Home বুক রিভউ গ্রন্থ আলোচনা- `সত্যের খোঁজে আসামে’

গ্রন্থ আলোচনা- `সত্যের খোঁজে আসামে’

।। নওশাদ জলিল ।।

আসাম ও বাংলা মিলে বহু বছর এক দেশ ছিল। এখন আসাম ভারত ইউনিয়নভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবেশী।

একদা একদেশ থাকার কারণেই উভয় স্থানে রয়েছে বিপুল বাংলাভাষী। রয়েছে বিরাট সংখ্যক মুসলমানও। ভারতে কাশ্মীরের পরই মুসলমানদের হিস্যায় এগিয়ে আসাম।

উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশও অনেকখানি একসঙ্গে শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে অনেক বছর উভয়ের জন্য একই জনপ্রতিনিধিসভা ছিল।
ভাষাগত, ধর্মগত এবং প্রশাসনিক এতসব কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের পরও বাংলাদেশে আসামচর্চা প্রায় নেইই। আসাম-বাংলা সাংস্কৃতিক যোগাযোগও নেই।

বিপরীতে বেড়েছে আসামে বাংলাদেশবিদ্বেষ। দশকের পর দশক আসামে পদ্ধতিগতভাবে বাংলাদেশকে ভিলেন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আসামের বাংলাভাষী এবং বিশেষভাবে মুসলমানদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে যেখানে গিয়েছেন এবং প্রতিনিয়ত যাচ্ছেন।

আলতাফ পারভেজ-এর ‘মিঞা অসমিয়া এনআরসি: আসামে জাতিবাদী বিদ্বেষ ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি এই বিদ্বেষী প্রচারণার একটা উত্তর।

বইটি কেবল একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাই নয়- এটা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক রক্ষাকবচ। এটা দীর্ঘস্থায়ী এক মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদও বটে।

বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আসামের এতদিনকার প্রধান প্রচারণাটিই হলো- বাংলাদেশীরা কেবল আসামে ঢুকছে এবং থাকছে। আলতাফ পারভেজ তার সত্যাসত্য অনুসন্ধান করেছেন। অনেক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে।

এই অনুসন্ধান জরুরি ছিল। কারণ এরকম প্রচার কেবল আসামে সীমাবদ্ধ নেই। সেটা চলছে পশ্চিমবঙ্গে এবং ত্রিপুরাতেও। এভাবে দশকের পর দশক বাংলাদেশীরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কল্পিত এক খলনায়ক হয়ে আছে।

এরকম প্রচারণার কারণেই এসব অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠছে না।

আলতাফ পারভেজ তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বাংলা একই প্রশাসন ও সীমান্তের অধীনে থাকার কারণে পুরো জনপদের একদিক থেকে অপরদিকে মানুষের স্বাভাবিক যাতায়াত ছিল। রাজনৈতিক কারণে আজ সীমানা পাল্টিয়েছে। আর এই সুযোগে ধর্ম ও ভাষাগত ভিন্নতার কারণে কিছু মানুষকে ‘বিদেশী’ বলে তাদের রাষ্ট্রনৈতিক পরিচয় কেড়ে নেয়া মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

এই কাজটি আসামে চলছে সম্পূর্ণ এক অর্থনৈতিক কারণে। রাজ্যটি খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে অতি সমৃদ্ধ। এখানকার চা বাগান সাম্রাজ্যও জগত বিখ্যাত। কিন্তু এটা ভারতের অন্যতম প্রধান দরিদ্র এলাকা হয়ে আছে। প্রাকৃতিকভাবে সম্পদশালী হয়েও আসামের এই যে দারিদ্র্য সেটা স্থানীয় রাজনীতিতে প্রবল কোন ইস্যু হতে পারছে না।

সুকৌশলে আসামের শাসকশ্রেণী রাজনীতির প্রধান ইস্যু করে রেখেছে ‘বিদেশী’দের। এই বিদেশী মানে বাংলাভাষীরা। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে বাংলাভাষী মুসলমানরা। স্থানীয়ভাবে যাঁদের বড় এক অংশকে ‘মিঞা’ নামে অবজ্ঞা করা হয়। বাংলাভাষী মুসলমানরা আসামে বহু স্থানে আজ অযথা, অযৌক্তিকভাবে ‘বাংলাদেশী বিদেশী’ তথা ‘মিঞা’ বলে অবজ্ঞার শিকার।
অসমিয়ারা রাজনীতির প্রধান এক কল্পিত ‘প্রতিপক্ষ’ করে রাখা হয়েছে মিঞাদের। এদের ‘বিদেশী’ সাব্যস্ত করে আসামে দশকের পর দশক ধরে ‘বিদেশী খেদাও’ আন্দোলন চলেছে। এই আন্দোলনেরই সর্বশেষ ফল এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি।

এই এনআরসি নিয়ে এখন সারা ভারত তোড়পাড়। বিজেপি এনআরসিকে ভারতজুড়ে মুসলমান বিদ্বেষের হাতিয়ার করেছে। ভারত সরকার এনআরসি করতে চায়Ñ কারণ তাদের মতে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল মানুষ ভারতে ঢুকে আছে এবং ঢুকছে; সুতরাং ‘এদের বের করতে হবে’!

যেকোন নির্বাচন হলেই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় বাংলাদেশী প্রসঙ্গ বড় এক রাজনৈতিক পণ্য হয়ে ওঠে। এসব প্রচারণা চালানোর সময় ভুলে যাওয়া হয়, আসামের চেয়ে বাংলাদেশের অনেক ভালো এখন। বাংলাদেশ থেকে সাধারণ মানুষের কাজের সূত্রে বা থাকার জন্য আসামে যাওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। মাথাপিছু আয়ে, জীবনযাত্রার মানে আসামের কোন তুলনাই হয় না বাংলাদেশের সঙ্গে।

আলতাফ পারভেজ পুরো বিষয়টিকে আসাম-বাংলা সম্পর্কের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তকে হাজির করে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর গ্রন্থটির ভিত্তি প্রধানত পরিসংখ্যান ও ইতিহাস।
তিনি বারবার দেখিয়েছেন, কীভাবে মূলধারার গবেষকরা ইতিহাস থেকে এই অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের জনমিতিকে তুলে ধরে এবং বাংলাদেশবিরোধী কল্পিত এক বয়ান তৈরি করছে। আসামকেন্দ্রীক ভারতীয় গবেষণাবিদ্যার বিপরীতে এই গ্রন্থ কার্যত একটা প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হলো এখন থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার রাজনীতির এক উদাহরণমূলক ময়নাতদন্ত বলা যায় এই বইকে।

বইটির অধ্যায়গুলো নিম্নরূপ:

আসামের ভৌগলিক পরিবর্তনশীলতা ও বাংলাদেশ; আসাম-বাংলা সম্পর্ক এবং জাতিঘৃণার ঐতিহাসিক পটভূমির খোঁজে; আসামের আন্তঃজাতি সংঘাত যেভাবে বাংলাদেশ ও মুসলমান বিদ্বেষে পৌঁছালো; আসামের মুসলমানরা কী সবাই বাংলাদেশী: সত্য-মিথ্যার খোঁজে; আসামে নাগরিকপঞ্জি, আইন ও মানবাধিকার প্রশ্ন; এবং আসামের অর্থনীতি ও দারিদ্র্য বনাম আসামের রাজনীতি।

এই অধ্যায়গুলোর মাধ্যমে ‘মিঞা অসমিয়া এনআরসি’তে লেখক আসাম ও বাংলাদেশের সম্পর্কের পূর্বতন প্রায় দুই শতাব্দিকে সংক্ষিপ্তভাবে পর্যালোচনা করেছেন। যে পর্যালোচনা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও করা দরকার। তা না হলে ভারতে আজকের পরিচয়ের রাজনীতিতে বাংলাদেশঘৃণা কেবল জ্বালানি হয়েই থাকবে।

গ্রন্থটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন মাসুক হেলাল। দাম রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা। ঢাকার অমর একুশে বইমেলায় প্রথমা’র স্টলে বইটি পাওয়া যাবে।