারীর মানসিক দুর্বলতার কথা এভাবে উচ্চারণসহ উল্লেখ করেছেন-

“বেহেশতে সব ফেরেশতাদের
বিধাতা কহেন হাসি
হারুত-মারুতে কি করেছে দেখ
ধরণী সর্বনাশী।

ময়না এখানে যাদু জানে সখা এক
আঁখি ইশারায়
লক্ষ যুগের মহাতপস্যা কোথায়,
উরিয়া যায়।

সুন্দর বসুমতী!
চির যৌবনা, দেবতা ইহার
শিবনয় কাম-রতি”।

নারী সম্পর্কে কবি মোহিত লাল মজুমদারের উক্তি-
‘তুমি নারী, নববধূ, তুমি
তার দেহ-সহচরী
কল্পনার কাম-স্বর্গে তাই তুমি
মোহিনী অপ্সরা।

উড়িছে ঘা গরি তব দিকে দিকে
বিবিধ বরণ
যৌবন-সঙ্কটে তুমি প্রাণেশ্বরী
পান-পায়োধরা
জায়া-স্বমৃ-মাতারূপে
কর যার মরণ বারণ,
মদন-সদনে তারে বাহুপাশে বাঁধি
আয়ু করিছ হরণ।

অতএব, নারীদের সঙ্গে নরের সাবধনা রক্ষা করে চলা কর্তব্য। নইলে অঘটন ঘটা স্বাভাবিক, যা ধর্ম ও এবং নীতির বিরুদ্ধে বৈধ নয়। এ কারণেই নারীর প্রতি পর্দার আদেশ। পর্দা নারীর বর্ম স্বরূপ। তার সুরক্ষার জন্য, পাপ ও পতন থেকে রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।

বর্তমান সময়ে বেপর্দা এবং নর-নারীর অবাধ মেলামেশার ফলে বহু দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তা আল্লাহর না পছন্দ এবং তাঁর বিধানের পরিপন্থী। তাই তা সীমালংঘনা। কুরআন পাকে বলা হয়েছে, আল্লাহ সীমা লংঘনকারীকে ভালোবাসেন না।

আরও পড়তে পারেন-

ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ ধর্মে আল্লাহ মানুষের জন্য যে সকল আচরণবিধি নির্দেশ করেছেন, তা সবই মানুষের শান্তি, মঙ্গল এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে। তার ব্যতিক্রম হলে ইহকালে অশান্তি, পরকালে কঠিন আযাব অবধার্য। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে শান্তি-শৃংখলার সঙ্গে বসবাস এবং তাঁর ইবাদত করতে পারে। সেই লক্ষ্যে কুরআন পাকের মাধ্যমে বিধি-বিধান জারী করেছেন।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরআনের আলোকে শরীয়া আইন প্রচার করেছেন। সকলেই মানব কল্যাণের নিমিত্ত। কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা পোষাক সম্পর্কে বলেছেন, হে আদম সন্তানগণ! আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি পোষাক নাযিল করেছি তোমাদের লজ্জা নিবারণের জন্য এবং শোবার জন্য। আর পরহেযগারীর পোষাকই উত্তম। এটা আল্লাহর মহিমার নিদর্শন, যাতে মানুষ উপদেশ মানে। (সূরা আহযাব- ২৬)।

পোষাক লজ্জা নিবারণের জন্য। আর, পরহেযগারীর পোষাককে উত্তম বলা হয়েছে। পরহেযগারীর পোষাক মানে আল্লাহর নির্দেশিত পোষাক, যার নমুনা আমরা রাসূল (সা.)এর নির্দেশনাতে পেয়ে থাকি। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)এর নিদর্শন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নারীর সতর-এর সীমা পুরুষ থেকে ভিন্ন এবং পোষাকও ভিন্ন। আর পর্দাও নারীর পোষাকের অন্তর্গত।

এক সময়ে নারীর পোষাকে ভিন্নতা সকল দেশ ও জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল। সম্ভবতঃ পাশ্চাত্যের ইহুদী-খ্রীস্টান সমাজই প্রথম নারীর পোষাক খর্ব করেছে। সেই সমাজে পুরুষের চাইতেও নারীদের পোষাকে অধিক খর্বতা লক্ষ্য করা যেত; যা অত্যন্ত আপত্তিকর ছিল। ঐ সকল দেশের ধর্মীয় নেতারাও তাতে হস্তক্ষেপ করছেন না। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, সেকালে তাদের পরিবারের নারীদেরও পর্দা মেনে চলতে হতো। জানা যায়, সেকালে অভিজাত হিন্দু পরিবারে নারীদের জন্য পর্দার ব্যবস্থা ছিল, যদিও তা পুরোপুরি ইসলাম সমর্থিত কায়দায় নয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্ধ গ্রামের অভিজাত মুসলিম পরিবারে বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়। তিনি একজন লেখিকাও ছিলেন। মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষায় পথিকৃৎ হিসেবে তিনি পরিচিতা। জানা যায়, তিনি নিজে পর্দা মেনে চলতেন। কিন্তু তিনি লেখনী চালনা করতেন পর্দার বিরুদ্ধে। পর্দাকে তিনি অবরোধ নামে আখ্যায়িত করেছেন। পর্দাকে তিনি নারী শিক্ষার অন্তরায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। “অবরোধ বাসিনী” নামে তিনি একটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাতে পর্দা তথা বোরখা নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছে।

বেগম রোকেয়ার বাল্য জীবনের কাহিনী থেকে জানা যায়, সেকালে মুসলমান সমাজে পর্দা নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল। তা কতটা সত্য, বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। আবার রোকেয়ার পর্দাবিরোধী রচনাতেও যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, তা সত্যি। তার রচনায় উদ্বুব্ধ হয়ে মুসলিম সমাজে পরবর্তী সময়ে পর্দা ভাঙার হিড়িক লেগে যায় মানুষের চিন্তা চেতনাতেও পর্দা বিভীষিকার রূপ নেয়। আমাদের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল হোসেনও এক সময়ে লিখেছিলেন- “আকাশের বিদ্যুৎকে ধরে এনে পরিয়ে দেয় বোরখা”।

নারীরা যদি হয় বিদ্যুৎ, তাহলে তাকে অবশ্যই একটি অবরণের মধ্যে আবৃত রাখতে হবেই, নতুবা স্পৃীষ্ট হয়ে সর্বনাশের আশংকা থেকেই যায়। আমরা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অহরহ এ ধরণের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি।

অধুনা আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারীরা পর্দা মেনে চলছে না। কেউ কেউবা পুরোপুরি পাশ্চাত্যের ইহুদী-খ্রীস্টান রমণীদের মতো বেপর্দায় চলাফেরা করছে। এরা ব্যভিচার চড়াচ্ছে, এইড্সসহ বিভিন্ন ঘাতক ব্যাধির জন্ম দিচ্ছে। বেপর্দার কারণে সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের দেশে বেপরোয়া নারী ধর্ষণের কারণও বেপর্দা। অবশ্য অন্য কারণও রয়েছে। তবে পর্দাহীনতাই অন্যতম।

পর্দাহীনা নারীরা সীমলংঘনকারিনী। তারা ধর্মবিধি মানে না বলে তাদেরকে স্বেচ্ছাচারিণী হতে দেখা যায়। এ দেশের পত্র-পত্রিকার পাতায় বহু কেলেংকারীর খবর পাওয়া যায়। আমাদের দেশের পৌঢ়ারমণী সংগীত শিল্পী রুণা লায়লা স্বামী বর্তমান থাকতেও নাযক আলমগীরের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ায় আলমগীর-অধ্যাপিকা খোশনুরের সংসার ভাঙ্গে। আরবী সাহিত্যে এম.এ. পাশ করা মেয়ে ফেরদৌসী হিন্দু রামেন্দু মজুমদারের ঘরনী হয়। এ-ও বেপর্দার কারণ। কুরআন পাকে সূরা নূর-এ এধরনের বিবাহকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ ধরনের জীবন যাপন আর ব্যাভিচারের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

পরকীয়ার প্রেমও ইসলামের বিধানে ব্যাভিচারের শামিল। বেপর্দাই পরকীয়ার সুযোগ করে দেয়। তাতে সামাজের শান্তি-শৃঙ্খলা এবং পবিত্রতা হরণ করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, নারীদের জন্য পর্দার বিধান রয়েছে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং পবিত্রতা রক্ষার জন্যই। পর্দার খেলাফ হলে অশান্তি, বিশৃংখলার এবং অপবিত্রতার কারণে ঘটায়। এটা আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বিধায় তার রোগের কারণ ঘটায়। আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে মানুষের ইহাকালেও নিরবচ্ছিন্ন সুখ হয় না এবং পরকালে দোযখের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

কুরআন পাকে আল্লাহ বলেন, আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি এবং যারা তাকে রীতিমত পাঠ করে, তাহারা এই কিতাবের উপর ঈমান আনে এবং যাহারা উহা মানে না, তাহারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ। (সূরা বাক্বারাহ, ১২১)।

ইসলাম আল্লাহর মনোনীত শান্তির ধর্ম। ইসলামের বিধানাবলী আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনে লিপিবদ্ধ। পর্দা আল্লাহর বিধান। যারা তার খেলাফ করে, তারা আল্লাহর নাফরমান। নাফরমানীর শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে। আল্লাহ সকলকে শুভবুদ্ধি দান করুন। আমীন॥

লেখক: শায়খুল হাদিস- তিলপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, খিলগাঁও, ঢাকা ও মিফতাহুল উলূম মাদ্রাসা, বাড্ডা, ঢাকা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- সানমুন ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, নয়াপল্টন, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।