Home শিক্ষা ও সাহিত্য মাদরাসা শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম-খতীবগণ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য কেন আন্দোলন করেন না?

মাদরাসা শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম-খতীবগণ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য কেন আন্দোলন করেন না?

।। হাফেজ মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

বুখারী শরীফের দরস এটা বিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জিং এক শিক্ষাধারা। ইসলামকে মিটানোর জন্য, মুসলমানদের অন্তর থেকে ইসলামী ভাবধারাকে স্বমূলে উৎখাত করার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং কৃষ্টি-কালচারের যে বিপ্লব, যে আগ্রাসন, শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রতিনিয়তই ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য, মুসলমান এবং মুসলমানিত্ব ধ্বংস করার জন্য, রাসূল (সা.)এর আদর্শকে স্বমূলে বিনাশ করার জন্য সারা বিশ^ব্যাপী যে আগ্রাসন, সেই আগ্রাসনের প্রতিরোধের চেতনা বহনকারী যে শিক্ষাধারা আজ থেকে দেড়শ বছর আগে দারুল উলূম দেওবন্দের ডালিম তলায় হযরত কাসেম নানুতবী (রাহ.) হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রাহ.)সহ আমাদের আকাবির ও আসলাফগণ শুরু করেছিলেন, সেই শিক্ষাধারার ধারাবাহিকতাই হল আজকে জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার এই বুখারী শরীফের দরস এবং দরসের আখেরী হাদীসের পাঠদান।

যেই চ্যালেঞ্জিং শিক্ষাধারা সারা পৃথিবীর সম্মুখে ইসলামকে এবং ইসলামের শিক্ষা, কৃষ্টি-কালচার ও রাসূল (সা.)এর আদর্শকে আজও পৃথিবীতে অম্লান হিসাবে তুলে ধরতে এবং অক্ষুণœ রাখতে সক্ষম হয়েছে, তা হল দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাধারা।

আলহামদুলিল্লাহ, এই শিক্ষাধারা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ’সহ বিশে^র অধিকাংশ মুসলিম এবং অমুসলিম দেশে যেখানে যেখানে দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষা কারিকুলামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু আছে সেখানেই রাসূল (সা.)এর সত্যিকারের দ্বীনি অবয়ব অম্লান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই জন্য এই শিক্ষাধারা এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে তথাকথিত কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা করলে হবে না। এই চ্যালেঞ্জিং শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বারা যেভাবে হকের পতাকাকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে আমাদের এই সমস্ত মাদারিসের ছাত্ররা সদা সচেষ্ট থাকে, তেমনিভাবে সমস্ত বাতিল ফেরকাগুলোর সামনে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে হিমালয়ের মত দাঁড়াতেও একমাত্র কওমী মাদরাসা থেকে ফারেগীন ছাত্র এবং আলেম ছাড়া সমাজের অন্য কাউকে দেখা যায় না।

কওমী মাদরাসা হল ঐ শিক্ষা ব্যবস্থার এমন এক ধারা, যেই শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজদের এক মহা দুষ্ট পরিকল্পনার মোকাবেলায় লর্ড ম্যাকেল’র এই উক্তি যে, আমি ভারতবর্ষে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবো, ভারতীয়রা এই শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর বাহ্যিক রঙে-রূপে ভারতীয় থাকলেও কৃষ্টি-কালচারে, মন-মস্তিষ্কে, চিন্তা-চেতনায়, আকিদা-বিশ^াসে তারা হবে ইংরেজ। সেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে হযরত কাসেম নানুতভী (রাহ.) আজ থেকে দেড়শ’ বছর পূর্বে দেওবন্দ শহরের সাত্তা মসজিদের সামনে ডালিম বৃক্ষের তলায় এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার বীজ বপন করে বলেছিলেন, আমি এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবো, যে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হওয়ার পর দেখতে-শুনতে ভারতীয়দেরকে ভারতীয় বুঝা গেলেও চিন্তা-চেতনায়, আক্বিদা-বিশ্বাসে ও দ্বীনে ইসলামে তারা হবেন মদিনার রাসূল (সা.)এর শিক্ষায় শিক্ষিত, রাসূল (সা.)এর আদর্শে আদর্শবান।

আলহামদুলিল্লাহ! হযরত কাসেম নানুতভী (রাহ.)এর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দারুল উলূম দেওবন্দের ছেলেরা সক্ষম হয়েছেন, শতভাগ সফল হয়েছেন। আজকের এই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের ৬৪ জেলা, ৬৪ জেলার শত শত থানা, ইউনিয়ন এবং হাজার হাজার গ্রামে যে মসজিদগুলো আছে, প্রত্যেক মসজিদের মুসল্লিরা তাদের দ্বীন-দ্বীনিয়াতের জিম্মাদারীর জন্য যে সকল ব্যক্তিত্বের নির্বাচন করেন, তাদের শতকরা ৯০ ভাগ কওমী মাদরাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ফারেগ আলেম। এটাই হলো আমাদের জাতীয় স্বীকৃতি। হযরত কাসেম নানুতভী (রাহ.)এর স্লোগান এটাই ছিল যে, কওমকে বাঁচানোর জন্য কওমের দ্বীন ইসলাম এবং ঈমানকে বাঁচানোর জন্য, কওম থেকে আহরণ করে কওমের সহায়তায় উলামায়ে কেরামের এমন এক তবকা আমরা প্রস্তুত করবো, যারা কওমের খেদমতে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দেশ ও কওমের কল্যাণে আজীবন কাজ করবে।

এই জন্য সমস্ত ডিপার্টমেন্টে বেতন ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধার জন্য আন্দোলন হয়। কারণ, তারা বস্তুবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শুধুমাত্র জাগতিক সুবিধা লাভের কথাই জানে। সচিবদের আন্দোলন হয়, ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের আন্দোলন হয়, হাইস্কুলের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর আন্দোলন হয়, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন হয়, সমস্ত ডিপার্টমেন্টে আন্দোলন হয়, কর্মবিরতি হয়, কাজ বন্ধ থাকে, আমাদের সুযোগ-সুবিধার দাবি না মানলে কাজ হবে না- এমন আওয়াজ জোরালো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে ৪৯ বছর বয়সে বাংলাদেশের কোথাও কোন মুয়াজ্জিনের বেতন বাড়ানোর আন্দোলন হয় নাই, কোন  ইমামের, কোন খতিব সাহেবের, কওমী মাদ্রাসার কোনো শিক্ষকের বেতন বাড়ানোর কোন আন্দোলন হয় নাই। কেন হই নাই? এই জন্য হই নাই যে, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেবের মত জগত বিখ্যাত বাযূর্গানে দ্বীনের সুহবতে ১০-১২ বছর লেখা-পড়া করার পর আমাদের ছাত্ররা এই বিশ^াসে বিশ^সী হয়, এই আকীদা দিলে পোষণ করে এখান থেকে বেরিয়ে যায়, তা হলো-

إِنَّ اللہ ھُوَ الرَّزَّاقُ ذُوا الْقُوَّۃِ الْمَتِیْنُ ۔ وَفِي السَّمَاءِ رِزْقُكُمْ اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ۔

অর্থাৎ- তোমদের রিযিকদাতা আসমানে, তোমাদের রিযিকদাতা আল্লাহ পাক, তোমাদের রিযিক এমন জায়গা থেকে ব্যবস্থা করা হবে- যা তোমরা ধারণাও করতে পারবে না। তোমরা করবে দ্বীনের কাজ, তোমদের রিযিকের ব্যবস্থা আল্লাহ পাকই করবেন।

এই জন্য তারা জগতের কোন মানুষের কাছে বেতন চাইতে যায় না। বেতন না বাড়ালে  আযান বন্ধ, বেতন না বাড়ালে ইমামতি বন্ধ, বেতন না বাড়ালে মাদ্রাসায় দরস দেওয়া বন্ধ; এমন আন্দলোন করতে যায় না। এমন দুনিয়াবিমুখ ও আখেরাতমুখী একটা জাতি গঠন করা একমাত্র কওমী মাদ্রাসার দ্বারাই সম্ভব।

আজকের বাংলাদেশে যদি খাই খাই ভাব ছেড়ে দিত, দুর্নীতি ছেড়ে দিত, তাহলে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার চেয়েও বেশি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠতো। আমরা কওমকে এমন একটা মেসেজ দিতে চাই, আমাদের কওমি মাদ্রাসার ফারেগ আলেমে-দ্বীনের মতো এমন অল্পে তুষ্ট একটা জাতি যদি গড়ে তোলা যেতো, আজকের বাংলাদেশ অল্পতুষ্টিতে থাকতে পারতো, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতো না।

আজ বালিশের দাম ২৬ হাজার, একটি কভারের দাম ২৭ হাজার, একটা পর্দার দাম ২৭ লক্ষ টাকা, এরকম বড় বড় দুর্নীতি করে দেশের কোষাগারকে দেওলিয়া করার সুযোগ পেত না।

আমরা সাধারণ মানুষকে এই মেসেজ দিতে চাই, আমাদের ছাত্ররা খেয়ে না খেয়ে, বেতন পেয়ে না পেয়ে, ইসলামী শিক্ষা দেওয়ার জন্য, মানবতার শিক্ষা দেওয়ার জন্য সদা-সর্বদা অতন্দ্র ্রহরীর মত কাজ করে যাচ্ছে।

আলহামদুলিল্লাহ, এখনো আমরা এই কাজের সুবাদে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আযানের ধ্বনি শুনতে পাই। আজ বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম-গঞ্জ নাই যেখানে কওমী মাদ্রাসা নাই। আজ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এই কওমীধারা কাজ করে যাচ্ছে, যাতে এই দেশের দ্বীন-দ্বীনিয়াত রক্ষিত হয়।

আলহামদুুলিল্লাহ আমরা ক্বওমের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকি। আজ এই খতমে বুখারী অনুষ্ঠান মূলত: দোয়ার অনুষ্ঠান। আজ কাশ্মীরের মুসলমান নির্যাতিত, দিল্লিতে মুসলমান নির্যাতিত, আফগানিস্তানে মুসলমান নির্যাতিত, সিরিযায় মুসলমান নির্যাতিত, এই যে চতুর্মুখী নির্যাতনের মুখে তাদের কোন অভিভাবক নেই। একমাত্র আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর নাই।

আফসসের সাথে বলতে হয়, আজ একদেশের মুসলমান নির্যাতিত হয়, আর অপর দেশের মুসলমান সরকার নিন্দা জ্ঞাপন করে ধিক্কার দেওয়ার দায়িত্বটা পর্যন্ত পালন করে না। এই জন্য আমাদের উচিৎ তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা। আল্লাহ আমাদের সমগ্র মুসলিমদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করুন।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়া-ঢাকা, সাবেক প্রিন্সিপাল ও মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল- ঢাকা উত্তরা রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা, খতীব-উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদ, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডটকম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।