Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষকদের বোবা কান্নার আর্তি

ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষকদের বোবা কান্নার আর্তি

।। আবুল বাশার (বাবু) ।।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিশাল খাদ্য চাহিদা পুরণে ক্রমহ্রাসমান সীমিত জমিতে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ করার মূল কারিগর দেশের কৃষক সমাজ। ধান-গম থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের যোগান নিশ্চিত রাখতে দেশের কৃষকরা নিরলস শ্রম ও মেধা ব্যয় করে চলেছেন। প্রতিবছরই ধানের বাম্পার ফলনের খবর প্রকাশিত হয়। তারই পাশে উঠে আসে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষকদের বোবা কান্নার আর্তি।

কঠোর কায়িক শ্রম ও ঋণ-কর্জ করে ধানচাষে বিনিয়োগের পর লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে করতে প্রায় নিস্ব হয়ে পড়া কৃষক এখন ধান চাষ ছেড়ে ভিন্ন ফসলের দিকে ঝুঁকছে। বিড়ি- সিগারেট কোম্পানীর প্রলোভনে পড়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ধান চাষের বদলে তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।

প্রধান খাদ্য ভাতের মূল উৎস হিসেবে ধানচাষে কৃষকের লোকসান ও অনাগ্রহ ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ধান-চালের বাজার ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। সে ধরনের বাজার মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলেও ভর্তুকি মূল্যে সরাসরি ধান ক্রয়ের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া সরকারের একটি মহতি উদ্যোগ। তবে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও সংশ্লিষ্ট মহলের স্বজনপ্রীতির কারণে সরকারী ধান-চাল সংগ্রহের সুফল কৃষকরা পাচ্ছে না।

জমির বর্গামূল্য, বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক, ধান রোপন ও কাটার শ্রমিকের ব্যয় নির্বাহ যেখানে প্রতিমন ধানের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা, সেখানে কৃষকরা সাড়ে ৬০০থেকে ৮০০ টাকা দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। তিন কেজি পেঁয়াজের মূল্যে একমন ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। এভাবেই ভেঙ্গে যাচ্ছে কৃষকের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড।

চলতি মওসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ১০৪০ টাকা মন দরে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ ধানকাটা শেষ হয়ে গেলেও এখনো সরকারী ধান সংগ্রহের প্রকল্প আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। এটি কোনো নতুন উপসর্গ নয়, প্রতি বছরই এমন আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসুত্রিতা এবং অনাকাঙ্খিত প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রকৃত কৃষক সরকারি ধান-চাল ক্রয়ের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়।

এ সব প্রতিবন্ধকতা ও অস্বচ্ছতা উত্তরণে ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কৃষক অ্যাপে লটারির মাধ্যমে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থার পাশাপাশি মনিটরিং কমিটি গঠনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দেশের ৪৯১টি উপজেলার মধ্যে মাত্র ১৬টি উপজেলায় সরকারী ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। অধিকাংশ কৃষক ঋণ করে ও বাকিতে ধান চাষের খরচ নির্বাহ করলেও সময়মত সরকারি ধান ক্রয়ের উদ্যোগ না থাকায় লোকসান দিয়ে ধান বিক্রিতে বাধ্য হওয়ায় ধানের বাম্পার ফলন কৃষকের হাসির বদলে নিরব কান্নায় পরিণত হয়েছে।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের দরপতনে কৃষকদের হতাশার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। দেশের মানুষের খাদ্যের যোগানদাতা কৃষকদের এমন দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষক বঞ্চিত হলেও সাধারণ ভোক্তারা কখনোই কমদামে চাল কিনতে পারে না।

কৃষকের কাছ থেকে ১৫-২০ টাকা কেজি দরে ধান কিনলেও চালের মূল্য ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকার নিচে নামে না। ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী, রাইস মিল মালিক ও চাল আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে সারা বছরই চালের যথেচ্ছ মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। মওসুমে দেশে প্রায় ৪ কোটি টন ধান উৎপাদিত হয়।

বৃহত্তর পরিসরে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারিত মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে মিলারদের ধান ক্রয়ে বাধ্য করা ছাড়া শুধুমাত্র সরকারি ধান-চাল ক্রয়ের মাধ্যমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে স্বচ্ছতার মাধ্যমে সরকারী ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা সময়মত পুরণ করা সম্ভব হলে তা ধান-চালের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

কৃষকের বিনিয়োগ-শ্রমে উৎপাদিত ফসলে মধ্যস্বত্ব ভোগিরা সারা বছরই মুনাফাবাজির সিন্ডিকেট গড়ে তুললেও কৃষকের বঞ্চনা নিরসনের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগ এখনো রাজনৈতিক ফাঁপা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ সব সরকারের পক্ষ থেকেই এমন স্বীকৃতি দেয়া হলেও কৃষকের ভাগ্য নিয়ে সিন্ডিকেটেড কারসাজি নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সব সরকারই ব্যর্থ হয়েছে, সব সরকারই অমনোযোগী থেকেছে।