Home ফিকহ ও মাসায়েল রজব মাস যেভাবে কাটাবেন

রজব মাস যেভাবে কাটাবেন

।। আবু জোবায়ের ।।

এখন চলছে আরবী রজব মাস। রজব অর্থ সম্ভ্রান্ত, প্রাচুর্যময়, মহান। আল্লাহ তাআলা বারো মাসের মধ্যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সূরা তাওবা- ৩৪)।

এই চারটি সম্মানিত মাসের একটি হল রজব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক : যিলকদ, যিলহজ্ব, মহররম আর চতুর্থটি হল রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস। (সহীহ বুখারী- ২/৬৭২)।

উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আশহুরে হুরুমের এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফীক হয়। আর আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস- ৩/১১১; মাআরিফুল কুরআন- ৪/৩৭২)।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব থেকেই মাহে রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। অধিক নফল রোজা ও ইবাদতে কাটাতেন রজব ও শাবান মাসে। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘কখন রজব মাস আসত তা আমরা নবীজির আমলের আধিক্য দেখে বুঝতে পারতাম।’

হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে।’ তাই আমাদেরও কর্তব্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ করে রজবের হক আদায় করা। বেশি বেশি নফল নামাজ ও রোজা রাখা।

তবে স্মরণ রাখা উচিত যে, শরীয়তের পক্ষ থেকে এ মাসের জন্য বিশেষ কোনো নামায, বিশেষ কোনো রোযা বা বিশেষ পদ্ধতির কোনো আমলের হুকুম দেওয়া হয়নি। তাই বাজারের অনির্ভরযোগ্য বই-পুস্তকে রজব মাস উপলক্ষে বিশেষ নামায ও রোযার যেসব কথা পাওয়া যায় তা সবই ভিত্তিহীন।

এ ধরনের মনগড়া আমল দ্বারা এ মাসের ফযীলত লাভ করা সম্ভব নয়। রজব মাসের নামায বিষয়ে কিছু ভিত্তিহীন বর্ণনা: বার চাঁদের আমল শিরোনামের কিছু কিছু পুস্তিকায় রজব মাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভিত্তিহীন বর্ণনার সমাবেশ ঘটানো হয়েছে।

একটি বইয়ে লেখা হয়েছে— রজব মাসের প্রথম তারিখে মাগরিবের নামায ও ইশার নামাযের মাঝখানে বিশ রাকাত নফল নামায পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস ৩ বার, সূরা কাফিরূন ৩ বার পড়বে। তাহলে আল্লাহ পাক হাশরের দিন তাকে শহীদের দলের সহিত উঠাবেন এবং আল্লাহ পাকের নিকট সে বড় আবেদ বলে গণ্য হবে। রজব মাসের প্রত্যেক জুমার দিন জুমার পর আসরের নামাযের আগে চার রাকাত নামায এক সালামে পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ৭ বার আয়াতুল কুরসি ও পাঁচবার সূরা ইখলাস পড়বে…।

এই মাসের ১৫ তারিখকে শবে ইস্তেফতাহ বলা হয়। যে ব্যক্তি এই রাত্রিতে ৭০ রাকাত নফল নামায দুই রাকাত করে পড়বে…, ১৫ তারিখ রাতে তাহাজ্জুদের নামাযের সময়ে ৫০ রাকাত নফল নামায দুই রাকাত করে পড়বে…., তার সমস্ত দুআ কবুল করা হবে, কবর আলোকিত হবে এবং শহীদদের সাথে তার হাশর হবে এবং পয়গাম্বারদের সঙ্গে সে বেহেশতে যেতে পারবে। ১৫ তারিখ দ্বিপ্রহরের পর গোসল করে আট রাকাত নফল নামায পড়বে; দুই রাকাত করে….।

এ বর্ণনাগুলো মোসাম্মৎ আমেনা বেগমের লেখা ‘বার চাঁদের আমল ও ঘটনা’ নামক পুস্তিকায় রয়েছে। এছাড়াও শুধু রজব মাসের নামায সংক্রান্তই আরো কিছু বর্ণনা ও ঘটনা সেখানে রয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করা হল না।

এ পুস্তিকা, মকসুদুল মুমিনীন ও বারো চান্দের ফযীলত শিরোনামে লেখা অন্যান্য পুস্তিকায়ও রজব মাসের বিভিন্ন দিন-তারিখের বিভিন্ন সময়ের নামাযের বর্ণনা এবং তার বিরাট বিরাট ফযীলত লেখা হয়েছে। এই বর্ণনাগুলো এতই উদ্ভট যে, এর মধ্যে কিছু বর্ণনার অংশবিশেষ জাল হাদীসের কিতাবে পাওয়া গেলেও অন্যগুলো জাল হাদীসের ভাণ্ডারেও পাওয়া যায় না।

অষ্টম শতকের বিখ্যাত হাদীস বিশারদ হাফেয ইবনে রজব রাহ. বলেন— রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো নামায প্রমাণিত নয়। (লাতায়েফুল মাআরেফ পৃ.- ২২৮) তেমনিভাবে রজব মাসের বিশেষ বিশেষ রোযা বিষয়েও বিভিন্ন ধরনের জাল বর্ণনা এসকল পুস্তিকায় পাওয়া যায়, যার কোনোই ভিত্তি নেই।

হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন— রজব মাসের ফযীলত, রজব মাসে রোযা রাখার ফযীলত বা রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো দিন রোযা রাখার ফযীলত অথবা রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো রাতে নামায-ইবাদত করার ফযীলত সম্পর্কে প্রমাণ হওয়ার উপযুক্ত কোনো হাদীস নেই। (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব- পৃ. ১১)।

মোটকথা, রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো নামায বা রোযা নেই। এ মাসে নির্দিষ্ট কোনো দিনে নফল নামায বা রোযা পালনের বিশেষ কোনো ফযীলতের কথাও হাদীসে নেই। সুতরাং আমরা এগুলো বিশ্বাস করব না। তবে রজব মাস যেহেতু ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত চার মাসের অন্তর্ভুক্ত, তাই নির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ নির্ধারণ বা নির্দিষ্ট ফযীলতের বিশ্বাস ছাড়া এ মাসে নফল নামায বা রোযা রাখতে কোনো বাধা নেই।

রজব মাসে উমরাহ: রজব মাসে উমরাহ পালনে খুবই যত্নবান এমন অনেকেই আছেন। রজবের ওমরার আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে বলে তাদের বিশ্বাস। এ ধারণা অমূলক, ভিত্তিহীন। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব মাসে কোনো উমরাহ করেননি।

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো রজব মাসে উমরাহ করেননি।”

ইবনুল আত্তার (রহ.) বলেন, “রজব মাসে বেশি বেশি উমরাহ পালন সম্পর্কে যে একটি কথা আছে তার কোনো ভিত্তি নেই।”

আল্লামা ইবনে বায (রহ.) বলেন, “উমরাহ আদায়ের সর্বোত্তম সময় হল রমাদান; কারণ, হাদিসে এসেছে— রমাদানের উমরাহ হজের সমান সওয়াব রাখে। এর পর যিলকদ মাসের উমরাহ; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল উমরাহই ছিল যিলকদ মাসে।”

রজব মাসে শবে মি’রাজ: ইসরা ও মি’রাজ বলা হয়— রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ ও তার ঊর্ধ্বের ভ্রমণকে। যা তার মহান অলৌকিক ঘটনা সমূহের একটি। মি’রাজের রাত ২৭ রজব বলে বিভিন্ন দেশে যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তা আদৌ ঠিক নয়।

ইবনে তাইমিয়া (রহ:) বলেন,”ইসরা ও মি’রাজ কোন মাসে, কোন দশকে ও সুনির্দিষ্ট কোন তারিখে হয়েছিল এ বিষয়ে আমাদের জানা মতে কোনো প্রমাণ নেই।

এ মর্মে যা উল্লেখ হয়েছে তা কর্তিত ও বিভক্ত। অকাট্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব এই ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। যদি ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হওয়ার তারিখ সুনির্ধারিতভাবে জানাও থাকে তাহলেও তারিখটি উদযাপন করার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ সাহাবা ও তাবিইনগণ ইসরা ও মি’রাজের রাতকে অন্য রাতগুলো থেকে আলাদাভাবে দেখেছেন বলে কোনো দলিল আমাদের হাতে নেই।

এ রাত উপলক্ষে অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা তো অনেক দূরের কথা; বরং এ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান বহু বেদআত ও শরিয়ত বিরুদ্ধ কাজকে শামিল করে।” মাহে রমাদানের প্রস্তুতি: রজব মাস ও শাবান মাস হলো রমাদান মাসের প্রস্তুতি। রমাদান মাসে যেহেতু ইবাদতের সময়সূচির পরিবর্তন হয়, তাই সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। আর এজন্য বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, নফল রোজা রাখা এবং অধিক পরিমাণে যিকর ও কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করা যেতে পারে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের রজব মাসের হক আদায় করার তাওফীক দিন!

লেখক: শিক্ষার্থী- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।