Home সম্পাদকীয় রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের সামনে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের বিকল্প নেই

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের সামনে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের বিকল্প নেই

মিয়ানমারের উগ্রবাদী বৌদ্ধ ও সরকারি বাহিনীর গণহত্যার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। বহু বছরের পুরনো রোহিঙ্গা সংকট মূলত: মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের ফল।

রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাস করলেও বৃটিশ ঔপনিবেশিকরা চলে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে এক প্রকার জটিলতার মধ্যে রেখে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা জাতীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এক পর্যায়ে বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের প্রভাবে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটিকে একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে।

অং সান সুচির নেতৃত্বে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে এলে সকলেই আশা করেছিল, রোহিঙ্গা সংকটের ন্যায়সঙ্গত সমাধান হবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টো। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের আমলে রোহিঙ্গারা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা বা এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হয়।

রাখাইনের মুসলমানরা গত ৬ দশক ধরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়ে মাঝ মধ্যেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে নারকীয় গণহত্যার মুখে ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার ভারে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের পক্ষে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার চাপ সামলাতে গিয়ে নানাবিধ সংকটের মুখে পড়ছে।

রোহিঙ্গা সংকট গত তিন বছর ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকর সংকট হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। প্রথম দিকে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেলেও এখন তাদের ভূমিকা অনেকটাই নিস্প্রভ। তারা অনেকটা লিপ সার্ভিস দিয়ে চুপ মেরে রয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

অন্যদিকে মিয়ানমারের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে গত সোমবার রাজধানীর বেসসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) বিভাগ একটি আন্তর্জাতিক ওয়েবিমিনারের আয়োজন করে। দেশি-বিদেশি আলোচকদের মধ্যে মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবার, বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারসহ বরেন্য ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করে তাদের মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নানা রকম প্রস্তাব, প্রতিশ্রুতি ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও গত তিন বছরে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অন্যদিকে সংকটের শুরুতেই ২০১৭ সালের নভেম্বরে তড়িঘড়ি করে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ একটি প্রত্যাবাসন চুক্তিতে সই করলেও তা বাস্তবায়নের কোনো আগ্রহ দেখায়নি মিয়ানমার। এরপর ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইউএনএইচসিআর এবং ইউএনডিপির মধ্যস্থতায় একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হলেও তার শর্তও রক্ষা করেনি মিয়ানমার।

চলতি বছরের জানুয়ারীতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে একটি অন্তবর্তী আদেশ জারি করেছিল। মিয়ানমার সরকার সেসব আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনের প্রতি কোনো ভ্রæক্ষেপ করেনি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২০১৭ এবং ১৮ সালের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাখাইনে একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব রেখেছিলেন।

রোহিঙ্গা সংকটের তৃতীয় বার্ষিকীতে ভার্চুয়াল সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বক্তারা প্রধানমন্ত্রীর সে প্রস্তাবকে সামনে এনে তা বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন। চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ, কক্সবাজার থেকে কুনমিং পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পুরনো উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়নের স্বার্থে রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান জরুরী। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশকে চীনের সাথের বন্ধুত্বকে কাজে লাগাতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকটের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নীতিগতভাবে বাংলাদেশ সমর্থন পাবে এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। দুঃখের বিষয়, প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রতি কেবল সহানুভূতি এবং কিছু ত্রাণ সামগ্রী পাওয়া ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি।

মিয়ানমারের রাখাইনে চীনের বিশাল বিনিয়োগ ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ থাকায় তারা সেখানে মিয়ানমারের প্রতি নমনীয় হয়ে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে কেবল প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। অথচ চীন বাংলাদেশের ঘনিষ্ট বন্ধুর পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের অংশীদার এবং তার বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। একইভাবে জাপান, ভারত এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পশ্চিমা শক্তিও একদিকে মানবাধিকার ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পক্ষে কথা বলেন, অন্যদিকে মিয়ানমারে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব কায়েমে সচেষ্ট থাকতে দেখা যাচ্ছে। চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

এ হিসেবে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি ও উন্নয়নের স্বার্থেই রোহিঙ্গা সংকটে তার এগিয়ে আসা উচিৎ। জাপান নীতি কথা বললেও প্রকারন্তরে মিয়ানমারে বিনিয়োগসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এবং মিয়ানমারে তাদের ফেরতের ব্যাপারে কেউই কার্যকর কোনো ভূূমিকা রাখছে না। প্রত্যেকেই মুখে মুখে সহানুভূতি প্রকাশ ও কিছু সহযোগিতা দিয়ে দায় সারছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভাষানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকেই নিজ থেকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথেষ্ট দক্ষ। ফলে প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ সমস্যার সমাধানের বিষয়টি এগিয়ে নেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর বিকল্প নেই।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।