Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ভালবাসা দিবস: ইসলাম কী বলে?

ভালবাসা দিবস: ইসলাম কী বলে?

।। আবু জোবায়ের ।।

নির্দোষ ও পরিশীলিত ভালোবাসা শুধু পবিত্র নয়, পূণ্যময়-ও বটে। ইসলাম শুধু নিজেকে নয়, পরিবারকে নয়; বরং প্রতিবেশীসহ সকলকেই ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছে। একে অন্যকে ভালোবাসার এমন অবিনাশী চেতনা ইসলাম ছাড়া আর কোথাও নেই। ইসলাম শুধু অন্যকে ভালোবাসার কথাই বলেনি; নিষ্ঠার সঙ্গে ভালোবাসাকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে লালন করতে বলেছে।

আনাস ইবন মালিক (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- কোনো মানুষ ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না সে মানুষকে কেবল আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে। ( বুখারী- ৬০৪১)।

সুতরাং একজন প্রকৃত মুসলমানের হৃদয় সততই অপরের জন্য নিবেদিত ভালোবাসায় টইটুম্বুর থাকবে। তাই ভালোবাসা কোনো পঙ্কিল শব্দ নয়, নয় কোনো বস্তাপঁচা বর্ণগুচ্ছ। ভালোবাসা এক পূণ্যময় ইবাদতের নাম। ভালোবাসতে হবে প্রত্যেক সৃষ্টিজীবকে, প্রতিটি মুহূর্তে। তাই একে সীমিতকরণে নির্দিষ্ট কোনো দিনে বিশেষ পন্থায় ভালবাসা উদযাপন করা অমানুষী কাজ।

ভালবাসার আমদানি

বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভালবাসা দিবস’ নামে এমন কাজটিই বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। তথাকথিত প্রগতিশীল (?) সাংবাদিক শফিক রেহমান এ দিবসটি বাংলাদেশে আমদানি করেন। তিনি ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম তা উদযাপন করেন। এবং তাঁর ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকার মাধ্যমে তা প্রচার করেন। এর পরের বছর থেকে সুযোগসন্ধানী নীতিহীন ব্যবসায়িরা এবং সস্তা জনপ্রিয়তাকামী মিডিয়ারাও দিবসটির প্রচারণায় নামে। ফলে ধীরে ধীরে এ দিবসটির পরিচিতি বাড়তে থাকে।

গোড়ায় গলদ

পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ বলা হয়। এ দিনটিকে ‘লাভ ডে’ বা ‘লার্ভাস ফেস্টিভ্যাল’ বলা হয়না। অথচ আমাদের দেশে সুচতুরতার সাথে সেন্ট শব্দটিকে বাদ দিয়ে তার অনুবাদ করা হচ্ছে ‘ভালবাসা দিবস’ নামে। এই বিকৃত অনুবাদের কারণে সাধারণ মুসলমানরা এর প্রকৃত অর্থ, উৎপত্তির কারণ ও ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে।

ইতিহাসের দোরগোড়ায়

সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ও ভ্যালেন্টাইন’স ডে; দুটিরই ইতিহাস রহস্যাবৃত হয়ে আছে। নিশ্চিতভাবে কেউ জানেনা— ১. কে এই ভ্যালেন্টাইন? ২. কোত্থেকে এলো এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে? ৩. তাঁর সাথে এ দিবসের কী সম্পর্ক? ৪. এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিই কেনো তা উদযাপন করা হয়? তাই ১৮৫৩ সালে নিউ ইর্য়ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনে বলা হয়, “এটি তেমনি এক রহস্যময়, ঐতিহাসিক বা প্রত্নতত্ত্বীয়/পৌরাণিক সমস্যা; যার নিয়তিতে কখনও সমাধান নেই”। তবে বর্তমানে যে ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদযাপিত হয়, তার সঙ্গে যে জড়িয়ে রয়েছে খ্রিস্ট ধর্ম ও প্রাচীন রোমের ঐতিহ্য; এ ব্যাপারে সবাই একমত।

সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন

সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন হচ্ছেন: খৃস্টান গীর্জা কর্তৃক ‘পবিত্র সত্তা’ হিসেবে ঘোষিত একজন ধর্ম-যাজক। যিনি পরবর্তীতে প্রেমিক-যাজক হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। তাকে নিয়ে সেই প্রাচীন রোম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রচলিত আছে বেশ কিছু তত্ত্ব-গল্প-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু এখানে দেওয়া হলো। কথিত আছে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ভ্যালেন্টাইন বা ভ্যালেন্টিনাস নামের তিন জন সেইন্টকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এদের প্রত্যেকেই হত্যা বা ফাঁসির শিকার হয়েছেন। তবে ১৯২৩ সালে টাইমস-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুজন সেইন্ট ছিলো ‘ভ্যালেন্টাইন’ নামে। যায় হোক তাদের গুলিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সবার গল্প এক হয়ে একজন ভ্যালেন্টাইনের সাথে মিলে গিয়েছে। তবে তাদের কারো গল্পের সাথে রোমান্টিসিজমের কোনো সম্পর্ক ছিলো কিনা; তা নিশ্চিত জানা যায় না।

এক শ্রুতি অনুসারে, ভ্যালেন্টাইন তৃতীয় শতকে রোমে যাজক হিসেবে কাজ করতেন। তখন রোমের সম্রাট ছিলেন পৌত্তলিক শাসক দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। তাঁর শাসনকালের এক পর্যায়ে এসে তিনি ঘোষণা দিলেন, তরুণরা বিয়ে করতে পারবে না। তাঁর যুক্তি ছিল, বিবাহিতরা স্ত্রীর মায়াজালে জড়িয়ে যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়তে আগ্রহী হবে না। ক্লডিয়াসের এই ঘোষণা মেনে নেননি সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন। কেননা তা ছিল খ্রিস্টধর্মের শিক্ষার বিপক্ষে। তাই তিনি এই অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে গোপনে তরুণ-তরুণীদের বিয়ে দিতে শুরু করেন। ক্লডিয়াসের কানে এই খবর পৌঁছলে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন । অন্য এক শ্রুতি অনুসারে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইনকে কারাদণ্ড দেন ক্লডিয়াস। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়ের সঙ্গে। সেই অন্ধ মেয়েকে তিনি সুস্থ করেন এবং একপর্যায়ে তাঁর প্রেমে পড়ে যান। মৃত্যুদণ্ডের দিন (১৪ ফেব্রুয়ারি) সেইন্ট তাকে একটি চিঠি লেখেন তিনি। চিঠির সর্বশেষে লিখেছিলেন- ‘তোমার ভ্যালেন্টাইনের পক্ষ হতে।’ ভিন্ন আরেক শ্রুতি অনুসার, রোমান কারাগার থেকে খ্রিস্টান বন্দিদের পালাতে সাহায্য করায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন।

তাই কোনটি যে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর আসল গল্প তা আজও রহস্য হয়েই আছে। তবে প্রতিটি গল্পেই তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে একজন সহানুভূতিসম্পন্ন, বীর ও রোমান্টিক মানুষ হিসেবে। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম ভ্যালেন্টাইন’স ডে শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। সে সময় ইংরেজি কবি জিওফ্রে চসার তার এক কবিতায় সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। তাঁর এই কবিতা প্রকাশের পর থেকেই ইউরোপজুড়ে ভ্যালেন্টাইন রোমান্সের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

ভ্যালেন্টাইন’স ডে

সাধারণত একজন খ্রিস্টান ধর্ম যাজকের নামানুসারে যে দিবসটি চলে আসছে তা একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা কীভাবে এবং কী কারণে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসবে পরিণত হয়েছে, তা জানতে হলে ইতিহাসের পেছনে ফিরতে হবে। প্রাচীন রোমানদের লুপারকালিয়া (Lupercalia) নামক একটি ধর্মীয় উৎসব ছিল। তাঁরা খ্রিস্টের জন্মেরও ২৫০ বছর পূর্ব থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে (১৩-১৫) দেব-দেবীদের পূজা-অর্চনা করার জন্য একটি উৎসব পালন করত‌। এই উৎসবের একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ছিল— প্রেমের দেবী জুনু ফেব্রুয়াটার (Juno Februata) আশির্বাদ কামনায় যুবকদের মধ্যে যুবতীদের বন্টনের জন্য লটারির আয়োজন করা হত।

এই লটারিতে যুবক যে যুবতীকে পেত তাঁর সাথে পরবর্তী একবছর লিভ টুগেদার করতো। তাঁরা বিশ্বাস করতো প্রেমের দেবীর আশির্বাদে যুগলরা ধন্য হবে। এবং ভবিষ্যত সন্তান ধারণে সক্ষম হবে। একসময় খ্রিস্টানরা রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল করলে, এই উৎসবকে পৌত্তলিক কুসংস্কার বলে ঘোষণা দেয় এবং তা বন্ধের আদেশ জারি করে। কিন্তু তাদের আদেশ কার্যকরী প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। ফলে পাদ্রীরা অপারগ হয়ে উৎসবটিকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। এবং তাঁরা ‘লুপারকালিয়া’ নামকে পরিবর্তন করে ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ নামে নামকরণ করেন। ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বুল্ডারের অধ্যাপক নওয়েল লেন্সকি ২০১১ সালে ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও-তে বলেন-

“পোপ প্রথম গ্যালাসিয়াস পঞ্চম শতাব্দীতে এটিকে খ্রিস্টানদের পবিত্র দিন ঘোষণার আগ পর্যন্ত এ উৎসবটি লাম্পট্য, ব্যাভিচার ও নগ্নতার জন্য পরিচিত ছিল। তিনি আরো বলেন, “এটি ছিলো মূলত মদ্যপানোৎসব, শুধু খ্রিস্টানরা তাদের পোশাক পুনরায় পরিধান করেছিল। কিন্তু তা এই দিনটিকে উর্বরতা ও ভালোবাসার দিন হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি।” সুতরাং ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ সেই যুবতী বন্টনের মত নির্লজ্জ উৎসব লুপারকালিয়ার পোশাকি নাম। যা এখনো প্রচ্ছন্নভাবে যুবতীদের বন্টন করে চলেছে— তাঁর ক্ষণিকের বয়ফ্রেন্ডের কাছে। নির্লজ্জে।

ইসলাম কী বলে?

ইমাম তাইমিয়া রহ. বলেন: বিধর্মীদের উৎসবের নিদর্শন রয়েছে এমন কিছুতে অংশ নেয়া মুসলমানদের জন্য জায়েয নয়। বরং তাদের উৎসবের দিন মুসলমানদের নিকট অন্য সাধারণ দিনের মতই। মুসলমানেরা এ দিনটিকে কোনভাবে বিশেষত্ব দিবে না। [মাজমুউল ফাতাওয়া (২৯/১৯৩)]

এছাড়াও আরো যে কারণে ভালবাসা দিবস উদযাপন করা জায়েয হবে না— ক) এটি একটি বিজাতীয় উৎসব, ইসলাম বিজাতীদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছে। খ) এটি মানুষকে হারাম প্রেম-ভালবাসায় জড়ায়। গ) এটি মানুষকে জিনা-ব্যাভিচারে লিপ্ত করে। ঘ) এটি মানুষের সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়। ঙ) এটি মানুষের পাপবোধকে বিলুপ্ত করে দেয়। চ) এগুলো ছাড়াও মানুষকে ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী অনেক অনর্থক কাজে ব্যস্ত রাখে। সুতরাং এ দিনের কোন একটি নিদর্শন ফুটিয়ে তোলা জায়েজ হবে না। সে নিদর্শন খাবার-পানীয়, পোশাকাদি, উপহার-উপঢৌকন ইত্যাদি যে কোন কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট হোক না কেন।

ভালবাসার কথা :

প্রিয় ভাই ও বোন! ভালবাসার জন্য কোন বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয় না। কোনো বিশেষ সঙ্গীর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বেলেল্লাপনা, বেহায়াপনা করার জন্য বিশেষ সময়, দিবস লাগে; বিশেষ সঙ্গী লাগে। কাজেই আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন তা একটু ভেবে দেখুন! এবং এসব ইতিহাস জানার পর আপনি একজন মুসলিম হয়ে পৌত্তলিকদের উদ্ভাবিত ও খ্রিস্টানদের সংস্কারকৃত কোন অনুষ্ঠান উদযাপন করতে পারেন না। এবং আপনারা জাতির প্রাণ। দেশের ভবিষ্যৎ। আপনাদের নৈতিকতার পতন হওয়া মানে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হওয়া। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে— বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উৎসবের নামে নৈতিকতা ধ্বংসের যে উন্মত্ত প্রতিযোগিতা চলছে, তা থেকে বিরত থাকুন।

লেখক: abujobaer928@gmail.com