Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমানদের ‘বেয়াদব’ বলেছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমানদের ‘বেয়াদব’ বলেছিলেন?

।। ত্বরিকুল ইসলাম ।।

ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হলেও রবীন্দ্রনাথ হিন্দুত্বের বাইরে আর কোনো স্বাক্ষর রাখেননি। তিনি সেকুলার ছিলেন না। বরং ছিলেন হিন্দুত্ববাদী। তিনি নিজেই চাইতেন যে, ভারতের মুসলমানরা হিন্দু পরিচয় ধারণ করুক, অর্থাৎ তাদেরকে হিন্দুরূপী মুসলমান হতে হবে। ভারতের কেউ ধর্মে খ্রিস্টান কিংবা মুসলিম হোক, তাকে জাতিতে ‘হিন্দু পরিচয়’ ধারণ করতে হবে— এমন সাম্প্রদায়িক নীতিই ছিল রবিঠাকুরের জাতিবাদী দর্শন!

রবীন্দ্রনাথ এই হিন্দুরূপী মুসলমান ও হিন্দুরূপী খ্রিস্টান থিওরি দিয়েছেন তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ নামক প্রবন্ধে-

“তবে কি মুসলমান অথবা খ্রীস্টান সম্প্রদায়ে যোগ দিলেও তুমি হিন্দু থাকিতে পার? নিশ্চয়ই পারি। ইহার মধ্যে পারাপারির তর্কমাত্রই নাই। হিন্দুসমাজের লোকেরা কী বলে সে কথায় কান দিতে আমরা বাধ্য নই; কিন্তু ইহা সত্য যে কালীচরণ বাঁড়ুজ্যে মশাই হিন্দু খ্রীস্টান ছিলেন। তাঁহার পূর্বে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর হিন্দু খ্রীস্টান ছিলেন। তাঁহারও পূর্বে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু খ্রীস্টান ছিলেন। অর্থাৎ তাঁহারা জাতিতে হিন্দু, ধর্মে খ্রীস্টান। খ্রীস্টান তাঁহাদের রঙ, হিন্দুই তাঁহাদের বস্তু। বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে। হিন্দুরা অহর্নিশি তাহাদিগকে ‘হিন্দু নও হিন্দু নও’ বলিয়াছে এবং তাহারাও নিজেদিগকে ‘হিন্দু নই হিন্দু নই’ শুনাইয়া আসিয়াছে; কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাহারা প্রকৃতই হিন্দুমুসলমান। কোনো হিন্দু পরিবারে এক ভাই খ্রীস্টান, এক ভাই মুসলমান ও এক ভাই বৈষ্ণব এক পিতামাতার স্নেহে একত্রে বাস করিতেছে—এই কথা কল্পনা করা কখনোই দুঃসাধ্য নহে, বরঞ্চ ইহাই কল্পনা করা সহজ— কারণ ইহাই যথার্থ সত্য, সুতরাং মঙ্গল এবং সুন্দর।” (রবীন্দ্র রচনাবলী)

ড. সলিমুল্লাহ খান তাঁর ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “ভারতের বৃহৎ হিন্দুজাতি— খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন সবাইকে হিন্দু বানাইতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলিতেছিলেন, ‘মুসলমানরা একমাত্র বেয়াদব, যাহারা হিন্দু পরিচয় স্বীকার করিবে না’।” (২০ অক্টো. ২০১২, সিল্করুট, দৈনিক বণিক বার্তা)।

একই প্রবন্ধে ড. সলিমুল্লাহ খান আরো লেখেন, “হিন্দু-ব্রাহ্ম নির্বিশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু হইতেই (যখন মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেয় নাই, তখন হইতেই) তাঁহারা ভারতবর্ষকে শুদ্ধ হিন্দুর দেশ বলিয়া কল্পনা শুরু করিলেন। পাঁড় হিন্দুর কথা নাহয় বাদই দিলাম। ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাজনারায়ণ বসু হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বেবাকেই প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে এটি করেছেন।” (প্রাগুক্ত)।

বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে লিখেছিলেন, “হাজার বছর মুসলমানরা হিন্দুর সাথে একদেশে একত্রে বাস করিয়াছে। হিন্দুদের রাজা হিসেবেও, প্রজা হিসেবেও। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক ঐক্য হয় নাই। হয় নাই এই জন্য যে, হিন্দুরা চাহিত আর্য-অনার্য, শক, হুন যেভাবে ‘মহাভারতের সাগর তীরে’ লীন হইয়াছিল, মুসলমানেরাও তেমনি মহান হিন্দুসমাজে লীন হইয়া যাউক। তাহারা শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, ‘হিন্দুমুসলমান’ (হিন্দুরূপী মুসলমান) হইতে হইবে। এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দুসভার জনতার মত ছিল না, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও মত ছিল।” (পৃ. ১৫৮-১৫৯)।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার হিন্দুত্ব নিয়ে ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে আরো লিখেছিলেন-

“আমরা যে-ধর্মকে গ্রহণ করিয়াছি, তাহা বিশ্বজনীন তথাপি তাহা হিন্দুরই ধর্ম। এই বিশ্বধর্মকে আমরা হিন্দুর চিত্ত দিয়াই চিন্তা করিয়াছি, হিন্দুর চিত্ত দিয়াই গ্রহণ করিয়াছি। শুধু ব্রহ্মের নামের মধ্যে নহে, ব্রহ্মের ধারণার মধ্যে নহে, আমাদের ব্রহ্মের উপাসনার মধ্যেও একটি গভীর বিশেষত্ব আছেই— এই বিশেষত্বের মধ্যে বহুশত বৎসরের হিন্দুর দর্শন, হিন্দুর ভক্তিতত্ত্ব, হিন্দুর যোগসাধনা, হিন্দুর অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান, হিন্দুর ধ্যানদৃষ্টির বিশেষত্ব ওতপ্রোতভাবে মিলিত হইয়া আছে। আছে বলিয়াই তাহা বিশেষভাবে উপাদেয়, আছে বলিয়াই পৃথিবীতে তাহার বিশেষ মূল্য আছে।” (রবীন্দ্র রচনাবলী)

সুতরাং, হিন্দু রবীন্দ্রনাথকে সেকুলার বানিয়ে উপস্থাপন করার বিষয়টি কতটা প্রতারণামূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক, তা বলা বাহুল্য। আমাদের দেশের সেকুলার বাম প্রগতিশীল ঘরানার অতিউৎসাহী রবীন্দ্রভক্তদের অতিরঞ্জিত কর্মকাণ্ড দেখে তাদের প্রতি করুণাই শুধু জাগে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ কমিউনিস্টদের পছন্দ করতেন না, কারণ তারা জমিদারি ও মহাজনি ব্যবস্থা (গলাকাটা সুদে ঋণব্যবসা) বিলুপ্তির দাবিতে আন্দোলন করেছিল, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো শোষক জমিদার প্রতিভূদের স্বার্থে আঘাত হানে। ফলে রবীন্দ্রনাথ কমিউনিস্টদের আন্দোলনের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘কমিউনিজম ও ফ্যাসিজম হলো একই পাখির দুই ডানা’ (ভূমিকা, রায়তের কথা, প্রমথ চৌধুরী)।

এতদসত্ত্বেও আমাদের দেশে কমিউনিস্টদের অতি রবীন্দ্রভক্তি হাস্যকর। তবে, পশ্চিমবঙ্গে তথা কলকাতায় রবীন্দ্রনাথকে ‘দেবতা’ হিসেবে পূজা করে সাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এটা দেখে সেখানকার কমিউনিস্টরা ভোট বাগানোর ধান্দায় রবীন্দ্রতোষণ শুরু করে। সোজা কথায়, তারা ভোট আদায়ের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা শুরু করে। আর আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা কিনা কলকাতার দাদাবাবুদের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না।

আমাদের গাণ্ডুমার্কা বাম কমিউনিস্টরা শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে ‘সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদে’র অবতারে পরিণত করেছে! এদের অতিশয় রবীন্দ্রভক্তি ও রবীন্দ্রপূজার ফলে ‘রবীন্দ্রবাদ’ এখন সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের একটি বিশেষ রাজনৈতিক ধর্ম হয়ে উঠেছে।

তাছাড়া রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিকভাবে এদেশে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস শুরু হয়েছিল বায়ান্ন’র ভাষা-আন্দোলনের সময় থেকে। তখন পাকিস্তানি ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গান মোক্ষম সাংস্কৃতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছিল (আমিও মনে করি যে, সেটা দরকারি ছিল)। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এদেশে ইসলামী প্রভাব ও মুসলিম ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কালচারালি হিন্দু রবীন্দ্রনাথকে দাঁড় করিয়ে তথাকথিত সেকুলারিজমের ছদ্মাবরণে হিন্দুত্ববাদের সম্প্রসারণ ও প্রতিষ্ঠা করাই যেন তাদের মূল টার্গেট হয়ে উঠেছে।

বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথকে আজ নয়া আধিপত্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী এজেন্ডার মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় ইসলামপন্থী ও ইসলামী তরুণ প্রজন্মের কাজ হলো, রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথ কিংবা রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে গড়ে ওঠা সো-কল্ড আইকোনোক্লাজমের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ জারি রাখা।

– ত্বরিকুল ইসলাম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও জাতীয় ইংরেজি পত্রপত্রিকার কলামিস্ট।