Home ইসলাম তাবলীগ জামাআত: বিশ্বব্যাপী কার্যকর এক ইসলামী আন্দোলন

তাবলীগ জামাআত: বিশ্বব্যাপী কার্যকর এক ইসলামী আন্দোলন

।। খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ।।

আখেরী নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে দীনের দাওয়াতের গুরুদায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে উম্মতের ওপর। দাওয়াতের কাজ করার কারণেই আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা করেন।

“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সত্কাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে”। (সূরা আলে ইমরান- ১১০)।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- “যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সত্কর্ম করে এবং বলে আমি একজন আজ্ঞাবহ তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?” (সূরা ফুসসিলাত- ৩৩)।

যুগে যুগে মুসলমানদের মধ্যে দীনদার পরহেজগার আলেম-ওলামা, আওলিয়ায়ে কেরাম, তাবলিগের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ভারতের রাজস্থানের মেওয়া নামক স্থান থেকে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মুসলিহে মিল্লাত মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভী (রাহ.) তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজেই এ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই এ মহত্ কার্যক্রম ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াসের (রাহ.) মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্দলভী (রাহ.) তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভীও এ কার্যক্রমের প্রাণপুরুষ ছিলেন। মাওলানা ইনামুল হাসান (রাহ.) পরবর্তী সময়ে তাবলীগ জামাতের অন্যতম আমির বা নেতা ছিলেন। বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের আজীবন আমির ছিলেন মাওলানা আবদুল আযীয (রাহ.)। তিন-চার দশকের মধ্যেই তাবলিগের কার্যক্রম সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তার লাভ করে এবং ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর বিশেষ তাগিদসহকারে আমল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলেও জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিপূর্ণ দীনের ওপর আমল করার প্রতি উত্সাহিত করা হয়। জোর নয়, নরম স্বভাব, উন্নত চরিত্র, মার্জিত আচরণের মাধ্যমে হিকমতের সঙ্গে মানুষকে দীনের প্রতি ডাকা, সর্বোপরি সুন্নাতের ওপর আমল করার মাধ্যমে আল্লাহতালার সন্তুষ্টি অর্জন করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

“আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন, জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন পছন্দযুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভালো জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে”। (সূরা নাহাল- ১২৫)।

তাবলীগ জামাতের বিশেষ একটি গুণ হলো, তারা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে দীনের দাওয়াতের কাজ করে। কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেয় না। কারও কাছে কিছু চায় না এবং চাওয়ার ভানও করে না। কোরআনের এই আয়াতের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় তাদের এই গুণটি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

“অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথপ্রাপ্ত”। (সূরা ইয়াছীন, ২১)।

পরিবেশ অনুকূল হোক আর প্রতিকূল হোক, বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশেই তাবলিগের দাওয়াতি কাজ চলছে আলহামদুলিল্লাহ। এটা নিশ্চয় তাদের নিষ্ঠা ও ইখলাছের কারণে আল্লাহর বিশেষ রহমতে সম্ভব হচ্ছে। এবং তাবলিগের দাওয়াতি কাজের ফলে অমুসলিম মুসলমান হচ্ছে আর মুসলমানরা দীনের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হচ্ছে। সুন্নাত মতে আমল করা শিখছে।

যে গুণের ওপর তাঁরা বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করে থাকে। তা হলো যথাক্রমে- ১. কালেমা, ২. নামায, ৩. ইলম ও যিকির, ৪. ইকরামুল মুসলিমীন, ৫. তাসহীহে নিয়্যাত এবং ৬. তাবলীগ।

এই বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ- ১. কালেমা- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। অর্থাৎ- আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।

কালেমা থেকে পরিপূর্ণ ঈমান বোঝানো হয়ে থাকে। তাবলীগী ভাইয়েরা এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় বলে থাকেন, আল্লাহতাআলা ছাড়া অন্য যা কিছু আমরা দেখি বা না দেখি সব জিনিসই মাখলুক বা সৃষ্টি। মাখলুক কিছুই করতে পারে না আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া। আর আল্লাহতাআলা সব কিছুই করতে পারেন মাখলুকের সাহায্য ছাড়া।

ঈমানে মুফাসসালের ঘোষণা অনুযায়ী ৭টি জিনিসের প্রতি ঈমান আনতে হয়। (১) আল্লাহ (২) ফেরেশতাগণ (৩) কিতাবসমূহ (৪) রাসূলগণ (৫) আখেরাত (৬) ভাগ্যে ভালোমন্দ যা কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে অর্থাত্ তাকদির ও (৭) মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান। ঈমান অর্থ শুধু বিশ্বাস নয়, বরং অন্তরে বিশ্বাস, মুখে ঘোষণা এবং বাস্তবে কাজে পরিণত করার নামই হচ্ছে ঈমান।

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে , কারও কথাকে তার বিশ্বস্ততার নিরিখে মনে-প্রাণে মেনে নেয়া। অপরদিকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সংবাদ কেবলমাত্র রাসুলের ওপর বিশ্বাসবশত মেনে নেয়াকে শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান বলে। যুহাইর ইবনে হরব (রা.) আবু হোরায়রা থেকে রেওয়ায়ত করেছেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ঈমানের শাখা সত্তরটিরও বেশি অথবা ষাটটির কিছু বেশি। এর সর্বোচ্চ শাখা হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (অর্থাত্ আল্লাহ ব্যতীত মাবুদ নাই) এই কথা স্বীকার করা আর সর্বনিম্ন শাখা হলো পথের ওপর থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা হলো ঈমানের বিশেষ শাখাগুলোর অন্যতম। (মুসলিম)।

ঈমানের শাখাগুলোর বর্ণনা

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, আল্লাহপাক ব্যতিরেকে বাকি সব আল্লাহর সৃষ্ট (মাখলুক) ও ধ্বংসশীলে বিশ্বাস করা, সব পয়গম্বরের প্রতি ঈমান আনয়ন, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়ন, আল্লাহর নাজিলকৃত সব কিতাবের প্রতি ঈমান আনয়ন, কিয়ামত-দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন, তাকদিরের প্রতি ঈমান আনয়ন, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়ার ওপর বিশ্বাস, জান্নাতকে বিশ্বাস করা, জাহান্নামকে বিশ্বাস করা, আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসা রাখা, আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে কাউকে ভালোবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে কারও ওপর অসন্তুষ্ট হওয়া, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ভালোবাসা রাখা, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, আল্লাহর কাছে তওবা করা, আল্লাহর ওপর আশা রাখা, লজ্জাশীলতা, আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা, অঙ্গীকার পূরণ করা, ধৈর্য ধারণ করা, বিনয়ী হওয়া, আল্লাহর সৃষ্ট সব মাখলুকের ওপর স্নেহ ও দয়া, আল্লাহর ফয়সালার ওপর রাজি হওয়া, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, স্বৈরনীতি বর্জন করা, রাগ-ক্রোধ পরিহার করা, কুঅভ্যাস পরিত্যাগ করা, দুনিয়ার ভালোবাসা পরিহার করা। কালিমায়ে তাওহিদ পাঠ করা, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা, ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা, ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়া, দুয়া করা, জিকির করা, বেহুদা ও নিষিদ্ধ কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা, পবিত্রতা অর্জন করা, নামায কায়েম করা, সদকা আদায় করা, নিজের দ্বীন রক্ষার্থে হিজরত বা দেশত্যাগ করা, ইতিকাফ করা, হজ করা, মানত পূরণ করা, শপথের ব্যাপারে সতর্ক থাকা, কাফফারা আদায় করা, সতর ঢেকে রাখা, কোরবানি করা, ঋণ পরিশোধ করা, লেনদেনে ন্যায়-নীতি বজায় রাখা, শরীয়তবিরোধী কাজ থেকে দূরে থাকা, সত্য সাক্ষ্য দেয়া, কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা, বিবাহ করে চারিত্রিক পবিত্রতা সংরক্ষণ করা, পরিবার-পরিজনের হক আদায় করা, মাতা-পিতার খিদমত করা ও তাদের কষ্ট না দেয়া, মনিবের অনুগত হওয়া, বিচারে ন্যায়নীতি অবলম্বন করা, মুসলিম জামাতের অনুসরণ করা, শাসকের অনুসরণ করা, মানুষের মাঝে সংশোধন করে দেয়া, ভালো কাজে সাহায্য করা ও মন্দ কাজে সাহায্য না করা, সত্য কথা বলা, মন্দ কথা থেকে নিষেধ করা, দণ্ডবিধি প্রতিষ্ঠা করা, আমানত আদায় করা, অভাবী বা বিপদের সম্মুখীনকে ধার দেয়া, সন্তোষজনক লেনদেন করা, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা, অর্থসম্পদ যথাস্থানে খরচ করা, সালামের জবাব দেয়া, হাঁচিদাতার জবাবে ইয়ার হামু কাল্লাহ বলা, বেহুদা খেল-তামাশা থেকে দূরে থাকা এবং মানুষের ক্ষতি না করা ইত্যাদি।