Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ওয়াজ মাহফিলে আক্রমানাত্মক বক্তব্য দেয়া যাবে কী ?

ওয়াজ মাহফিলে আক্রমানাত্মক বক্তব্য দেয়া যাবে কী ?

নিজস্ব প্রতিনিধি :
সমন্বিত স্কলার্স ফোরাম ইক্যুয়িটির উদ্যোগে সম্প্রতি ওয়াজ মাহফিলে কিছু আলেমের একে অপরের প্রতি আক্রমানাত্মক বক্তব্য, ওয়াজে বিনোদনমুলক বক্তব্য দিয়ে হাস্যরসের বিষয়ে পরিণত করাসহ ওয়াজ মাহফিলের সাম্প্রতিক কিছু নেতিবাচক দিক নিয়ে এক ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

দেশের বেশ কয়েকজন ওয়ায়েজিন আলেম ও বিশেষজ্ঞ এতে অংশ নেন। ‘প্রকাশ্য সমালোচনার ইসলামী পদ্ধতি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশের ওয়াজ মঞ্চ’ শীর্ষক আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ কওমী আলেম মুফতী শামসুদ্দীন জিয়া, প্রধান মুফতি, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন আব্দুল্লাহ জাফরী, প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডে ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। উদ্বোধক হিসেবে আলোচনা করেন মাওলানা মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান,অধ্যক্ষ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া,কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।

সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন প্রফেসর ড. মোসলেহ উদ্দিন, স্বাগত বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. শাফী উদ্দিন মাদানী, প্রেসিডেন্ট, ইক্যুয়িটি, ডীন, শরীআহ্ ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ, আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম। আলোচনা পেশ করেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাকী, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ন্যাশনাল দাওয়াহ্ ডিরেক্টর, মুসলিম উম্মাহ অফ নর্থ আমেরিকা (মুনা), আমেরিকা, ড. মোহাম্মাদ লোকমান হোসেন, অধ্যাপক, আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। মাওলানা গোলাম সারোয়ার সাঈদী, পীর সাহেব, আড়াইইবাড়ি দরবার, কুমিল্লা। মুফতী হাফিজুর রহমান মিসবাহ, কুয়াকাটা, প্রিন্সিপাল, মারকাজুত তাকওয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা। মাওলানা কবি নুনুল আমীন আমজাদী, বিশিষ্ট ওয়ায়েজ ও সাবেক প্রভাষক, ছারছীনা দারুছুন্নাত কামিল মাদরাসা, পিরোজপুর।

প্রসঙ্গ কথায় ওয়াজ নিয়ে পস্পরের কাঁদা ছোড়াছুড়ি ও ওয়াজকে হাস্যরসের বিষয়ে পরিনত করার দিক নিয়ে আলোকপাত করেন রিলিজিয়াস রিপোর্টাস ফোরামের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া।

আলোচনার শুরুতে তিনি বলেন, ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং অনুসারিদের সংশোধন ও আত্মগঠনে বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে ওয়াজ মাহফিল বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে কিংবা নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠিত করতে কিংবা হিংসা-বিদ্বেষ অথবা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে কিছু কিছু আলেম ওয়াজ মাহফিলকে বিতর্কিত করে তুলছেন।

ওয়াজকে বিকৃত করছেন, হাসিঠাট্রা, বিনোদন, বিদ্রোপ-বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে চিত্রিত করছেন। এক আলেম আরেক আলেমকে কাফের, মুনাফিক আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক বক্তব্যেরও অভিযোগ ওঠছে। সামাজিক যোগাযোগ্য মাধমে কিছু বক্তার ওয়াজ হাস্যরসাত্মক উপাদানে পরিণত হচ্ছে।

এতে ওয়াজ, আলেম সমাজ ও ইসলামের ব্যাপারে মারাত্মক বিরূপ ধারণা তৈরী হচ্ছে। ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো নেতিবাচক প্রচারণার সুযোগ পাচ্ছে। সমাজে বিশৃংখলা ও হানাহানির আশংকায় ওয়াজ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সরকারি তদন্ত কমিটি সুপারিশ দিয়েছে।
তাই ওয়াজের মাধ্যমে ইসলামি দাওয়াত ও সমাজ সংশোধনের কার্যকর এই ধারাটিকে অব্যাহত রাখার স্বার্থেই এ নিয়ে আলেম-উলামাসহ ইসলামের অনুসারীদের সচেতনতা, সতর্কতা অবলম্বন এবং সংশোধন জরুরি।

হিংসা-বিদ্বেষাত্মক বক্তব্য ও অশোভনীয় সমালোচনা : এক দলের বক্তা আরেক দল বা বক্তাকে কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, অশ্রাব্য ভাষায় হুমকি-ধমকি দেয়া ‘ইহুদি-নাসারাদের দালাল, জাহান্নামি, ‘নাস্তিক-মুরতাদদেও দোসর, কাফের, মুনাফেক আখ্যায়িত করাসহ নানাভাবে বিষোদগার করা হয়। অনৈক্যের বিষ ছড়ানো হয়, সমালোচনার নামে গীবত করা হয়। হিংসা বিদ্বেষ, কলহে উসকানি হয়। অথচ আল্লাহ তায়ালা কলহ বিবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদকে নিষিদ্ধ করেছেন। কলহের সৃষ্টি করতে পারে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করাও ইসলামের দৃষ্টিতে দূষণীয়।

ওয়াজের নামে বিনোদন : বানোয়াট গল্প, তথ্যসূত্র ছাড়া মনগড়া কেচ্ছা-কাহিনি, কথায় কথায় নাটক সিনেমার উক্তি উদ্ধৃত করা ও বাংলা, হিন্দু সিনেমা কিংবা প্রচলিত গান হুবহু তাল-লয়-সুর ঠিক রেখে উপভোগ্য করে ওয়াজের ভঙ্গিতে শুনানো হয়। সুরের তালে সামনে বসা সমর্থকদের উঠে নাচানাচি, ডিজে জিকিরের নামে হাস্যকর পদ্ধতির জিকির, কণ্ঠ বিকৃত করে বিশেষ জিকির, বিশেষ জিকিরের তালে তালে টাকা সংগ্রহ করার মতো প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

আবার এগুলোকে পুজি করে ইউটিউবে ফেসবুকে ‘ফানি ওয়াজ’‘হাসির ওয়াজ’, ‘হাসতে হাসতে লুঙ্গি খুলে যাববে’-এসব শিরোনামে ভিডিও ট্রল হচ্ছে। ‘বসেন বসেন বইসা যান’ ও ‘ ঢেলে দেই’ ‘ভাই পরিবেশটা সুন্দর না? কোনো হইচই আছে?’-ওয়াজে এই ধরণের উক্তি বিনোদনের অংশ হিসেবে ভাইরাল হচ্ছে।
ওয়াজকে এভাবে বিনোদনের বিষয়ে পরিণত করে এর আসল উদ্দেশ্যকে ব্যহত করা হচ্ছে, ওয়াজের দাওয়াতী ইসলাহী আবেদনকে খর্ব করা হচ্ছে, ওয়াজকে হাস্যকর বস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। এতেকরে আস্তে আস্তে সমাজ থেকে ওয়াজের আবেদন একেবারে কমে যাওয়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে।

অশালীন অঙ্গভঙ্গি, বিকৃত পদ্ধতিতে ওয়াজ : কিছু বক্তা ওয়াজে অশালীন অঙ্গভঙ্গী করেন। ওয়াজের সময় এমনভাবে উত্তেজিত হয়ে যান যে, মাইক থেকে শুরু করে সামনে যা কিছু পান, তাই ছুড়ে মারেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে যান, নান বিকৃত অঙ্গভঙ্গী করেন। তুই-তোকারি ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন হর-হামেশা। নবী রাসুলগনের নাম উচ্চারণের সময়ও অনেক্ষেত্রে অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।

ওয়াজ করার সময় এমনভাবে কথা বলেন, যেন যুদ্ধ করছেন কারো সাথে। যে কোন বক্তব্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অঙ্গভঙ্গী ও স্বরের উঠানামা করা প্রয়োজনীয় হলে তা করা যেতে পারে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়, অদ্ভূত, বিদঘুটে, অশালীন, অঙ্গভঙ্গী কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা।

এগুলো কোনভাবেই ইসলামের পদ্ধতি নয়। ইসলাম প্রচারে রাসুল (স.), সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে-সালেহীনদের পদ্ধতির বাইরে অন্য কোন পদ্ধতি চালু বা অনুসরণের কোন সুযোগ নেই।

ওয়াজের রেট নিধারণ ও বিলাসিতা : এক শ্রেণির বক্তা ওয়াজের জন্য আর্থিক রেট নির্ধারণ করেছেন। প্রয়োজন ছাড়াও হিলিকপ্টার ব্যবহারের মতো বিলাসিতা করছেন। ওয়াজকে বাণিজ্যের বস্তুতে পরিণত করছেন। কোন কোন ওয়ায়েজিন ‘হেলিকপ্টার হুজুর’ নামেও পরিচিত পাচ্ছেন। বিরূপ সমালোচনার কারণে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি ওয়ায়েজিনদের আয়কর প্রদানের তথ্য নেয়ার সুপারিশ করেছে। দ্বীনের প্রসার ও প্রচারে এইভাবে রেট নির্ধারণ করে বিনিময় নেয়ার কোন রেওয়াজ কোরআন-হাদীস অনুমোদিত নয়, বরং নিষিদ্ধ।

সাম্প্রদায়িক উসকানিমুলক বক্তব্য : কিছু বক্তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোরও অভিযোগ ওঠছে। অন্য ধর্মের সমালোচনা করতে গিয়ে এভাবে বিষয়াদি উপস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে যাতে সেই ধর্মের অনুসারিদের অনুভূতিতে আঘাত লাগছে। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় অন্য ধর্মের তুলনামুলক আলোচনা দুষনীয় নয়। কিন্তু অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করা বা অনুসারিদের আঘাত দিয়ে কথা বলতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ইসলামে।
এছাড়া দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমম্ব বিরোধী, দেশ ও জাতীর ঐক্য ওসংহতি বিনষ্ট হয়-এমন কোন বক্তব্যও ওয়াজিনদেও কাজ থেকে কখনো কাম্য হতে পারেনা।

অতএব ওয়াজের এই নেতিবচাক দিকগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট ওয়ায়েজিনদের বিরত রাখার জন্য শীর্ষ আলেমদের উদ্যোগী হওয়া সময়ের দাবি। সাধারণ মানুষকেও সচেতন করতে তুলতে হবে যাতে ওয়ায়েজিন নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারাও সস্তা জনপ্রিয়তাপ্রত্যাশী, বিভেদসৃষ্টিকারি, চটুল ও অর্থলোভী বক্তাদের পরিহার করেন।

আলোচক ইসলামে সমালোচনার পদ্ধতি, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার, গীবন ইত্যাদি বন্ধে কোরআন হাদীদেও নির্দেশনা তুলে ধরে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান।

ভারচ্যুয়াল আলোচনাটির ভিডিও লিংক এখানে-