Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিজয় দিবস, মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম

বিজয় দিবস, মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম

।। তারেকুল ইসলাম ।।

আজ বিজয় দিবস। বিজয়ের মাসে যদি স্বাধীনতার মূল্যায়ন করি, তাহলে হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই দেখি না। আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এই স্বাধীন হওয়ার অর্থ কী? ভৌগোলিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করলেও মানবিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিতের বিষয়টি আমাদের এখনো সুদূর পরাহত। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তিন মূলনীতি: ন্যায়, ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত এই স্বাধীনতা দিবসের কোনো আক্ষরিক মূল্য নেই। এগুলো জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন স্বার্থক হবে। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুখের কথা কিংবা রেটোরিক হয়েই বাজবে শুধু।

আর তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুলি তো শুধু মুখেই শুনি। কিন্তু আজ এর প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হচ্ছে কতটুকু? এই মূল্যায়নে আসতে হবে বৈকি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে দেশ ও জাতি গঠনের কথা তো অহরহ শুনছিই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথায় ভরে উঠছে কবিতা, গল্প ও বক্তৃতার মঞ্চ। প্রকৃতপক্ষে কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই।

আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পরে আজও আমাদের গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও অজয় রায়রা তো খুব আয়েস করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু প্রধানতঃ আমাদের গণতন্ত্রই যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে বাকিগুলোর কথা আর কীইবা বলবো! একদিকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেক্যুলার বয়ান পৌনঃপুনিক চর্বিত চর্বণ করে ক্রমশ হুজুগে রোমান্টিক হয়ে উঠছি, আর অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে সমানতালে দুর্নীতি, লুটপাট, রাজনৈতিক ও আদর্শিক মেরুকরণ আর ফ্যাসিবাদের ক্রমশ উন্নয়ন ঘটাচ্ছি।

এবার আসল কথায় আসি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দ দু’টি বহুল উচ্চারিত। কিন্তু, এর তো একটা বিশেষ সংজ্ঞা থাকা উচিত, যাতে করে সমগ্র জাতি একটা কমন ঐক্যের স্পেসে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সেটা কী? এটা কি কোনো আইডিওলজি নাকি স্রেফ একটি মুখরোচক শ্লোগান? কোনটি? যদি আইডিওলজি হয়, তাহলে জাতীয় পর্যায়ে এর নির্দিষ্ট কমন সংজ্ঞা কী এবং দেশ ও জাতি গঠনে এর লিখিত জাতীয় রূপকল্প কী? বরং আমরা দেখছি, একেক দল একেক রকম সংজ্ঞা হাজির করছে। যার যার দলীয় ও কায়েমী স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রাজনৈতিক ও আদর্শিক ব্যবসা করেই যাচ্ছে। আর যদি এটি কোনো আইডিওলজি না হয়, তাহলে আমি বলবো, এটা স্রেফ একটা জাতীয়তাবাদী চেতনা অথবা জাতীয়তাবাদপ্রসূত জিগির। যদি তাই হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এত হালকাভাবে ট্রিট করলে আমরা জাতি হিসেবে বেশিদূর এগোতে পারবো না।

আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অযথা বিভিন্ন আইডিওলজি অর্থাৎ বিশেষতঃ ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ভারী ভারী ইউরোপীয় মতবাদের মধ্যে আবদ্ধ রাখার চেয়ে অ্যাপ্লাইড বা প্র্যাকটিকাল জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকৃত বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়াই শ্রেয়। আর এজন্যই জাতীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটা কমন সংজ্ঞা দাঁড় করানো উচিত এবং একটা জাতীয় ঐক্যের স্পেস তৈরি করতে সুবিধে হবে।

এখন প্রশ্ন, কীসের ভিত্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং কীসের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কমন সংজ্ঞা দাঁড় করানো সম্ভব—যা ধর্ম, বর্ণ, মত ও দল নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে জাতিগতভাবে একটি কমন প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হবে এবং বিভিন্ন আদর্শিক মেরুকরণ সত্ত্বেও জাতীয় একক রাজনৈতিক সম্মিলনকেন্দ্র গঠনের মূল নিয়ামক হবে?

আরও পড়তে পারেন-

এক্ষেত্রে সবচে উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য একটি ট্রাম্পকার্ড আমাদের কাছেই আছে; আর তা হলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে সংঘটিত হয়েছিল। সেখানে আমাদের স্বাধীনতার মূলনীতি ছিল মাত্র তিনটি: ন্যায়, ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদা। এগুলোর বাইরে আর কোনো কনসেপ্ট বা ইডিওলজি তথা ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এমনকি গণতন্ত্রের কথাও উল্লেখ ছিল না।

আসলে তখনকার সময়ে এসব ভারী ভারী ইডিওলজি এদেশের সাধারণ মানুষের বুঝারই কথা না, কারণ তাদের বেশিরভাগই ছিল নিরক্ষর বা কম-শিক্ষিত। এবং সেসময় শিক্ষার হার খুবই নগণ্য ছিল। কিন্তু তাসত্ত্বেও তারা ঠিকই ন্যায়, ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদা কী জিনিস- তা বুঝত ভালোভাবেই। কারণ, এগুলো তো ইসলামেরও মূল বাণী। তাই এদেশের চিরন্তন ধর্মপ্রাণ গণমানুষের কাছে এগুলো গুরুত্ব পেয়েছিল এবং সেকারণেই তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

আবার এক্ষেত্রে মাথায় রাখা জরুরি যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে যেন আমরা ইসলামকে জাস্টিফাই করে না বসি। বরং ইসলাম দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাস্টিফাই করতে হবে।

আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেক্যুলারকরণ করা হচ্ছে। আমি অভিজ্ঞতা থেকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এখনো বাংলাদেশের গণমানুষ সেক্যুলারিজম কী জাতীয় বস্তু তা বোঝে না। একদিকে ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহায়ক ভূমিকা পালন করা আর অন্যদিকে সংবিধানে গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের এককায়ন করে এগুলো জনগণের অজ্ঞাতে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া, এটা বামদের নির্লজ্জ স্ববিরোধিতা।

আশার কথা হলো, সাধারণ মানুষ এখন অনেক সচেতন এদের ভণ্ডামির ব্যাপারে। আজকে বামরা যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, সেটা তারা যদি অনুধাবন করতে পারে, তবেই মঙ্গল। এখনো কোনো ইস্যুতে তারা হরতাল দিলে বা বিক্ষোভের ডাক দিলে এসবে তৃণমূল জনগণের অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, সাড়াও পাওয়া যায়না। জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতীত শুধু মিডিয়ার ওপর ভর করে রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন অসম্ভব। বামপন্থীরা তাই হতাশ। এমনকি বামপন্থী রাজনীতিকেরা নির্বাচনে দাঁড়ালে ভোট তো পায়ই না, উল্টো জামানত খোয়ায়। এসব থেকে বুঝা যায় তারা কতটা গণবিচ্ছিন্ন।

এখন আসি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের ব্যাপারে। এটা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানে, মিছিলে, স্লোগানে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জয় বাংলা স্লোগানটি নিঃসন্দেহে মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল । কিন্তু মনে রাখা দরকার, ‘জয় বাংলা’ই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র স্লোগান নয়। ‘নারায়ে তাকবীর’ও যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্লোগান, এটা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শহুরে মধ্যবিত্ত পরিসরে মিছিল, বিক্ষোভ, রাজনৈতিক সম্মেলন, রেডিও’র খবর ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি প্রেরণা যুগিয়েছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু, সশস্ত্র যুদ্ধের ময়দানে যাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র, মর্টারশেল ও স্টেনগান হাতে নিয়ে বর্বর পাক হানাদারদের সাথে বীরবিক্রমে মুখোমুখি যুদ্ধ করেছিলেন, তারা যুদ্ধ শুরু করতেন ‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান দিয়ে আর কালেমা শাহাদাত পড়তে পড়তে যুদ্ধ করতেন। কারণ, তারা মৃত্যুর অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলেন, হয় শহীদ না হয় গাজী।

আর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই মুসলমান ছিলেন। এই নারায়ে তাকবীরের কথাটি আমার নয়, এটা আমার মুক্তিযোদ্ধা নানার বক্তব্য। আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ইসমাঈল মেজর জেনারেল ইবরাহিম বীর প্রতীকের আন্ডারে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং শারীরিকভাবে মাশাল্লাহ আমার চেয়েও স্ট্রং। নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পান। সেসময়ে পাঞ্জাবিদের মুখোমুখি সশস্ত্র যুদ্ধ করার মতো হিম্মতওয়ালাদের মধ্যে আমার নানা ছিলেন একজন। রাজনীতি না করলেও তিনি কট্টর আওয়ামীপন্থী। যাই হোক, আমার নানার কাছ থেকে সশ্স্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও গল্প শুনেছি অনেক।

আমার আফসোস হয়, আজকে যারা কিনা বিদেশে বসে আরাম আয়েসে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ করেছিলেন, তাদের কাছ থেকেই আমাদের প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ান শুনতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে হয় জাফর ইকবালদের মতো সুবিধাবাদী লোকদের কাছ থেকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এদেশে জঙ্গিবাদী রাজনীতির প্রবর্তক বামরাই আজকে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবক শেখাচ্ছে। তারাই আজ অযাচিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেক্যুলারকরণ করছে। কী দুর্ভাগ্য!

– তারেকুল ইসলাম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও জাতীয় পত্র-পত্রিকার কলাম লেখক।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।